রোহিঙ্গাদের নতুন ঠিকানা বালুখালী

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ঢালায় নতুন ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন বন্ধ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায়। তাদের অনেকে রাস্তার পাশে খালি জায়গায় ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে থাকছেন। অনেকে আছেন খোলা আকাশের নিচে। এদিকে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির প্রহরা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ফেরত পাঠানো হয়েছে ৩২১৫ জন রোহিঙ্গাকে। তাদের বহনকারী ১৫টি নৌকা জব্দ করেছে বিজিবি।
উখিয়ার বালুখালী অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি লালু মাঝি জানান, এই ক্যাম্প কানায় কানায় পূর্ণ। আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দেওয়া এখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে জায়গা না পেয়ে অনেকে খোলা আকাশে নিচে রাত কাটাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গারা নতুন করে ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করেছে ‘বালুখালী ঢালা’য়। ইতোমধ্যে কয়েক শ ছোট ছোট ঝুঁপড়ি তৈরি করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার মোহাম্মদ রফিক (৩২)। তিনি বলেন, গত মাসের ২৫ তারিখ রওনা দিয়ে পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে লুকিয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশে ঢুকি। আমরা তমব্রু দিয়ে আসার সময় দেখি আর্মিরা গুলি করে মানুষ মারছে। আর ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে।

এ ছাড়া উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা ও শাপলাপুরে স্থান না পাওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে উখিয়ার কুতুপালং থেকে শুরু করে থাইংখালী পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকা পাহাড়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের। একই সঙ্গে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রং-এর পশ্চিমের পাহাড়ে ‘রইক্ষ্যং’ নামক এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন এক রোহিঙ্গা বস্তি। যেখানে অন্তত লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
সরেজমিন বালুখালী ও কুতুপালং ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পের প্রবেশ দ্বার দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা ঢুকছে। কারো হাতে সন্তান, কারো হাতে হাঁড়ি-পাতিলসহ ছোট-খাটো আসবাবপত্র। এসব রোহিঙ্গার বেশির ভাগ নারী ও শিশু।
এদিকে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের পরিধি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গভীর বনে প্রবেশ করছে ক্যাম্পের ঝুঁপড়ি ঘর। এর পরও স্থান সংকুলান হচ্ছে না তাদের। অনেক রোহিঙ্গারা রাস্তা, বন্ধ দোকানপাট, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসাসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুর বলেন, ক্যাম্পের কোথাও জায়গা নেই। শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। ছোট একটি ঝুঁপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকছে ১০ থেকে ১৫ জন। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, গত ১২ দিনে উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে অনন্ত দেড় লাখের মতো। তারা সবাই উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প, বস্তি ও রাস্তায় রাস্তায় রয়েছে এখনো। এর বাইরে আরো ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে করেছে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, তার ইউনিয়নের ১০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয় গত ছয় দিন থেকে। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে।
মঙ্গলবারও উখিয়া-টেকনাফের ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের দলে দলে আসতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে আসা এ রোহিঙ্গাদের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা ও ধরন একই। অনেকটা গণহত্যার মতো পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন এরা।
বিজিবির টেকনাফস্থ ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টেকনাফের পাঁচটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ২৬৭৫ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিল। এ সময় তাদেরকে প্রতিহত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সীমান্তের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চিহ্নিত পয়েন্টসমূহে বিজিবি টহল বাড়ানো হয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, সীমান্তজুড়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। তাদের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। যাতে করে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সেভাবেই কাজ করছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। তবে এ মুহূর্তে পরিস্থিতিটা অন্য রকম। দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।

উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে আটকের পর তিন হাজার ২১৫ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এ সময় রোহিঙ্গাদের বহন করা ২৫টি নৌকা জব্দ করা হয়। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে দুই হাজার ৬৭৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে মানবিক সহায়তা দিয়ে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। অন্যদিকে নাফ নদ হয়ে অনুপ্রবেশকালে ৫৩৭ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম সজীব। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। এ সময় ২৫টি নৌকাও জব্দ করা হয়। কোস্টগার্ড কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ফয়সাল জানান, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত রোহিঙ্গা বোঝাই মিয়ানমারের নৌকাগুলো নাফ নদের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। এ সময় কোস্টগার্ড নৌকাগুলো বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশে বাধা দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি আরো জানান, ছোট-বড় প্রতিটি নৌকায় ২০-২৫ জন রোহিঙ্গা ছিল।
আজকের বাজার: সালি / ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭