মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ

শিল্পমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার

নিয়াজ মোর্শেদ এলিট: বাংলাদেশ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে- এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। পাশাপাশি এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা ব্যবসায়ীরা এটাকে বিশাল সম্ভাবনা হিসেবে দেখছি। একটা দেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হয়, তখন সে দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। এটা হলে ব্যবসায়ীদেরও পণ্যের বেচা কেনা বেড়ে যায়। মানুষের যখন মৌলিক চাহিদাগুলো মিটে যায় তখন সে অন্য বিলাসী পণ্যের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

আমরা তখনই মধ্যম আয়ের দেশে যাবো, যখন আমাদের বেশিরভাগ মানুষ ৫টি মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে পারবে। পাশাপাশি মানুষের আরো কিছু চাহিদা আছে। সেগুলো মেটাতে হবে। আমাদের মানুষের এখন সে সক্ষমতা হয়েছে।

এখন আমাদের চ্যালেঞ্জের অনেক বিয়য় আছে। আমাদের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী আছে, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০। এদের সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশি। মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হওয়ার সাথে সাথে এই জনগোষ্ঠীকে আমরা যদি কারিগরি শিক্ষা এবং বাস্তবধর্মী শিক্ষা দিতে না পারি তাহলে কিন্তু আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবে না। সামনের দিকে আমরা ডেভেলপ কান্ট্রির দিকে যেতে পারবো না। কারণ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পরে যে স্তর সেটা হলো উন্নত দেশে পরিনত হওয়া। সেখানে গ্যাপটা অনেক বেশি। সেইখানে প্রত্যেকটা মানুষকে এফোর্ট দিতে হবে। অর্থনীতিতে আমাদের অবদান কি তা জানতে হবে।

আমাদের এই জনগোষ্ঠীকে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে সে ব্যাপারে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই। ধরুন আমাদের যদি ১০ লাখ লোক দেশের বাইরে থাকে। আর তারা যদি বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠায়। সেতুলনায় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মাত্র ৫ হাজার লোক বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। যদি বলেন কিভাবে, তার উত্তর অনেকটা এ রকম, প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরে, বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে সব টেকনিশিয়ান বাইরের দেশের লোক। আমাদের কোন ভালো টেকনিশিয়ান নেই।

গার্মেন্টেসের মার্চেন্ডাইজার, প্রডাকশন ম্যানেজার থেকে থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা টেকনিক্যাল পারসন বিদেশী। তাদের আনতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। তাদের একেক জনের বেতন কম হলেও ৫ লাখ টাকা। এই ৫ লাখ টাকা আমরা কতজন মিলে বিদেশ থেকে আনতে পারছি। ৫০ জন বা তার চেয়েও বেশি। সুতরাং আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠী শুধু পুঁথিগত বিদ্যার দিকে ঝুকছি। আমরা এমবিএ পড়ছি, বিবিএ পড়ছি, ল পড়ছি, মিডিয়া পড়ছি, ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ছি। কিন্তু আমাদের জাতিকে যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিবে, ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করাতে যে জনশক্তি লাগবে তা তৈরি হচ্ছেনা।

কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি, তাই সরকারকে উদ্যোগ নিয়েই বিশ^ মানের কিছু কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে।

এজন্য বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট একটা বিপ্লব হয়েছে, কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় আমরা সেই বিপ্লবটা আনতে পারিনি। আমাদের কারিগরি শিক্ষায় আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তাই শুধু মাত্র অবকাঠামোগত উন্নত হলেই যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো তা নয়, এই অবকাঠামো যারা ব্যবহার করবে সেই জনগণকে সেই মানের করে তৈরি করে নিতে হবে। সুতরাং এটাকেই আমি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। এখনো আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীকে কারিগরি শিক্ষা এবং ওয়েল এডুকেটেড করতে পারছিনা।

বিশ্বমানের কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের ৫ বছর থেকে ১০ বছরের জন্য বিদেশ থেকে ভালো ভালো প্রশিক্ষক নিয়ে আসতে হবে। একজন প্রশিক্ষক যদি ৫ লাখ টাকা বা ৩ লাখ টাকা বেতন নেয় সেটাও ভালো। কারণ তিনি আমাদের ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতে পারবে। একটা সময় আমাদের এই ছেলেগুলোই ইন্ডাস্ট্রিতে যাবে। তারা একটা পর্যায় শিক্ষা ব্যবস্থায় আসবে। সুতরাং আমাদেরকে আগে বিদেশ থেকে কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ শিক্ষক আনতে হবে। পাশাপাশি যে সকল শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা নিবে তাদেরকে দেশ এবং বিদেশের চাকরিটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবে এখন শিল্পের যে অবস্থা, তাতে সরকারকে তেমন কিছু না করলেও চলবে। কারণ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের খুবই অভাব আপনি যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হন তাহলে আপনাকে লুফে নিবে। সুতরাং কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার জন্য এই সময়টা খুবই উপযুক্ত।


কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষতদের চাকরির বাজার এখন রমরমা। আমাদের উচিত সরকারের স্পেশালাইজড কারিগরি শিক্ষার জন্য স্কুল করা বা বিশ্ববিদ্যালয় করা। সেই ইউনিভার্সিটিতে বিদেশ থেকে ম্যান পাওয়ার এনে ট্রেইনআপের ব্যবস্থা করা। টিচারগুলো বিদেশ থেকে আনতে হবে। যাদের নলেজগুলো আমরা শেয়ার করতে পারবো। নলেজ শেয়ারের একটা কস্ট আছে। সেই কস্টটা যদি আমরা একজনকে দিই তাহলে আমরা ১০০ জনকে শেখাতে পারবো এবং ২০-৩০ বছর পরে আমরা সমৃদ্ধ হতে পারবো। তখন বলতে পারবো কারিগরি শিক্ষায় আমাদের ছেলে মেয়েরা অনেক দক্ষ। পাশাপাশি নতুন নতুন যে টেকনোলজিগুলো আসছে সেই রিলেটেড লোকগুলোকে আমরা নিয়ে আসবো। তারা আবার আমাদের ছেলে-মেয়েদের শেখাবে। তাহলে ২০,৩০ বা ৫০ বছরে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হবো।

আমাদের বেশিরভাগ যুবকদের প্লান থাকে ব্যবসা করা। কেউ চাকরির দিকে যেতে চায় না। নিরুপায় হয়ে চাকরির দিকে যায়। যুবকরা যখন ব্যবসা করতে যায় তখন তারা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে। তাদের অভিজ্ঞতা থাকে না। তাদের মুলধন থাকে না। আবার অভিজ্ঞতা থাকার পরও যদি ব্যাংকে ফান্ডের জন্য যায় বা লোন নিতে যায়, মর্টগেজ দেওয়ার পরও ব্যাংক তাকে লোন দিতে চায় না। ব্যাংক বলে আপনার অভিজ্ঞতা নাই। যে কারণে আমাদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। তবে ইদানিং আইসিটি ডেভেলপমেন্টের কারণে কিছু ছোট ছোট এন্টারপ্রেইনার তৈরি হয়েছে। যেখানে ইনভেস্টমেন্ট খুবই কম। কিন্তু অন্য সেক্টরগুলোতে যুবকদের পদচারণা অনেক কম। যেখানে ইনভেস্টমেন্টের বিষয়টা আসে সেখানে সরকারের ইনভেস্টমেন্ট পলিসিটা নারীদের জন্য যেভাবে করা হয়েছে, যেভাবে লোন দেওয়া হচ্ছে, যুবকদের জন্য সেভাবে লোন দেওয়া হচ্ছেনা। এখনে যুবকদের জন্য লোন পলিসিটা অন্য রকম। আমরা জুনিয়র চেম্বার থেকে একটা প্রস্তাবনা দিয়েছি, সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে। সেখানে আমরা বলেছি, আপাতত একটা থোক বরাদ্দ দিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটের একটা লোন করা হোক। হোক ৫০ কোটি, হোক ১০০ কোটি। জিনিসটা শুরু করা জরুরী। কিছু যুবককে এন্টারপ্রেইনারশীপের দিকে যদি আমরা প্রমোট করতে পারি তাহলে আমাদের জন্য নতুন কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া ২০২১ এবং ২০৪১ পর্যন্ত আমাদের যে টার্গেট সেই টার্গেটের সাথে যুবকরা যুক্ত হতে পারবে।

একজন যুবকের এন্টারপ্রেইনার হওয়ার জন্য মিনিমাম ফান্ড কেমন হওয়া উচিত তা ব্যবসার ধরনের উপর নির্ভর করে। কেউ যদি একটা কফি শপ দিতে চায় তার জন্য এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট দরকার, কেউ যদি ফ্যাক্টরি করতে চায়, তার জন্য এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট দরকার। একজন যুবক যে বিষয়ের উপর আগ্রহী বা লেখাপড়া করেছে, সে বিষয়ে ইনভেস্টের জন্য প্রতি পদে পদে সে বাঁধাগ্রস্ত হয়। আমরা ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরগুলো থেকে সে ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছি না। এমন কি আমি নিজেও পাই নাই।

আমি যখন ব্যবসা শুরু করি তখন ব্যাংক ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনার লোন কতো আছে। আমি বললাম কেনো? তিনি বললেন আপনার যতো বেশি লোন আছে আমি আপনাকে ততো বেশি লোন দেবো। আমি বললাম আমারতো লোন নাই। তিনি বললেন, তাহলে আপনাকে লোন দেওয়া যাবে না। এখন আমাদের মাইন্ড সেটটা হয়ে গেছে কি, যার যতো বেশি লোন তার ততো বেশি লোন দেবো।

যার কারণে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে একটা ক্রাইসিস যাচ্ছে। ফলে তরুণরা এন্টারপ্রেইনারশীপের দিকে সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না।

ব্যাংক এন্টারপ্রেইনারশীপ তৈরি করে কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। সরকারি পলিসি ছাড়া এটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে একটা নির্দেশনা দেবে যে, এতো থেকে এতো বয়সের ছেলে মেয়েদের ফাইন্যান্স করতে হবে। তখন দেখবেন, অনেক যুবক এন্টারপ্রেইনারশীপের দিকে অনেক আগ্রহী হচ্ছে এবং ব্যবসায় জড়িয়ে যাবে। তখন সেটা দেশের জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি করবে।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যুবকদের সার্ভিস এবং আইটি সেক্টরে নজর দেয়া উচিত। যেহেতু ইনভেস্টমেন্টের একটা ব্যাপার আছে। আর এই সেক্টরে কম ইনভেস্টমেন্ট হলেও এন্টারপ্রেইনারশীপ হওয়ার সুযোগ আছে। সার্ভিস সেক্টর যেমন পাঠাও, উবার এবং অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসা। অনলাইনে খাবার পৌঁছে দেয়া, লন্ড্রির কাপড় পৌঁছে দেয়া-এই সার্ভিসগুলো যা আমাদের জীবনকে সহজ করছে। এই সার্ভিস সেক্টরে লিড দিচ্ছে যুবকরাই এবং তাদের জন্য এটা আরো বিশাল সম্ভাবনার। ইন্টারনেটের ব্যবহার যতো বাড়ছে, ব্যবসার সুযোগও ততো বেশি বাড়ছে।

নিয়াজ মোর্শেদ এলিট
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বড়তাকিয়া গ্রুপ।
এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(জেসিআই)