সিমেন্ট খাতের উন্নয়নে দরকার সরকারের পলিসি সাপোর্ট

করোনাকালীন এই সময়ে সিমেন্ট খাতের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করতে হলে বলা দরকার, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ, এই তিন মাস সিমেন্ট খাতের অবস্থা ভালোই ছিল। ২৬শে মার্চ থেকে যখন লকডাউন শুরু হলো, তখন থেকে বিক্রিটা একেবারেই কমে গেলো। অন্যান্য কোম্পানি ২৫ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত সিমেন্ট বিক্রি করেছে, অনেক কোম্পানি বিক্রি করতে পারেনি। এপ্রিল মাস এবং মে মাসে আমাদের বিক্রির পরিমান একেবারেই খারাপ ছিল। যেটা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কম ছিল। জুন মাসে বিক্রি একটু ভালো হয়েছে। আমার মনে হয়, মানুষ করোনাকালটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শুরু করেছে। সেই জন্য কিছু কিছু দোকানপাট খুলেছে, হয়তো গ্রাম গঞ্জে কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে। আর ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরগুলোতে আগের যে কাজগুলো অসমাপ্ত ছিল, সেটা কিছু কিছু হচ্ছে। নতুন করে প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে না। নতুন করে কাজ শুরু করতে অথরিটি পাস করা, ছাড়পত্র যারা দেয়, সেই অফিসগুলো তেমন ভাবে এখনও চালু হয় নাই। সেই জন্য নতুন কাজগুলো হচ্ছে না। আর যেটা হচ্ছে আপনারা জানেন, আমাদের এডিবিতে ভালো কাটসাট করা হবে। সরকারি কাজগুলোর মধ্যে একমাত্র পদ্মা সেতু বাদে সব কাজগুলো অনেক স্লো। এটা হয়তো চালু হবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে। আমরা জেনেছি যে, সরকারি কাজগুলো আগামী দুই বছর পর্যন্ত একটু ধীর গতিতে চলবে। আমরা যেটা ২৫-৩০ শতাংশ সরকারের কাছে বিক্রি করতাম, সেটা হয়তো এখন কমে যাবে। সব মিলে বিক্রিতে সিমেন্ট খাতে অনেকটা ধ্স নামবে।

করোনাকালীন এই সময়ে আমাদেরকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেটা সম্পর্কে যদি বলি, আমাদের মার্কেটিং এ যারা কাজ করে, যারা সিমেন্ট বিক্রি করে, তারা কিন্তু তেমনভাবে মার্কেটিংয়ের কাজটা করতে পারছে না। দোকানপাটগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এজন্য অর্ডারগুলো আগের থেকে অনেকটা কম। আমাদের ক্যাশ কালেকশনটাও অনেক কম হচ্ছে। যেখানে অনেক কাস্টমাররা  আমাদের অফিসে এসে  টাকা জমা দিয়ে যেতো। আমরা টাকাগুলো ব্যাংকে জমা করতাম, তারা কিন্তু এখন আর আমাদের অফিসে আসছে না। তারা যেটা চাচ্ছে সেটা হলো, তাদেরকে আমরা একটা ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিয়ে দেই, তারা আমাদের ব্যাংক একাউন্টে টাকাটা জমা করবে। এখানে অনলাইন কাজটা একটু বাড়ছে। আমাদের যারা কাস্টমার আছে, তারা তো সবাই একরকম না, তারা ক্যাশ টাকাটা পেলো, একটা ডিও হাতে করে নিয়ে গেলো, ডিওটা ডেলিভারি করার জন্য বললো, কিন্তু করোনাকালীন এই সময়ে তা হচ্ছে না। করোনাকালীন এই সময়ে অনেক চাকরিজীবীদের আয় কমে গেছে। সে যে গ্রামের বাড়িতে একটা কাজ শুরু করবে, সেটা হচ্ছে না। যারা অনেক আগে থেকেই বাড়ি করবে বলে টাকাটা জমিয়ে রেখেছে, তারা হয়তো বা কাজটা করতে পারে। নতুন করে আর কেউ এখন বাড়ির কাজ করবে বলে মনে হয় না। সব মিলে করোনাকালীন এই সময়ে আমরা অনেক  চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। এখন অনেক কোম্পানি সিমেন্টের মূল্য কমিয়ে বিক্রি করছে। এতে করে যেটা হচ্ছে, আমরা খরচের তুলনায় ন্যায্য মূল্যটা পাচ্ছি না।

করোনাকালীন এই সময়ে মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে যদি বলি,এটা খুবই দুঃখজনক যে, সন্তানের জন্য মা বাবা জীবন দিতে প্রস্তুত, সেই সন্তান মা বাবাকে দেখবে না, ফেলে চলে যাবে। মা বাবার খোঁজখবর নিবে না, রাস্তায় ফেলে চলে যাবে, এটা আসলেই দুঃখজনক। যদি আমি করোনায় আক্রান্ত হই, আমার কাছে যতটা খারাপ লাগবে, তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগবে যদি আমার সন্তান অসুস্থ হয়। ওই সন্তান আমার অসুস্থতায় যদি আমাকে ফেলে চলে যায়, এটা খুবই দুঃখজনক। যে মা বাবা সন্তানদেরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এতকিছু করেছে, সন্তান যদি শেষ মুহূর্তে মা বাবার পাশে না দাঁড়ায়, এটা আসলেই অমানবিক কাজ। যে মানবিক বিপর্যয় আমাদের দেশে হচ্ছে, এতে  আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। যেমন, ইতালি জাপান আমাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা অবৈধ পথে টাকা ইনকামের জন্য ছুটছি। আমারা কি নৈতিক, অনৈতিক কোনো কিছুই চিন্তা করছি না, এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দেখছি যে, দেশের অনেক শিল্পপতি, ভূমিদস্যু যারা মানুষের হক দেয়নি, তারাও মারা  যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে, পাশে পরিবারের কেউ নেই। সবাইকে মরতে হবে এবং খালি হাতে যেতে হবে। আমাদের পাপের ভাগ আমাদের উত্তরাধিকারী কেউ নেবে না। আল্লাহ বলেছেন, আমি বান্দার হক মাফ করতে পারবো না। বান্দার হক, বান্দার কাছ থেকেই মাপ নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে, যদি শিক্ষা না নিতে পারি, এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হবে।

এবারের বাজেট সম্পর্কে যদি বলি, ২০-২১ অর্থবছরের বাজেটকে আমি স্বাগত জানাই। এবারের বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা যে নির্মাণ খাত, সিমেন্ট এবং ইস্পাত শিল্প তেমন কিছু পাই নাই। আমরা বিভিন্ন ভাবে অনেক টকশোতে বলছি যে, সরকার আমাদের ৩ শতাংশ অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স নেয়। আগে কিন্তু ৫ শতাংশ নিত সেটাকে ৩ শতাংশ করা হলো। এই ৩ শতাংশ ট্যাক্স সর্বনিম্ন করা হলো। এটা কোনভাবেই মিনিমাম ট্যাক্স হয় না। আপনি সরকারে আছেন, এখন ৩ শতাংশ ট্যাক্স নিলাম, আবার সেলসর উপর ২-৩ শতাংশ, এই যে ৬-৭ শতাংশ ট্যাক্স অগ্রিম কেটে নিল এবং তারপর বলা হবে এটা তো মিনিমাম ট্যাক্স। এখন সরকার আমাদের বলবে যে, তুমি ৩২ শতাংশ লাভ করো। এখানে ৩২ শতাংশ লাভ অসম্বভ।

সিমেন্ট কোম্পানি এখন থার্ড কোয়ার্টার আবার অনেকে সেকেন্ড কোয়ার্টার একাউন্ট জমা দিয়েছে। এখন যেটা হচ্ছে, অনেক কোম্পানি লসে পড়ে গেছে। জানুয়ারি-মার্চ মাসে যে কোয়ার্টার ছিল, এখন দেখা যাবে যে সবগুলো কোম্পানিই লসে চলে গেছে। এই জিনিসগুলো আমার মনে হয় একটা সম্ভাবনাময় খাত ছিলো। এই খাতটাকে পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য তিনশো খেলাপি আছে, আর নতুন খেলাপি সৃষ্টি করা বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখানে যদি কোম্পানিগুলো প্রফিটেবল না হয়, একসময় তারা প্রোডাকশন কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হবে এবং কর্মচারীদের বেতন কমাতে বাধ্য হবে। কোম্পানিগুলো এক্সট্রিম পর্যায় গেলে, কর্মচারীদের ছাটাই করতে বাধ্য হবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমনিতেই দেশে বেকার সমস্যা আছে, বেকার সমস্যাটা কি আরো বৃদ্ধি করে দেওয়াটা যুক্তি সংগত হবে ?

এখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, একটি হলো হিউম্যান রিসোর্স, আরেকটি হল অপারেশন ম্যানেজমেন্ট, এ ব্যাপারে আমি বলবো, আমাদের প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স যেটা আগের মতো আর নাই, আমাদের লোকজনকে ক্লিয়ারলি মুভমেন্ট করাতে পারছি না। আমরা যারা অফিসে কাজ করি, তাদেরকে পর্যায় ক্রমে অফিস করতে হচ্ছে। সেটা হলো, এই সপ্তাহে তিনজন আসলো, তা পরের সপ্তাহে আরো তিনজন আসলো। এভাবে করে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেনে অফিস করছে হচ্ছে। এভাবে সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে অফিস করতে হচ্ছে। একটা সেকশনে ৬ জন কাজ করেন। এক সপ্তাহে তিনজন আসে, অন্য সপ্তাহে বাকি ৩ জন আসবে। এভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করতে হচ্ছে। তাতে আমাদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আগে আমরা যে সময় করতে পারতাম সেই সময়টা দ্বিগুণ লাগছে।

অপারেশন ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে যদি বলি, অফিসে যারা কাজ করে তাদেরকে একটা ল্যাপটপ দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জুমে কানেক্ট করে দিয়েছি, যাতে তারা বাসায় বসে কাজটা করতে পারে। আর যাদের অফিসে ফিজিক্যাল উপস্থিত থেকে কাজ করতে হয়, সেটা করতে গিয়ে আপনারা জানেন আমাদের ফ্যাক্টরি নারায়ণগঞ্জ। যেখানে কিছুদিন আগে রেড জোন ছিল। অনেকেই মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে অফিসে এসে কাজ করতো, কিন্তু রেড জোনের কারণে, তারা অফিসে এসে কাজ করতে পারতো না। যেটা আমাদের করতে হলো, প্রায় ১২-১৩ এমপ্লয়ীকে ফ্যাক্টরিতে তিনবেলা খাবার দিয়ে তাদেরকে রাখা হয়েছে। আবার অনেকেই রেড জোনের কারণে গ্রামে চলে গিয়েছিল, তাদের জন্য আমরা যেটা কি করেছি, বাইরে একটা বাসা ভাড়া করে ১৪ দিন করেন্টাইন থেকে তারপর অফিসে আসতে হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে আমাদের অনেক খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা মাস্ক দিচ্ছি, স্যানিটাইজার দিচ্ছি, গ্লাভস দিচ্ছি এবং বাইরে যারা কাজ করে তাদেরকে পিপিই দিচ্ছি। এতে আমাদের অনেক খরচ হচ্ছে।

সিমেন্ট খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমার সুপারিশ হচ্ছে, সরকারের বেশি বেশি পলিসি সাপোর্ট দরকার।
এখন অনেক খারাপ সময় আমরা পার করছি। এখন কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পলিসি সাপোর্টার বেশি দরকার। গত বছরের তুলনায় আমাদের ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন সিমেন্ট কম বিক্রি হয়েছে। এই যে ঘাটতি, এটা কে কাটিয়ে উঠতে হলে, আমাদের প্রতি মাসে প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন সিমেন্ট বিক্রি করতে হবে। এই ঘাটতি পূরণ করা সম্বভ নয়। তাই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে, আমরা হয়তো একটু সচ্ছল হতে পারবো। তাই এখন সবদিক থেকে সরকারের পলিসি সাপোর্টাই বেশি দরকার।

মো. শফিকুল ইসলাম তালুকদার
চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড