লাঠিয়ালের বদলে গণমাধ্যম পুষছে কালো টাকার মালিকরা

লাঠিয়ালের বদলে গণমাধ্যম পুষছে কালো টাকার মালিকর। অতীতে কেউ কালো টাকার মালিক হলে বা অনেক শত্রু থাকলে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী তৈরী করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই লাঠিয়ালের জায়গা করে নিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। এখন ভূমি দস্যুরা সংবাদ মাধ্যম পুষে, দূর্ণিতি গ্রস্ত রাজনীতিবিদরা সংবাদ মাধ্যম পুষে, টেক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য দেশীয় পন্যের নামে বিদেশী নিন্ম মানের পন্য বিক্রেতা নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম পুষার মাধ্যমে তাদের বাজে মানের পন্যের গুনগান করায়, যে কোন কালো টাকার মালিকই আর কিছু না হোক লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে একটি হলেও সংবাদ মাধ্যম পুষে। সেটা যেমন হতে পারে টেলিভিশন, পত্রিকা নয়তো ন্যূন্যতম হলেও একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম।

জেষ্ঠ্য সাংবাদিক আহমেদ রাজু সম্প্রতি এমনই এক ব্যবসায়ীর রিপোর্ট করার কারণে রোষানলে পড়লে সেই ব্যবসায়ীর মালিকনাধীন অনলাইনে আহমেদ রাজুর নামে মন গড়া সংবাদ প্রকাশ করে। আহমেদ রাজু রিমান্ডের নির্যাতন সহ্য করে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন মামলার। শুধু নিজের মালিকানাধিন সংবাদ মাধ্যমেই নয়, বরং কতিপয় নাম না জানা অনলাইনেও আহমেদ রাজুর বিষেধাগার গাওয়া হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের বেশীর ভাগ পত্রিকাই আহমেদ রাজুর পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। কেননা, সেই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সবাইকে বিজ্ঞাপন দিয়ে খুশী রাখে। আহমেদ রাজুর পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করলে যদি সেই তবারকের বিজ্ঞাপন হাত ছাড়া হয়, এই ভয়ে বেশীর ভাগ সংবাদ মাধ্যমই আহমেদ রাজুর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার সাহস করেনি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা আজ করপোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটেছে। অন্যদিকে সরকার আইসিটি এ্যাক্টের ৫৭ ধারার সংযোজন করার মাধ্যমে যেটুকু স্বাধিনতা ছিল তাও শেষ করে দিয়েছে।

এই বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত বাদশা বলেন, ‘দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমরা মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার কথা বলছি। সত্যিকার অর্থে দেশে গণমাধ্যমের যেমন স্বাধীনতা নেই, একইভাবে সাংবাদিকদেরও তেমনিভাবে লেখার স্বাধীনতা নেই।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের অনেক ভালো কাজের সঙ্গে বেশকিছু নিবর্তনমূলক কালাকানুনও রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৫৭ ধারাটি অন্যতম।’ তিনি বলেন, ‘যারা অনলাইনভিত্তিক সাংবাদিকতা করেন এবং যেসব সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সন রয়েছে, সেখানে কোনও নিউজ হলে যে কেউ এই ৫৭ ধারায় মামলা করতে পারে এবং এমন মামলা ঠুকে দিচ্ছেও। এ কারণে সংবাদপত্রে, বিশেষ করে অনলাইন সংবাদপত্রের জগতে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক সাংবাদিক সেলফ সেন্সরশিপ করছেন। এমন ভীতিকর পরিবেশে আর মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের লেখার অধিকার থাকে না।’

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা আরো বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকের আগের সংবাদপত্র আর আজকের সংবাদপত্র এক নয়। বর্তমানে সংবাদপত্র করপোরেট হাউজগুলোতে বন্দি। আজকের গণমাধ্যমের সংবাদ করপোরেট নির্ভর হয়ে গেছে। ফলে মালিকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ সংবাদ তৈরি করা হয়। এখান থেকে গণমাধ্যমকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে। তাহলে শুধু বেতনভোগী শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে সাংবাদিকরা।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা একটি অন্যটির পরিপূরক। একটির সঙ্গে অন্যটির কিছুটা দূরত্ব ও ভিন্নতাও রয়েছে। একটি গণমাধ্যমের নীতি কী হবে, কোন পদ্ধতিতে চলবে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা, সব ধরনের মত প্রচার করার সুযোগ আছে কিনা এবং তাদের মত প্রকাশের সুযোগ আছে কিনা—এগুলো হচ্ছে মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। আর সাংবাদিকদের স্বাধীনতা বলতে আমি যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে—সাংবাদিক যে সংবাদটি করবেন সেটিতে যদি বড় ধরনের কোনও ত্রুটি না থাকে তাহলে সেই সংবাদটি সঠিক ও অক্ষতভাবে প্রকাশিত হওয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ কিছুটা লক্ষ্য করলেও সামষ্টিক অর্থে তা অন্য যে কোনও সরকারের শাসনামলের চেয়ে কম। বরং এখন সাংবাদিকদের হাত বাঁধা থাকে মালিকপক্ষের অঘোষিত কিছু নীতিমালার কারণে। প্রতিটি হাউজে এমন কিছু অলিখিত নীতিমালা রয়েছে বলেই আমরা শুনতে পাই। ফলে একজন সাংবাদিকের লেখার জন্য যেটুকু স্বাধীনতা দরকার, তা কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে না। যখন থেকে সংবাদপত্র শিল্প করপোরেট হাউজ কিংবা বিশেষ ব্যবসায়ী মহলের অধীনে চলে গেছে, তখন থেকে সংবাদপত্র শিল্পে আরেকটি নতুন পরাধীনতার শৃঙ্খল যুক্ত হয়েছে। এর কারণ, মালিকের ব্যবসা, স্বার্থ ও সুবিধা চিন্তা করে অনেক সংবাদ প্রকাশে তারা বিরত থাকেন। আবার উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ তৈরি ও প্রকাশে বাধ্যও হন তারা। এ জায়গায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কিছুটা বিনষ্ট হচ্ছে।’
এই যখন সাংবাদিকতার অবস্থা, তখন স্বাধীন সাংবাদিকতার শুধু স্বপ্নই আমরা দেখতে পারি। বাস্তবে মুক্ত গনমাধ্যম শুধু দিবস পালনে সীমাবদ্ধ থাকবে। মুক্ত গনমাধ্যম আমরা আর দেখতে পারব না।

এখনই সময় সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমকে লাঠিয়াল সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করায় এগিয়ে আসার। নয়তো ভবিষ্যতে সাংবাদিকরা ব্যবসায়ীদের ভৃত্য শ্রেনীভূক্ত দাসে পরিণত হবে।

ইউসুফ আহমেদ তুহিন

সম্পাদক
সাপ্তাহিক নতুন বার্তা