শরীর ও মনের সৌন্দর্য বদলে দিচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারি

কসমেটিক সর্জারি মূলত প্লাস্টিক সার্জারির অন্তর্ভুক্ত। প্লাস্টিক সার্জারি কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ প্লাস্টিকোস থেকে, যার অর্থ আকৃতিগত পরিবর্তন করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখা শরীরের নানা রকম ত্রুটি সারিয়ে তুলতে অবদান রাখছে। জন্মগত, আঘাতজনিত, ক্যানসার অপারেশন-পরবর্তী বা পুড়ে যাওয়ার পর শরীরে যেসব ত্রুটি দেখা দেয় তার চিকিৎসা প্লাস্টিক সার্জারির অন্তর্ভুক্ত। কসমেটিক সার্জারি কথাটি এসেছে আরেকটি গ্রিক শব্দ ‘কসমেটিকস’ থেকে। যার অর্থ সৌন্দর্যবর্ধন। সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য যেসব অপারেশন করা হয়, তা-ই কসমেটিক সার্জারি। লাইপোসাকশন (শরীরের অতিরিক্ত চর্বি বের করে ফেলা), ম্যামোপ্লাস্টিক বা স্তনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, রাইনোপ্লাস্টি বা নাকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ইত্যাদি এর আওতাধীন।

নাকের সৌন্দর্য বর্ধনে প্লাস্টিক সার্জারি: রাইনোপ্লাস্টি

কসমেটিক রাইনোপ্লাস্টি অপারেশনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন অগমেন্টেশন রাইনোপ্লাস্টি, রিডাকশন রাইনোপ্লাস্টি এবং টিপ রাইনোপ্লাস্টি। অগমেন্টেশন রাইনোপ্লাস্টি অপারেশনের  মাধ্যমে বোঁচা বা দেবে যাওয়া নাককে সুন্দর ও স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব। অনেকের নাক চেহারার সঙ্গে মানানসই নয়। বড়, লম্বা বা এমন আকারে থাকে, যাতে পুরো চেহারার সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে নাক ছেঁটে ছোট করা হয় রিডাকশন রাইনোপ্ল-াস্টির মাধ্যমে। আর যাদের নাকের টিপ বা প্রান্ত একটু মোটা, তাদের জন্য প্রযোজ্য টিপ রাইনোপ্লাস্টি। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে আমাদের এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম রাইনোপ্লাস্টি অপারেশন শুরু হয়। সে সময় সুসরতা নামক জনৈক চিকিৎসক এই অপারেশনের সূচনা করেন। তিনি নাক কেটে যাওয়ার পর নাক তৈরি করতেন কপালের ত্বক দিয়ে। একে বলা হয় ‘মেডিয়ান’ ফোরহেড ফ্লাপ। ভারতীয় উপমহাদেশে এই অপারেশন চালু হওয়ায় প্লাস্টিক সার্জনদের কাছে তা সমাদৃত ‘ইন্ডিয়ান মেডিয়ান ফোরহেড ফ্লাপ’ বলে।

শত শত বছর ধরে এই অপারেশন চলে আসছে। ইউরোপ থেকে বহু সার্জন উপমহাদেশে আসতেন কেবল এই অপারেশন শিখতে। এ ছিল নাক কেটে যাওয়ার পর পুনর্গঠন বা রিকনস্ট্রাক্টিভ রাইনোপ্লাস্টির ইতিহাস। কসমেটিক রাইনোপ্লাস্টি অপারেশন সর্বপ্রথম করেন জন ওরলান্ডো রো, নিউইয়র্কে ১৮৮৭ সালে। হাল আমলে পশ্চিম দুনিয়া এগিয়ে আছে সবার চেয়ে। মুখের সৌন্দর্যে নাকের অবদান অনেকখানি। সুন্দর নাক পাল্টে দিতে পারে মুখের অবয়ব। নাকের সৌন্দর্য বাড়াতে কসমেটিক রাইনোপ্লাস্টি বিবর্তন ঘটিয়েছে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশেও এই চিকিৎসা করা হচ্ছে। নাকের নানা রকম ত্রুটি সারিয়ে তোলার মাধ্যমে রোগীর আত্মবিশ্বাস যেমন চাঙ্গা হচ্ছে, তেমনি সামাজিকভাবেও অনেকের অবস্থান হচ্ছে উন্নত। নাটকীয় পরিবর্তন ঘটছে চেহারায়।

অভিজ্ঞ প্লাস্টিক সার্জন দিয়ে অপারেশন করালে রাইনোপ্লাস্টি অপারেশনে তেমন কোনো জটিলতা হয়-ই না, সাফল্য প্রায় শতভাগ। নাকের অবস্থাভেদে অপারেশনও ভিন্ন। যদি তরুণাস্থিতে সমস্যা থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে কানের বা নাকেরই তরুণাস্থি ব্যবহার করে আকৃতি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। হাড়ে সমস্যা থাকলে গ্রাফটিংয়ের জন্য হাড় নেওয়া হয় শরীরের অন্য অংশ থেকে। যেমন মাথার খুলির বাইরের অংশ থেকে, হাতের বাহু বা বক্ষপিঞ্জর থেকে। ইদানীং কৃত্রিম ইমপ্লান্ট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটার মূল সুবিধা রোগীর শরীরের অন্য স্থান থেকে হাড় বা তরুণাস্থি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অন্য প্রাণীর তরুণাস্থিও অনেক সময় ব্যবহার করা হয়।

কেস রিপোর্ট

শিমুল দেখতে বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু বছর তিনেক আগে এক অপারেশনের পর তার নাকের চেহারাই পাল্টে যায়। স্বভাবতই হারিয়ে যায় মুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। দুর্ঘটনার পর অপারেশন না করেও কোনো গতি ছিল না। তারপর থেকে সে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে। পড়াশোনায় অমনোযোগী, কাজেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে একরাশ হতাশা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছিল। এমতাবস্থায় তাকে নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন অভিভাবকেরা।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তার নাকের মাঝ বরাবর দেবে গেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অগমেন্টেশন রাইনোপ্লাস্টির মাধ্যমে তার নাককে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব। সে মতে অপারেশনও করা হয়। এই অপারেশন করতে রোগীকে পুরো অজ্ঞান করতে হয়। অজ্ঞান করার পর রোগীর কানের পেছন থেকে আবরণসহ তরুণাস্থি (কার্টিলেজ) পরিমাণমতো কেটে আনা হয়। এরপর কানের ওই কাটা অংশকে এমনভাবে কসমেটিক সেলাই দেওয়া হয়, যাতে স্বাভাবিক অবস্থায় কাটা দাগ বোঝা না যায় বা বাইরে থেকে দেখা না যায়। ওই স্থানে রক্ত জমে ‘হেমাটোমা’ যাতে না হয়, তার জন্য দেওয়া হয় হালকা কমপ্রেশন বেন্ডেজ।

এবার ওই তরুণাস্থিকে প্রয়োজনমতো আকার দেওয়া হয় এবং নাকের দেবে যাওয়া অংশে স্থাপন করা হয়। কানের তরুণাস্থিটি  এমনভাবে স্থাপন করা হয়, যাতে নাকের দেবে যাওয়া অংশ ওপরে উঠে আসে এবং নাকের স্বাভাবিকত্ব ফিরে আসে। পাশাপাশি এ-ও খেয়াল রাখা হয়, রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে যেন কোনো সমস্যা না হয়। এই অপারেশন করা হয় নাকের সামনের অংশকে তুলে নিয়ে, যাকে প্লাস্টিক সার্জনরা ওপেন রাইনোপ্লাস্টি বলে থাকে। এবার চিকন সুতা দিয়ে এমনভাবে সেলাই করা হয়, যাতে নতুন স্থাপিত তরুণাস্থিটি জায়গা হতে সরে না যায়। অপারেশন চলাকালীন রক্তক্ষরণ কম হওয়ার জন্য এড্রেনালিন সলিউশন ব্যবহার করা হয়। অপারেশন শেষে ছোট্ট একটা বেন্ডেজ নাকের ওপর দেওয়া হয়, যা রাখতে হয় ৫-৭ দিন। নির্ধারিত দিনের পর বেন্ডেজ খুলে ফেলা হয়। হাসি ফোটে শিমুলের মুখে। বিষণœভাব কাটিয়ে উঠে সে স্বপ্ন দেখে সোনালি ভবিষ্যতের।

যেহেতু বাইরে থেকে কেটে অপারেশন করা হয়নি, দেখে বোঝারই উপায় নেই যে এখানে অপারেশন করা হয়েছিল। রাইনোপ্লাস্টি অপারেশন দুভাবে করা যায় ওপেন ও ক্লোজ। বেশির ভাগ অপারেশন ওপেন পদ্ধতিতে করা হয়। শিমুলের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। এতে সুবিধা বেশি। অপারেশন করতে জায়গা পাওয়া যায় বেশি, অপারেশনও হয় নিখঁত। সাধারণত ছোট অপারেশনের ক্ষেত্রে ক্লোজ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ তো গেল অগমেন্টেশন রাইনোপ্লাস্টি। রিডাকশন রাইনোপ্লাস্টিতে বড় নাককে এমনভাবে আকার দেওয়া হয়, যাতে চমৎকারভাবে চেহারার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে নাকের উপরিভাগকে ছেঁটে ছোট করা হয়। দুপাশের হাড়ও কিছুটা চাপাতে হয়। প্রান্তকে করা হয় সরু।

কিছু ক্ষেত্রে নাক উঁচু থাকলে ঘষে সমান করে স্বাভাবিক আকার দেওয়া হয়। অনেকের নাকের প্রান্ত মাঝখানে গর্তের মতো থাকে (বাইফিড টিপ), বাঁকা থাকে বা ঝুলে থাকে। এসব সমস্যা সমাধানে টিপ রাইনোপ্লাস্টি কার্যকর। মাঝখানে গর্তের মতো থাকলে দুপাশের তরুণাস্থিকে চাপিয়ে মাঝে সেলাই দেওয়া হয়। এমন সুতা দিয়ে সেলাই দেওয়া হয়, যা অপারেশন-পরবর্তী সময়ে বোঝাই যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তরুণাস্থির অংশ বা কৃত্রিম ইমপ্লান্ট তরুণাস্থির মাঝে বসানো হয়। সব অপারেশনের মতো এই অপারেশনেও কিছু জটিলতা হতে পারে।

যেমন প্রতিস্থাপিত তরুণাস্থি বা ইমপ্লান্ট জায়গা থেকে সরে যাওয়া, ইনফেকশন এবং হেমাটোমা (রক্ত জমে যাওয়া)। অভিজ্ঞ হাতে অপারেশন করালে এসব সমস্যা হয় না। এই অপারেশন বিদেশের তুলনায় অনেক কম খরচেই আমাদের দেশে সম্ভব। অতএব, নাকের সমস্যা নিয়ে অহেতুক ঘাবড়াবেন না। মন খারাপ করে বসে থাকারও কোনো যুক্তি নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। এই অপারেশনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। নিকটস্থ অভিজ্ঞ প্লাস্টিক সার্জনের পরামর্শ নিন। তিনিই বলে দেবেন সমাধানের পথ।


অধ্যাপক ডা. সাঈদ আহমেদ সিদ্দিকী

এফসিপিএস (সার্জারি), এফআরসিএস (গ্লাসগো)

এফআইসিএস (ইউএসএ), এফএসিএস (ইউএসএ)

প্লাস্টিক সার্জন

কসমেটিক সার্জারি সেন্টার লিমিটেড