সঠিকভাবে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট বাস্তাবায়ন হলে আস্থা ফিরবে পুঁজিবাজারে

‘পুঁজিবাজার কোন দিকে যাচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, দেশের পুঁজিবাজার ভালো যাচেছ, এই ভালো যাওয়ার একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ইকোনমি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছে। ২০১০ সালের পর থেকে যদি দেখেন, মার্কেট ধসের পর আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল তাও এখন স্থিতিশীল। আমাদের রেমিট্যান্স গ্রোথ, ম্যানুফ্যাকচারিং গ্রোথ, ইনকাম গ্রোথ, জিডিপি গ্রোথ এগুলোর সবগুলোই কিন্ত একটা ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে’। এমন অভিমত দিয়েছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিবাজার বিশ্লেষক, আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: সাইফুদ্দীন। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবিটিভি‘র সঙ্গে আলাপচারিতায় তিঁনি এসব কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

পুঁজিবাজার কোন দিকে যাচ্ছে? দেশের পুঁজিবাজার ভালো যাচ্ছে, এই ভালো যাওয়ার একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ইকোনমি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছে। ২০১০ সালের পর থেকে যদি দেখেন, মার্কেট ধসের পর আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল তাও এখন স্থিতিশীল। আমাদের রেমিট্যান্স গ্রোথ, ম্যানুফ্যাকচারিং গ্রোথ, ইনকাম গ্রোথ, জিডিপি গ্রোথ এগুলোর সবগুলোই কিন্তু একটা ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর সুদের হার অনেকটাই কমে আসছে। যা ডাবল ডিজিটের বেশ উপরে ছিল ১২-১৪ এর মতো, তা নেমে এসেছে ৫-৬ শতাংশে। তো এই প্রেক্ষাপট থেকেই মার্কেট এখন ইনভেস্টমেন্ট উপযোগী হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। এই প্রেক্ষাপটটা মনে রাখতে হবে। অন্যদিকে ছয় বছরের উপরে মার্কেট ডিপ্রেস থাকার কারণে, বায়ার না থাকায় রিনিয়োগকারীরা হতাশার মধ্যে ছিল। এ কারণে স্বভাবতই মার্কেট নিন্মমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল। অনেক দিন স্টকমার্কেট এভাবেই চলেছে। পর্যাক্রমে মার্কেট কঠিন সময় পার করে একসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

এখন অনেক স্টকের ফান্ডামেন্টাল বা এর মধ্যে থেকে কিছু কিছু স্টক বাড়তে থাকে। প্রতিটা মার্কেটেই এই এলিমেন্ট বাই কারেক্টার এটা থাকবেই। এসব কারণেই কিছু মানুষের অপটিমিস্টিক অবস্থান থেকে সামনের দিকে যাওয়ার জায়গা আছে। অনেকেই মনে করে আমি অপটিমিস্টিক মানুষ। আসলে পুরো মার্কেটটাই একটা ফান্ডামেন্টাল প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসছে।

একাউন্টস ইনফরমেশনের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে
আমাদের কিছু মেজারম্যান্ট রয়েছে, ২০১০ সালের আগে মার্কেটের ক্যারেক্টার একরকম ছিল। এবং মার্কেটে কিছু সিনড্রম ছিল। এই লক্ষণগুলো সামনে আবারও আসতে পারে। আমি এই ব্যাপারটা ধারণা করতে পারি। এখন আমাদের পুরনো প্রেক্ষাপট যেন আবার না আসে কিংবা আসলেও যাতে সে অবস্থাকে প্রটেকশন দেয়া যায় তার প্র¯ুÍতি নিতে হবে। আসলে যারা ইনভেস্টর কিংবা আমরা যারা আছি, মিডিয়া বা পুঁজিবাজার বোদ্ধারা, অর্থনীতিবিদরা আছেন, যারা সবসময় বলেন যে আরো সচেতন হতে হবে। কিন্ত নির্দিষ্ট করে বলেন না ঠিক কোন জায়গায় সচেতন হতে হবে। কোন বিষয়ে সচেতন হতে বলছেন যদি তার পরিষ্কার ধারণা দিতেন তাহলে ভালো হতো। আসলে বাস্তবতা বিচারে যদি বলি তাহলে বলতে হয় যে, হঠাৎ করে অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছেন পুঁজিবাজার থেকে। আবার অনেকের অবস্থা এর বিপরীত। আর তাই পুঁজিবাজারের ট্রানজিশনটা, ইকোনোমিক ট্রান্সফরমেশনটা, একাউন্টিং ট্রান্সপারেন্সি গুরুত্বের সঙ্গে মনিটর করতে হবে। সরকারের সুদৃষ্টি থাকায় বাজারের মান উন্নত হয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ, পার্টিসিপেন্ট, স্টেক হোল্ডার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট পাশ করে নিয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভালো একটা দিক। আইনের সঠিক ব্যবহার করার সময় এসেছে । আমাদের বাজার বিশ্লেষকরা আগে অনেক বেশি সমস্যার মুখে পড়তেন। সে অবস্থা অবশ্য এখনও কিছুটা রয়েছে। একাউন্টস ইনফরমেশনর ধারাবাহিকতা নেই। আমরা যদি গভীরভাবে এনালাইসিস করতে যাই তাহলে বড় কোম্পানিগুলোর কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তারা লজ্জা বোধ করে তথ্য দিতে। এটা কিন্ত থাকা উচিত না । বড়রা লিস্টেড কোম্পানি আর লিস্টেড কোম্পানির গ্রাহকদের কিন্ত সঠিক তথ্য সময়ে সময়ে জানতে দিতে হবে। যেহেতু আগে কোন অ্যাক্ট ছিল না। এগুলো নিয়ে কোন এনফোর্স হতোনা। আগে যে আলোচনা শুরু হতো তা শেষ হতো না। মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। এই একাউন্টিং ট্রান্সপারেন্সি ইজ ভেরি ইমপর্টেন্ট। শুধু তাই নয়, এসব একাউন্টে যদি অনৈতিকভাবে সূচকের উঠানামা হয় বা কোনোরকম ম্যানুপুলেট হয় তাহলে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট প্রয়োগ করে তা বন্ধ করা উচিত। এর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সে ক্ষমতা রাখে। একটা অনিয়মের অভিযোগ আসলে শুধু অনুসন্ধান না করে কেন, কিভাবে ঘটনা ঘটলো তার বিস্তারিত তুলে আনা জরুরি। যারা অনিয়ম করছে তাদের সাবধান করে দিতে হবে। আমি মনে করি এই কাজগুলো এখনই শুরু করা দরকার এবং করতে হবে।

সর্বোপরি সবাইকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। অনেক কিছু বিবেচনা করে আমাদের বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্ত যারা সার্বিকভাবে ছোট ছোট বেইজে পুঁজিবাজারে আসে তারা কিন্ত সরাসরি মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত না। কারো যদি আয়ের কিছু অংশ বাড়তি থাকে বা টাকা অলস পড়ে আছে এমন ব্যাক্তি যদি এই মার্কেটে আসতে চায় তাহলে সে কিভাবে এই মার্কেটে আসবে। তাদের ইনভেস্টমেন্ট কিভাবে চ্যানেলাইজ হয়। এ ব্যাপারটা দেখার বিষয়। ধরেন আজ আমাদের যারা ব্রোকারেজে ট্রেড করে এর চাইতেও অনেক বড় বাজার রয়েছে যা এই শেয়ারমার্কেটে নিয়ে আসা উচিত। এই ইক্যুইটি মার্কেটের সব ধরনের সুবিধা তারা পাওয়ার অধিকার রাখে। এখন যেভাবে চ্যানেলাইজড হচ্ছে আমি মনে করি না যে এটা অপটিমাম। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ফান্ডের মাধ্যমে আসা উচিত। এরাই হচ্ছে মার্কেটের ভবিষ্যত । আর তাই তাদের ধারাবাহিক সচ্ছতার মাধ্যম মার্কেটে নিয়ে আসতে হবে।

বড় প্রতিষ্ঠানকে মার্কেটে আনা উচিত
আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশে যে বড় বড় ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপগুলো রয়েছে, ব্রান্ডগুলো আছে, তাদের এনকারেজ করে পুঁজিবাজারে আনা উচিত। তাদের কিছুটা ইনসেনটিভ দেয়া যেতে পারে। আমরা দেখেছি যে তারা অনেকগুলো মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে কোনমতে ‘না হলে না হয়’ এভাবে চালিয়েছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। শুধু মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর ট্রাস্টির যে রোল তা প্রপারলি সার্ভ হয় নি। তাহলে বলা যায় ওখানে কাজ করার অনেক কিছু আছে। ইনস্টিটিউটের জায়গাগুলোকে এমপাওয়ার করতে হবে, এই জায়গাগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে এবং তাদেরকে ক্ষমতায়ন করতে হবে।

একইভাবে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যারা ম্যানেজার তাদের একাউন্টেবিলিটির মধ্যে আনতে হবে। যে রেগুলেশনগুলো রয়েছে সেগুলোকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমরা সাধুবাদ জানাই সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে। তারা কিন্ত এ ব্যাপারে অনেক কাজ করছে। তাদের সাধ্যমতো তারা করেছে। এ কাজগুলো হচ্ছে। আমার মনে হয় যে এটাই সঠিক প্রক্রিয়া ‘চ্যানেলাইজিং দ্যা রিটেইল ফান্ড টু দা ইনস্টিটিউটালাইজ ইনভেস্টমেন্ট প্রসেস’। এ জায়গাগুলোতে আরো সচেতন হতে হবে। যত দিন যাবে ততই সচেতনতার মাত্রা আরো বাড়বে।

এখন আমাদের জিডিপির ৭০ ভাগই হচ্ছে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন। আমাদের পাশের দেশে ৩০ ভাগ, পাকিস্তানে ২৫ ভাগের মতো। সুতরাং এখানে ক্যাপিটাল মার্কেটে বড় হবার সুযোগ রয়েছে। এখানে বড় হওয়া মানে এই না যে ইনডেক্স বেড়ে যাওয়া। বড় হওয়া মানে ক্যাপিটাল সাইজ বড় হওয়া। বড় বড় ভালো কোম্পানিগুলোর মার্কেটে আসা। এই জায়গায় অনেক বড় বড় কোম্পানি আসছে। তবে আসলে কী হবে, ভালো কোম্পানিকে আসতে হবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে যুব সমাজের ১৫ থেকে ৬৫ ভাগ কর্মক্ষম। আর তাই যদি হয় তাহলে মোটা দাগে আমরা প্রাইমারি একটা ডিভিডেন্ট পাব। সুতরাং জনবল বাড়ার সাথে পার-ক্যাপিটা ইনকাম বাড়বে। তার সাথে সাথে আমাদের ইকোনোমিক গ্রোথ ৭ ভাগের বেশি হবে; যা সামনের দিকে আরো বাড়বে। আয় বাড়লে তাদের ব্যয়টাও সে অনুপাতে বাড়বে। এই ব্যয় যেসব সেক্টরে হিট করে তার মধ্যে কনজ্যুমারসেক্টর, ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর, হেলথ এডুকেশন অন্যতম। এভাবে কোয়লিটি কনজামশন হতে থাকে। এগুলো কিন্ত থ্রাস্ট সেক্টর। তাই বলছি ভালো ভালো কোম্পানিগুলো লিস্টেড হতে হবে। আমরা অপেক্ষায় আছি তাদের জন্য। তারা যত দ্রুত বাজারে পুঁজিবাজারে আসবে ততই বাজারের মঙ্গল।

ভালো কোম্পানিগুলো কেন বাজারে আসছে না?
আমরা যখন বড় কোম্পানিগুলোকে বলি আপনারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন বা আসুন। তখন কিন্ত তারা তাদের ট্যাক্স হিসাব করে। একই সাথে এটাও বিবেচনা করে স্ট্যান্ডার্ড মার্ক, ট্রান্সপারেন্সি ইত্যাদি থাকলে তারাই একাউন্টিবিলিটির জায়গা থেকে, তাদের প্রয়োজনেই তারা এই মার্কেটে আসতো। তবে মার্কেটের স্থিতির জন্য তাদের আজ না হয় কাল বাজারে আসতে হবে।

আর অন্যদিকে দেখলে একটা পুঁজিবাজারকে সচল ও স্থিরভাবে চলতে গেলে যে বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে
০১.একাউন্টেবিলিটি
০২.ডিসকোজার
০৩.ট্রান্সপারেন্সি
উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রয়োগ করতে হবে এবং তার জন্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন শক্ত হাতে এগুলোর প্রয়োগ করতে হবে। ঢাকা চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এসব ব্যাপার মনিটর ও প্রয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এ সেক্টর একটি জটিল জায়গা। ২০১০ এর পর আমরা দেখেছি কিভাবে ধস নেমেছিল। কতবড় ডিজাস্টার হয়েছিল পুঁজিবাজারে। এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। এখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যারা এই সেক্টরে আছি তারা কেউই এর বাইরে নেই। ধৈর্য ধরে সচেতনতার মাধ্যমে, বুঝে, দেখেশুনে চলতে পারলেই একজন বিনিয়োগকারী তার সফলতা পাবে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিতে হবে
নতুন বা পুরনো যারা বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী করতে হবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত যাদের আমরা ভবিষ্যত মনে করি তাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হলে হবে না। সেখানে যাতে নিয়ম মেনে বিনিয়োগ হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। ভালো ফান্ড ম্যানেজারদের উৎসাহী করতে হবে পুঁজিবাজারে আসার জন্য। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর ফান্ড ম্যানেজারদের একাউন্ট্যাবল করতে হবে। শক্তিশালি করতে হবে রেগুলেটেড ফান্ডামেন্টাল ইন্ডাস্ট্রিজগুলোকে। বড় বড় কোম্পানি যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো। তাদের উৎসাহিত করতে হবে। এই সব কোম্পানিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ে আসা দরকার। এসব যদি আমরা সঠিকভাবে মনিটর করতে পারি তাহলে পুঁজিবাজার তার আসল রূপে আসবে। এবং আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।

মো. সাইফুদ্দীন
ম্যানেজিং ডিরেক্টর
আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড