শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে কেনাকাটায় হরিলুট, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু

ষোলগুণ দামে ওজন মাপার যন্ত্র, সাড়ে তিনগুণ দামে ল্যাপটপ আর দ্বিগুণ দামে আসবাবপত্র ও বই কেনার মতো বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটায় হরিলুট চালিয়েছে হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। সাড়ে ১৫ কোটি টাকার এ কেনাকাটায় দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি।

তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আজম খান বৃহস্পতিবার সকালে কলেজে সরেজমিন তদন্তে নামেন। তিনি ২০১৭-১৮ সালে দরপত্রের মাধ্যমে কেনা যন্ত্রপাতি ও উপকরণ পরিদর্শন এবং প্রতিটি জিনিসের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেন। সেই সাথে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ডা. নাসিমা খানমসহ কেনাকাটার সাথে যুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

এ সময় হবিগঞ্জের সহকারী কমিশনার ইয়াসিন আরাফাত রানাসহ পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পরে আজম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি যেহেতু তদন্তাধীন, তাই এ মুহূর্তে কিছু বলা উচিত হবে না।’

তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

গত ২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়।

এদিকে, গত মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হবিগঞ্জ কার্যালয়ের একটি দল কলেজ ক্যাম্পাসে এসে তদন্ত চালায়। তারা ক্রয় করা জিনিসের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তুলেন। তবে এ সময় অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান কলেজে ছিলেন না।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ দুদকের সহকারী পরিচালক মো. এরশাদ মিয়া বলেন, ‘প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসেছি। পরবর্তীতে দুর্নীতির প্রমাণ ও কমিশনের অনুমতি পাওয়া গেলে বিস্তারিত তদন্ত করা হবে।’

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার কেনাকাটা করে। এতে বইপত্র ও সাময়িকীর জন্য সাড়ে ৪ কোটি, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের জন্য ৫ কোটি, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশের জন্য দেড় কোটি, আসবাবপত্রের জন্য ১ কোটি এবং এমএসআরের (মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিকেল রিকোয়ারমেন্ট) জন্য ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।

কলেজে ঠিকাদারদের সরবরাহ করা মালামালের মূল্য আর বাজার দর বিশ্লেষণ করে হরিলুটের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এতে দেখা যায়, ঢাকার শ্যামলীর বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ঠিকাদার ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ সবচেয়ে বেশি মালামাল সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বইপত্র, যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, আসবাবপত্র, মেডিকেল ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী সরবরাহ করে বিল নিয়েছে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৯ টাকা।

তাদের সরবরাহ করা বিভিন্ন মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০, কোর আই ফাইভ, সিক্স জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয়েছে ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতিটির দাম পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেডের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে এ মডেলের ল্যাপটপের দাম ৪২ হাজার টাকা।

বাজারে ৬০ হাজার টাকায় পাওয়া যাওয়া এইচপি কালার প্রিন্টারের (মডেল জেড প্রো এম৪৫২এনডব্লিউ) দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯০০ টাকা।

সম্মেলন কক্ষে ৫০ জনের বসার জন্য এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও টেবিল এবং সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলোতে কোনো প্রতিষ্ঠানের চিহ্ন নেই। তবে, আসবাবপত্রের প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব চেয়ারের মূল্য যা ধরা হয়েছে তার অর্ধেকের চেয়েও কম।

এছাড়া, বিলের তালিকায় ৬ নম্বরে আবারও কনফারেন্স সিস্টেম নামে ৫০ জনের জন্য ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে।

অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের জন্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরার জন্য ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেটের জন্য ৪ লাখ ২২ হাজার ও ২৫টি স্টিলের র‌্যাকের জন্য ১৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিল দেয়া হয়েছে।

এ প্রতিষ্ঠানটি ৬,৪৭৫টি বইয়ের জন্য ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা এবং মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিকের মডেলের জন্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা নিয়েছে।

দেশের বাজারে ‘পেডিয়াট্রিক সার্জারি (২ ভলিয়মের সেট) বইয়ের দাম ৩৩ হাজার টাকা। নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫৫০ টাকা।

রাজধানীর মতিঝিলের মঞ্জরী ভবনের আরেক ঠিকাদার ‘পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকোলার মাইক্রোস্কোপের মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩২৫ টাকা। বাজারে এর মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা।

জেনারেল কোম্পানির শোরুমে যে মডেলের ২ টন এসির দাম ৯৮ হাজার টাকা তা পুনম ইন্টারন্যাশনাল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টি সরবরাহ করে মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

ওয়ালটনের যে মডেলের রেফ্রিজারেটর ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা তার জন্য মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি রেফ্রিজারেটর কেনা হয়েছে।

ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাম নেয়া হয়েছে। কিন্তু একটি বেসরকারি হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে কর্মরত পবিত্র দেবনাথ জানান, এমন যন্ত্রের দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

এছাড়া, ওয়ালটন ও সনি কোম্পানির ৬টি টিভির মূল্যও নেয়া হয়েছে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি। আর যেসব বই সরবরাহ করা হয়েছে তার মধ্যে ঢাকার নীলক্ষেতের নকল বইও থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।খবর ইউএনবি।

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান