সম্পদ বিক্রি করবে না শেভরন, বাড়াবে বিনিয়োগ

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাড়ছে না যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরন। বাংলাদেশে থাকা সম্পদ বিক্রির যে পরিকল্পনা ছিল তা থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে কোম্পানিটি। বাংলাদেশে ব্যবসা বিক্রির ঘোষণা দেয়ার প্রায় এক বছর পর এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন। চীনের যে কোম্পানির কাছে ব্যবসা বিক্রির আলোচনা চলছিল, ওই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে সরকারের আপত্তির কারণেই মূলত শেভরনের এ সিদ্ধান্ত বদল বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গেলো রোববার শেভরনের এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের উপদেষ্টা ক্যামেরন ভ্যান আসটের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তিনটি ব্লকে থাকা সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার যে আলোচনা চলছিল, শেভরন তা আর এগিয়ে নেবে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, শেভরন বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার এবং পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে শেভরন কেন সরে এল, তার কোনো ব্যাখ্যা বিবৃতিতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বাংলাদেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা গত সপ্তাহে শেভরন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে জানিয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিবিয়ানা থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ১২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করছে শেভরন। সেখানে তারা আরও ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, পেট্রোবাংলা একাধিকবার শেভরনকে বলে আসছিল যে, ব্যবসা বিক্রি নিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি নিয়ে শেভরনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়। একটি বৈঠকে শেভরনকে জানানো হয়, তারা যে কোম্পানির কাছে ব্যবসা বিক্রি করতে চাইছে, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। মৌখিকভাবে এ ধরনের আপত্তি একাধিকবার জানানো হয়েছে। এভাবেই শেভরনকে সিদ্ধান্ত বদলে রাজি করানো গেছে।
নতুন বিনিয়োগ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য না করলেও বাংলাদেশে গ্যাসক্ষেত্রের সম্পদ বিক্রির চুক্তি থেকে সরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে শেভরন। প্রতিষ্ঠানটির কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বলেন, শেভরন নিশ্চিত করছে যে, হিমালয় এনার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা বিক্রির চুক্তি নিয়ে এগোবে না শেভরন গ্লোবাল ভেনচার্স লি.। শেভরন সম্পদ ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহে কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
গত এপ্রিলে শেভরন জানায়, ওই তিন গ্যাসক্ষেত্রের প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ও বাংলাদেশের যাবতীয় ব্যবসা চীনের কনসোর্টিয়াম হিমালয় এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দিতে সমঝোতায় পৌঁছেছে তারা। হিমালয় এনার্জি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঝেনহুয়া অয়েল ও হংকং ভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সিএনআইসি কর্পোরেশনের একটি কনসোর্টিয়াম।
কিছু দিন আগে রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে থাকা শেভরনের সম্পদ ২০০ কোটি ডলারে কেনার বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে সই করেছে শেভরন ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঝেনহুয়া অয়েল। তখন ঝেনহুয়া অয়েল এর দুই জন নির্বাহী কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরটি প্রচার করে রয়টার্স। হিমালয়ের সঙ্গে শেভরন গ্লোবাল ভেনচার্স একটি বিক্রি চুক্তিতে এসেছে। চুক্তি অনুযায়ী হিমালয় এনার্জি কোম্পানি লিমিটেডের কাছে বিক্রি হবে শেভরন গ্লোবাল ভেনচার্সের বাংলাদেশী সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। শর্তপূরণ সন্তোষজনক হলে এ সংক্রান্ত লেনদেন সম্পন্ন হবে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সম্পদও বিক্রি করা হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট তিনটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্বে আছে শেভরন। সম্মিলিতভাবে এ তিনটি ব্লকে এক বছরের ব্যবধানে শেভরনের বিনিয়োগ (মূলধনী ও পরিচালন) কমেছে ১৯ শতাংশ। এ তিন ব্লকে ২০১৪ সালে শেভরনের মোট মূলধনী ও পরিচালন ব্যয় ছিল ৪১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলারে। আর ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এ হিসাবে দুই বছরে বাংলাদেশে শেভরনের বিনিয়োগ কমেছে ২২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার।
পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশে শেভরনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ রয়েছে ১২ নং ব্লক বা বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে। ২০১৩ সালে এ ব্লকে মূলধনি ও পরিচালন ব্যয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির মোট বিনিয়োগ ছিল ৪১ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। ২০১৪ সালে সেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৫ কোটি ৯২ লাখ ডলারে। ২০১৫ সালে এ বিনিয়োগ আরো কমে ২৩ কোটি ৩২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এ হিসাবে শুধু বিবিয়ানাতেই দুই বছরে শেভরনের বিনিয়োগ কমেছে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
এদিকে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে বিনিয়োগ কমলেও মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে মূলধনি ও পরিচালন ব্যয় বেড়েছে শেভরনের। যদিও বাংলাদেশে শেভরনের মোট বিনিয়োগের তুলনায় এ দুই গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। ২০১৫ সাল শেষে মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির মূলধনি ও পরিচালন ব্যয় ছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। একই সময়ে জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয় করে শেভরন।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত শেভরনের সবগুলো ব্লকের প্লান্ট ও প্রধান কার্যালয়সহ কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার। এরা সবাই অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক পন্থায় বাংলাদেশ কার্যালয়ের মাধ্যমে শেভরনের হয়ে গ্যাস উত্তোলন কাজে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু শেভরন চুক্তিভিত্তিক কর্মীর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করায় এখন এ ধরনের কর্মী ২০ শতাংশ কমে ৮০০ জনের নিচে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি কাজাখস্তানে প্রকল্প সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শেভরন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায়।
২০১৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দেড় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ফলে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে তারল্য সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সংকট নিরসনে বাংলাদেশসহ কিছু দেশের ব্যবসা বিক্রির পরিকল্পনা করে শেভরন।
আজকের বাজার: সালি / ০১ অক্টোবর ২০১৭