শতভাগ প্রস্তুত নয় সাভারের চামড়া শিল্পনগরী

কোরবানির ঈদকে সামনে করে প্রতিবছরই জমে ওঠে চামড়া ব্যবসা। দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে নানা প্রস্তুতি চলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। এবারও রয়েছে নানা প্রস্তুতি। তবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর অবকাঠামো এখনও শতভাগ প্রস্তুত নয়। সরকারের প্রস্তুতি এবং মালিকদের সদিচ্ছার অভাবেই সাভার চামড়া শিল্প নগরীকে উৎপাদনের উপযোগী করা যায়নি। সামনের সারির প্লটগুলোর সামনের সড়কের কাজ শেষ হলেও পেছনের দিকে রাস্তা এখনও কাঁচা। বৃষ্টিতে সেখানে হাঁটুসমান কাদা জমে যায় বলে জানিয়েছেন প্লটগুলোর মালিকেরা।
হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের জন্য জমি হুকুমদখল করা হয় ২০০৩ সালে। মালিকদের কাছে প্লট হস্তান্তর করা হয় ২০০৯ সালে। যে কোনো বড় শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করতে হলে কিছু সমস্যা থাকেই। কেউ বাড়ি বদলালেও তো কত ধরনের সমস্যা।

সাভারে জমি প্রস্তুত করা, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সংযোগ, চামড়ার কারখানার দূষিত তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা- কত ধরনের সমস্যা। শিল্প স্থানান্তর ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে মালিকরা সরকারের কাছ থেকে ২৫০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে সরিয়ে নিতে ট্যানারি মালিকদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেকে বরাদ্দ নিয়েও ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলেননি।
এখনও খালি পড়ে আছে অনেক প্লট। কবে নাগাদ এ জটিলতার অবসান হবে সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না কারও কাছে। তিন বছর মেয়াদের প্রকল্পটি বারবার সময় বৃদ্ধি করে ১৩ বছরেও শেষ হয়নি।

অন্যদিকে সরকার বারবার ট্যানারি মালিকদের হাজারীবাগ ছাড়ার সময় বেঁধে দিলেও অবকাঠামো সুবিধা না থাকার অজুহাতে তারা কারখানা স্থানান্তর করেননি। আবার তাদের অভিযোগ, সরকার কারখানা স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তাও দেয়নি। কিন্তু অর্থ ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ট্যানারি মালিকদের চামড়া শিল্প কারখানা হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্লট বরাদ্দসহ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ট্যানারি মালিকদের গাফিলতিতেই তা এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিসিকের চেয়ারম্যান।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ওই এলাকার চারপাশের সব সড়ক ঘিরে গ্যাসের লাইন বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০০৬ সালে। শিল্প নগরীর অভ্যন্তরে গ্যাসের লাইনে কোনও সমস্যা নেই। ১১ বছর আগে গ্যাসের লাইন বসানোর কাজ শেষ হলেও ট্যানারি মালিকরা নিজ নিজ প্লটের সংযোগের জন্য আবেদন করেননি।

সাভার চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প ইঞ্জিনিয়ার মঈনুদ্দিন আহমেদ জানান, এখন এসে ট্যানারি মালিকরা গ্যাসের সংযোগের জন্য আবেদন করছেন। এতদিন আবেদন না করে সরকারের ঘাঁড়ে দোষ চাপিয়ে তারা বলেছেন, সরকার সাভারে ট্যানারি শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়নি, আমরা উৎপাদন করবো কীভাবে? তাদের এ অভিযোগ সঠিক নয়।

সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে খালি পড়ে থাকা একটি প্লট
আবেদনের পরেও শিল্প মালিকরা এখনও কেন সংযোগ পায়নি জানতে চাইলে প্রকৌশলী মঈনুদ্দিন জানান, এক্ষেত্রে তিতাস কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে কীভাবে তাদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা যতোদূর জেনেছি, তিতাস কর্তৃপক্ষ ট্যানারি মালিকদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা হাজারীবাগে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছিলেন, সাভারেও তাদের সেই পরিমাণ গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে। এর বেশি নয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা হাজারীবাগের তুলনায় বেশি গ্যাস ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন। বিষয়টি এখনও সুরাহা করেনি তিতাস কর্তৃপক্ষ। তাই গ্যাস সংযোগ পাচ্ছেন না ট্যানারি মালিকরা। এক্ষেত্রে প্রকল্প বা বিসিকের কিছুই করার নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে দেওয়া আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সাভারের হরিণধরায় সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে তিন বছর মেয়াদী যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে একযুগ আগে। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে হয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনও হতাশাজনক।

জানা গেছে, সরকারের প্রস্তুতি আর মালিকদের সদিচ্ছার অভাবেই সাভারে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়নি। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া চামড়া শিল্প নগরী ১৩ বছরেও প্রস্তুত হয়নি। সরকার এবং মালিকদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের জের ধরে পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর চামড়া কারখানা এখনও হাজারীবাগেই রয়ে গেছে।

সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় অবস্থিত চামড়া শিল্পনগরীতে সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অনেক স্থানেই এখনও শিল্পনগরীর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ চলছে। প্রধান সড়কের কাজ শেষ হলেও ভেতরের সংযোগ সড়কগুলো ভাঙা। শিল্প নগরী বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্মাণসামগ্রী নেওয়ার কারণে রাস্তা ভেঙে গেছে। তবে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হলেই সেগুলো সংস্কার করা হবে। সবদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিইটিপি নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। অধিকাংশ কারখানা ভবনের দোতলা বা তিনতলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। কিছু কিছু কারখানায় ড্রাম বসেছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কারখানা স্থানান্তরের বিষয়ে মালিকরা কাজ করছেন। সেখানকার অবকাঠামো সুবিধা এখনও পর্যাপ্ত নয়। শিল্প নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোও ভাঙাচোরা। এছাড়া আবেদন করা সত্ত্বেও এখনও ট্যানারি কারখানায় গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাই তাড়াহুড়ো করে ট্যানারি স্থানান্তর সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক আবদুল কাইয়ুম বলেন, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার চালু করার জন্য যে পরিমাণ বর্জ্য প্রয়োজন তা পাচ্ছি না। এখনও অনেক ট্যানারি কর্তৃপক্ষ পরিবেশ ছাড়পত্র পায়নি। সেখানে তো আমাদের কিছু করার নাই। অভ্যন্তরীণ সড়কের বেহাল পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মন্তব্য, সড়ক সবই প্রস্তুত ছিল। পুরো শিল্প নগরীজুড়ে নির্মাণ কাজ চলছে। এ কারণে কিছু কিছু সড়ক হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেগুলো আমরা সংস্কার করবো।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাভারে নির্মাণাধীন ট্যানারি পল্লীর ২০৫টি প্লটের মধ্যে ১৫৫টি শিল্প ইউনিট বরাদ্দ দেয় সরকার। এর মধ্যে ১৫৩টির লেআউট প্ল্যান অনুমোদন করা হয়। এখন পর্যন্ত হাইকোর্ট কর্তৃক একটি প্লটের মালিককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। শর্ত পালন করতে না পারায় তিনটি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেছে সরকার। এ ছাড়া হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে রেখেছে ৭টি প্লট এবং একটি প্লটের বিপরীতে মামলা থাকায় বরাদ্দপত্র জারি করা হয়নি।

এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কাছে আবেদন করেছে ১৫২টি ট্যানারি। এর মধ্যে ১০৭টিকে ডিমান্ড নোট দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করলেও ১০৫টি ট্যানারি গ্যাস পায়নি। পানির সংযোগের জন্য আবেদন করেছে ৮৯টি ট্যানারি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যাওয়ার মতো প্রস্তুতি নিয়েছে ৭টি ট্যানারি। বাকিগুলোর কাজ ১০-৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭