শরৎ শোভায় পদ্মা সেতু

উদয় হাকিম
শরতের পরতে পরতে শোভা। এত শোভা শরৎ কেমনে ধরে! ঋতুরাজ বসন্ত। আর শরৎকে বলা হয় রানি। কে না জানি, রাজার চেয়ে বেশি সুন্দর রানি! রাজা-রানির বিতর্ক থাক। আসল কথায় আসা যাক। যাব খুলনা। ঠিক হলো মাওয়া হয়ে যাব। পদ্মা সেতুর শেষ অবস্থা দেখব। ভালো লাগলে লিখব। পরে বুঝলাম সিদ্ধান্তটা ভুল না।

রওনা হয়েছি সকালে। কাছেই হয়তো মাওয়া। শরীর জুড়িয়ে দেয় খোলা মাঠের হাওয়া। এখানে-সেখানে কাশফুল। কোথাওবা অল্প জলে অগোছালো জলজ সৌন্দর্য, চিংড়ি মাছের আখড়া। ধনচে। মিঠা পানির কড়া সুবাস! ঢেউয়ে দুলছে পানা ফুল, কলমি ফুল। নীল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা। অনিন্দ্য প্রকৃতিকে মনে হচ্ছে যেন প্রভাত সিনান শেষে নীল শাড়িতে নববধূ।
এমন স্নিগ্ধ সকালে পদ্মা দর্শন সত্যিই বড় উপহার। বিশেষ করে আমার মতো আবেগকাতুরে যারা।

পদ্মার প্রায় এক কিলোমিটার আগে থেকেই চলছে সেতুর কাজ। সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজাসহ অন্যান্য স্থাপনার নির্মাণ এগোচ্ছে। প্রস্তুতি চলছে মূল কাঠামো নির্মাণের। নর্থ পোলে চলছে স্প্যান তৈরির মহাযজ্ঞ। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার এই জায়গাটার নামও ভারি সুন্দর। চন্দ্রের বাড়ি! স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখানে হবে; সেটা যেন আগেই নির্ধারণ করে জায়গাটার নামকরণ!

ফেরিতে উঠেছি। চলতে শুরু করেছে। সঙ্গে মিল্টন আহমেদ, আমার সহকর্মী। স্টিল ক্যামেরা এরই মধ্যে ভালোই রপ্ত করেছেন তিনি। বলেছি উত্তর পাড়ের কাজগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে। যেখান থেকে জল ছোঁবে পদ্মা সেতু। ফেরিঘাট থেকে জায়গাটা অনেকটা দূরে। ভালো দেখা যাচ্ছে না। আমার মতো ফেরির অন্য যাত্রীরাও তাকিয়ে। একটাই হেতু দেখছেন, যেখান থেকে শুরু হবে সেতু।
উত্তরাংশে প্রস্থে পদ্মার মূল স্্েরাত কিলোখানেক। প্রবল স্রোত, জলের টানে এখনো বলক উঠছে ঘোলা পানিতে। এর পরই একটা চর, যার বুকজুড়ে কেবল ধবধবে কাশ ফুল। মাঝখানে মাথা উঁচু করে সবে দাঁড়িয়েছে পদ্মার পিলার। দৃশ্যমান স্প্যান। মিল্টনকে বুঝিয়ে দিই ছবিটা কীভাবে নিতে হবে। প্রিভিউ বলছে পারফেক্ট। সাদা ফুলের ওপর দিয়ে লালরঙা মুকুট পরা সরঞ্জাম। তার মাঝে পদ্মা সেতুর পিলার। মনে হচ্ছে স্বপ্ন, থ্রিলার!

একটু এগোতেই আরও বিস্ময়! লাইন ধরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিশাল বিশাল ক্রেন! নদীর বুকে মহাযজ্ঞ! অসংখ্য ভাসমান ইঞ্জিনিয়ারিং বাড়িঘর। চলছে পিলার বসানোর কাজ। চারদিকে সাজ সাজ।

চোখ ফেরাতেই দৃষ্টি কাড়ে পদ্মার বুক। চরাচর ছেয়ে আছে কাশ ফুলে। যেন চারদিকে সাদা বরফের চাদর। মাঝে মাঝে বাউরি বাতাস করছে তাকে আদর। পাখপাখালির কিচিরমিচির। মন টানে কেবল। প্রিয় কারও জন্য মন পোড়ে। কোথাওবা ঝিকিমিকি বালু। যেন বন আছে, নেই বনমালি। মনে পড়ে মমতাজের একটি গান ‘পদ্মা নদীর মাঝখানেতে জাগছে একটা নতুন চর/ সেই চরেতে বাস করিব আমরা দুইজন জনমভর’।

কয়েকজন মাঝি নৌকা ভিড়িয়েছেন চরে। জিরিয়ে নিচ্ছেন, বিড়ি টানছেন। আবার হয়তো উজান বাইতে হবে। ডিঙি নিয়ে এক মাঝি কাশবাগানের নিচে, রোদের হাত থেকে রক্ষা পেতে। পরের চরে কাশ ফুলের ভিড়ে একটি বড় গাছ। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। মন বলে, অদৃশ্য কোনো দূরদেশি ওই গাছের নিচে বসে আছে কারও অপেক্ষায়। সবে ভাবতে গিয়ে আবার চোখ পড়ে সেতুর কাজে। পদ্মার সৌন্দর্য প্রতিটি ভাঁজে!

বেশ কয়েক বছর ধরেই একটা বিষয় উপভোগ করি ভারি। পদ্মার চরে অসংখ্য ঘরবাড়ি। কেবল ভাবি, বিচ্ছিন্ন এমন চরে কীভাবে মানুষ থাকে! বিপদ যেখানে সময়ের বাঁকে বাঁকে। অসংখ্য দোতলা ঘর। সবই টিনের। ছোট-বড় নারী-পুরুষ অনেকেই গোসল করছে। কেউবা মাছ ধরছে। ট্রলার যাচ্ছে দূরে কোথাও। সহসা ঢেউয়ে কাঁপাচ্ছে স্পিডবোট। জীবন তো এমনই। চড়াই-উতরাই কেবলই।

কত বছর পর আমন ধানের ক্ষেত দেখছি, মনে নেই। এমন জলে ডোবা আমন, মন করে দেয় উন্মন। তার মাঝখানে পানা ফুল। মন ভাঙছে, হুলুস্থুল!!

পদ্মার উত্তর পাড়ে মুন্সিগঞ্জ। দক্ষিণে মাদারীপুর। কাঠালতলী পার হচ্ছি। যাব কেওড়াকান্দি ঘাটে। চলছি সোজা পশ্চিমে। সূর্য ততক্ষণে কপালে! জলে তখন অন্য রকম আলো। সূর্যের তির্যক রশ্মি খেলছে ঢেউয়ে। সোনালি রোদে ঝিলমিল করছে পদ্মার বুক। ঝলসে দিচ্ছে জল, হৃদয় টলমল।

আবার শরণাপন্ন হই মিল্টনের। বুঝিয়ে দিই কী চাই। একশ তে একশ। অসাধারণ কিছু ছবি ফ্রেমবন্দী হয় মিল্টনের ক্যামেরায়। মনের ক্যামেরায় গেঁথে রাখি আমি। যার সঙ্গে তুলনা করলে আসল ছবিও ডামি!

ঘাটে প্রায় এসে গেছি। বা পাশে নদীর পাড়জুড়ে দীর্ঘ পাহাড়ের মতো। কী এগুলো? পাথর। পদ্মা সেতুর কাজের জন্য অগুনতি পাথর, স্তূপ করে রাখা। এত পাথর লাগবে পদ্মা সেতুতে! স্বপ্ন বড় যত, তার রসদও তত।

ওপারে নেমে সুন্দর সড়ক ধরে যাচ্ছি। কেবলই মন চলে যাচ্ছে পদ্মায়। মনে পড়ছে শ্রীকান্তের কণ্ঠ ‘এই যে এলাম শঙ্খ নদীর তীরে/ হয়তো গো আর আসব না/ তাই বলে কি তোমায় ভালোবাসব না’।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৯ এপ্রিল ২০১৭