রোহিঙ্গা সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ছে মায়ানমারের পর্যটন শিল্প

বহু বছর ধরে সামরিক শাসনের অধীন মায়ানমারের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ সীমিত ছিল। গত দশকের শেষ দিকে ইনডেক্স অব ইকোনমিক ফ্রিডমে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্নে থাকা বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়ার পরের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে ছিল দেশটি। তবে এ দশকের গোড়ায় অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরে দেশটির সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে অন্যান্য অনেক ব্যবসার পাশাপাশি এর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের স্বাদ পেতে ছুটে আসতে থাকেন পর্যটকরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ও কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে সে দেশের সামরিক বাহিনী ও সরকার দেশত্যাগে বাধ্য করে। এতে করে বিশ্বব্যাপী দেশটি নিন্দার সম্মুখীন হয়, যার বড় প্রভাব পড়ছে দেশটির পর্যটন শিল্পে।

কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গায়িকা বিয়ন্স এবং র্যাপ গায়ক ও ব্যবসায়ী জে-জি মায়ানমারের বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরগুলোয় ছবি তুলে দেশটিকে একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তবে গত আগস্টের শেষ দিক থেকে সেনাবাহিনী পশ্চিম রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে। এসব ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরে দেশটির ভাবমূর্তি পর্যটকদের কাছে বদলে যায়। এ পরিস্থিতিতে দেশটির পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসাগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ট্যুরিজম অপারেটররা পর্যটকদের থেকে একের পর এক ভ্রমণ বাতিলের নির্দেশ পাচ্ছে। অক্টোবরের ভরা মৌসুমেও ব্যবসায় চরম মন্দাভাব দেখা গিয়েছে। ফলে বিকশিত এ ক্ষেত্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত, কোলাহল থেকে দূরে থাকা স্নিগ্ধ সমুদ্রতট এবং কুয়াশায় মোড়া প্রাকৃতিক লেকগুলো পর্যটকদের পছন্দের জায়গা। এসব স্থানে ভ্রমণ পরিচালনা করা ট্যুর গ্রুপ

ফ্যান্টাস্টিক এশিয়া ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরের তুন তুন নাইং বলেন, রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতির কারণে গোটা দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেজন্য অক্টোবর ও নভেম্বরে নির্ধারিত প্রায় সব ট্রিপ বাতিল হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্য দেশের পর্যটকরা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়েছেন আর কিছু ইউরোপীয় মানবাধিকার পরিস্থিতি অবনতির কারণে দেশটি বর্জন করছেন বলে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। উপনিবেশিক আমলের স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত ইয়াঙ্গুন শহরে এখনো কিছু পর্যটকের আনাগোনা দেখা গেলেও চলমান সংকট পর্যটন ব্যবসার জন্য বিরাট হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইয়াঙ্গুনের শোয়েদাগোন প্যাগোডা ঘুরতে আসা ক্রিস্টিন নামক একজন ফরাসি পর্যটক বলেন, দেশটির পরিণতি দেখাটা দুঃখজনক। আমার গাইড আমাকে বলেছেন, মুসলিমরা বিপজ্জনক এবং তারা বার্মিজ নয়। এমনকি কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও দেশটি থেকে নিজেদের দূরে রাখছেন। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ চার্লস এবং তার স্ত্রী ক্যামেলিয়া তাদের শরত্কালীন এশিয়া সফরের সময় নির্ধারিত মিয়ানমার ভ্রমণ বাতিল করেন।

চলতি বছরের প্রথম দিকে দেশটির পর্যটন শিল্প দুর্দান্তভাবে শুরু হয়। দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত বছরের এ সময়কার তুলনায় খাতটিতে চলতি বছর ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। ২০২০ সাল নাগাদ দেশটিতে বছরে ৭৫ লাখ পর্যটকের আগমন হবে বলে মন্ত্রণালয় আশা করেছিল।
তবে আগস্টের শেষদিকে পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে রাখাইনদের ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়নের ফলে রাজ্যটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর এ নিপীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূল’ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ।

পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের দক্ষিণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত মারুক-উ। এ প্রাচীন রাজধানী শহরটিতে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং নিদর্শন রয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য বড় আকর্ষণ।

তবে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ঘটনার দুই মাস পরে স্থানীয়রা জানান, একসময়ে পর্যটকের ভিড়ে গমগম করতে থাকা স্থানটি এখন জনহীন। সেখানে গাইডের কাজ করা অং সু মিন্ট বলেন, পর্যটন শিল্পে জীবিকা নির্বাহকারীরা এখন কর্মহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে ২ নভেম্বর ২০১৭