সম্ভাবনার ‘ব্লু ইকোনোমি’ ঘিরে নতুন আশা

নাজমুল লিখন: ব্লু ইকোনোমি বা সমুদ্র সম্পদ নির্ভর নীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। নীল পানির নিচে লুকিয়ে থাকা সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। এজন্য প্রয়োজন গবেষণা, সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। পাশাপাশি দক্ষ জনবল এবং পর্যাপ্ত আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, সামুদ্রিক এলাকায় প্রধানত খনিজ সম্পদ রয়েছে। সেখানে গ্যাস সম্পদ আছে। শুধু মাছই রয়েছে কয়েকশ প্রজাতির। এছাড়া রয়েছে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙ্গরসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণি।

১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। পৃথিবীর দেশগুলো তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা মেটাতে এখন তাকিয়ে আছে সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত সম্পদের দিকে।
স্বাধীনতার পরই সাগরে গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে অনুযায়ী তিনি বিদেশি কোম্পানিকে কাজেও লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সাগরে অনুসন্ধান কাজ থেমে যায়। বর্তমান সরকার আবার সেই অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, পৃথিবীর অন্তত ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্র তলদেশ হতে। সমুদ্র এলাকায় মৎস্য ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণ এবং সমুদ্র পরিবহন-সুবিধা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। পাশাপাশি সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র নির্ভর ঔষধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব।

সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকাল বিরোধের কারণে গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজে সমস্যা হতো। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায়। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠারও অধিকার পায় বাংলাদেশ।

সমুদ্রজয়ের পর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বয়ে গেল বছর ‘ব্লু- ইকোনোমি সেল’ নামে একটি সংস্থা গঠন করে সরকার। গত ৮ অক্টোবর এক বৈঠকে এই সেলকে ‘ব্লু ইকোনমি অথরিটি’ করার সুপারিশ করেছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

বৈঠকে জানানো হয়, ব্লু ইকোনমি সেলটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন একটি অস্থায়ী সেল। এর আইনগত কর্তৃত্ব না থাকায় এই সেলের সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রে অন্যদের আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। অস্থায়ী হওয়ায় এই সেলকে কোনো আর্থিক বরাদ্দও দেওয়া হয় না। তাই এই সেলকে স্থায়ী করা বা আইনের মাধ্যমে একটি ব্লু ইকোনমি কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে গত রোববার অতিরিক্ত সচির ও ব্লু-ইকোনমি সেলের সমন্বয়ক গোলাম শফিউদ্দিন বলেন, নির্দেশনা পাওয়ার পর অথরিটি গঠনের জন্য খসড়া তৈরি করেছি। এখন তা সংশোধনের কাজ চলছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এটি মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হবে।

বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার ভূ-গঠন, তেল-গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ‘মাল্টি ক্লাইন্ট সিসমিক সার্ভে’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রায় ৫ বছর আগে। কিন্তু এর অগ্রগতি হয়েছে খুবই সামান্য।

গোলাম শফিউদ্দিন বলেন, সাগরে কোথায় কী পরিমান সম্পদ আছে জানতে গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করতে হবে আগে। এজন্য যে বিশেষায়িত জাহাজ দরকার তা আমাদের নেই। প্রথমে এই জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরবর্তীতে ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভাড়া করা জাহাজ নিয়ে এই কাজ ভালভাবে করা সম্ভব নয়। কারণ গবেষণার কাজ দীর্ঘমেয়াদি।

তিনি বলেন, ব্লু ইকোনমি সেলে যারা আছে তারা সবাই যদি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করতো তাহলে আমরা এতদিন অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারতাম। এখানে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের অনেক দায়িত্ব। কিন্তু তারা সময়মত সে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। কিছুদিন আগে পেট্রোবাংলা বলেছিল তিনমাসের মধ্যে তারা জাহাজ ভাড়া করবে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে সেটি তারা পারবে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, সেলে ২৫ জনের পদ থাকলেও বর্তমানে আছেন ১৩ জন। জনবল বৃদ্ধি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও সংস্থাগুলো যদি সময়মতো কাজ করেন তাহলে সমুদ্রে অনেক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, সমুদ্র জয়ের খবর অনেক বেশি আনন্দের। ব্লু ইকোনমির এই ধারনাও বেশ ভাল। নি:সন্দেহে সাগরের নিচের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অনেক বেশি উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য গবেষণা ও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কিন্তু সে ধরনের কিছুই আমরা দেখছি না।

তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার গত ৪ বছরে তার সমুদ্র সীমানায় জরিপ শেষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে। সেখানে অন্তত ১০ টি কোম্পানি কাজ করছে। ইতোমধ্যে সাগরে বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করেছে তারা। মিয়ানমার পারলে, বাংলাদেশ তা পারেনি কেন, এটি বিশ্নেষণের সময় এসেছে।

বদরূল ইমাম আরও বলেন, ২০১২ সালে পেট্রোবাংলা বলেছিল এক বছরের মধ্যে তারা সমুদ্রে জরিপ কাজ শেষ করবে। এখনও তারা তা পারেনি। অনুসন্ধান কাজের ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি, আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের কবল থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে কোন কিছুই হবে না।

সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে তার দাম অনেক কম হতো। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যৎ জ¦ালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র জানায়, সাগরের সম্পদ আহরণে দেশকে সমৃদ্ধ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ২০১৬ সালের আগস্টে চুক্তি করেছে সরকার। এ চুক্তির মাধ্যমে ইইউর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। চুক্তির আওতায় সমুদ্র অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ গবেষণা করবে সমুদ্র গবেষণায় দক্ষ ইইউ। এরপর এ সম্পদ কীভাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশমালা তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সমুদ্রসীমার ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে পৃথক সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ।

আজকের বাজার : এনএল/সালি, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮