স্লুইসগেট অকেজো, নয়মাস পানির নিচে থাকে কয়েকগ্রামের ফসলি জমি

পানি উন্নয়ন বোর্ডের(পাউবো)অযত্ন আর অবহেলায় বেতনা নদীর সংযোগস্থলে নির্মিত স্লুইসগেট দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষকে। এরশাদ সরকারে আমলে যশোরের শার্শা উপজেলার বাগ আঁচড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সামটা ও উত্তর পিঁপড়াগাছী গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামটা খালের সাথে বেতনা নদীর সংযোগস্থলে ১৯৮৬-৮৭ সালে এ স্লুইস গেটটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। স্লুইসগেটটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো থাকায়, সামটা থেকে ঝিকরগাছার শংকরপুর ইউনিয়নের কুল বাড়িয়ার নদীর পাঁচ কিলোমিটার অংশ জুড়ে কচুরীপানায় ভর্তি থাকায় স্লুইচগেট দিয়ে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

অন্যদিকে, নদীতে সামান্য পানি থাকলেও তাতে অবৈধভাবে নেট-পাতা ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হচ্ছে ওই এলাকার রাস্তাঘাটসহ শত শত বিঘা ফসলি জমি। পানির প্রবাহ ঠিক না থাকায়, শুষ্ক মৌসুমে এখানকার বিলের অর্ধেকের বেশি ফসলি জমিতে পানি জমে থাকায় একমাত্র ইরিধান ছাড়া অন্যকোন ফসলও ফলাতে পারছেনা কৃষকরা। এতে, বিলের আশেপাশের ৫০০ বিঘা জমির মধ্যে ৩০০ বিঘা জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এজন্য বছরের নয় মাসই বসে থাকতে হয় এ দুই গ্রামের বসবাসকারী দুই থেকে তিন হাজার পরিবারকে। এলাকাবাসীর দাবি, পাউবোর অযত্ন, অবহেলা এবং স্লুইসগেটটি ঠিক মত দেখভাল না করায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে এ সমস্যার সমাধান হবে কিনা এমন প্রশ্নও করছেন অনেকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সময়কার প্রমত্তা বেতনা নদী যশোরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শার্শা উপজেলার নাভারনের কাছ দিয়ে এ বেতনা নদী প্রবাহিত হয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বেনেরপোতা থেকে আশাশুনি উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বুক চিরে খোলপেটুয়া নদীতে গিয়ে মিশেছে। প্রায় ১৯১ কিলোমিটার(১১৯ মাইল)দৈর্ঘ্য ও ৫৫ মিটার প্রস্থের নাদীটি তার প্রবাহ হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে।

নদীটির নাম বেগবতী বা বেত্রবতী হলেও শার্শার মানুষের কাছে নদীটি বেতনা নামে ও ঝিকরগাছার মানুষের কাছে ভায়না নদী নামে পরিচিত। সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীটিতে শার্শার শিকারপুর থেকে গোরপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটারে পানি আছে। আর গোরপাড়া থেকে বনমান্দার এলাকা পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এখন মৃতপ্রায়। আবার বনমান্দার এলাকা থেকে রাধানগর এলাকার জিয়া খাল পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার অংশে জুড়ে অন্তত আটটি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে স্থনীয় প্রভাবশালীরা।

পানি নিস্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় পলি পড়ে নদীর নব্যতা কমে যাওয়ায় প্রচুর পরিমাণে কচুরীপানা জমে আছে। ফলে, বিগত প্রায় চারদশকেরও বেশি সময় ধরে বর্ষামৌসুমে এসকল এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে, উপজেলা প্রশাসন সকল সরকারি নদী ও খালের নেট-পাটা অপসারণের নির্দেশ দিলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার তোয়াক্কা না করেই বেতনা নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে। এতে কচুরীপানায় ভর্তি নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

এছাড়াও, পাউবোর কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে স্লুইসগেটগুলো রক্ষনাবেক্ষণের তদারকিতে‘গেট খালাসি’না থাকায় এ স্লুইচগেটগুলো সংস্কারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, সামটা গ্রামের স্লুইচগেটটিও দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট থাকার সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালে আড়াআড়িভাবে নেট-পাটা ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় খালের পানি ও বিলের পানি নিষ্কাশন সমস্যা হচ্ছে।

ফলে বাগ আঁচড়া ইউনিয়নের ১২ গ্রামের মধ্যে সামটা ও পিঁপড়াগাছী গ্রামের শতশত বিঘা ফসলি জমি, রাস্তাঘাট বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।পিঁপড়াগাছী গ্রামের কৃষকরা জানিয়েছেন, ইরি মৌসুমে বিলের পাশের জমিতে যে ধান রোপন করেছেন। আগামী বৈশাখ মাসে তা ঘরে তোলার পর বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। আর কোন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়না বলে বছরের বাকি নয় মাসই তাকে বসে থাকতে হয়।

দক্ষিণ সামটা গ্রামের কৃষক আব্দুল, রহমত আলী, সালাউদ্দিন, আবুল কাশেম, জসিম উদ্দিন, উজ্জল দাস জানান, তারা এ মৌসুমে ইরি ধানের চাষ করেছেন। ধান ঘরে ওঠার পর তাদেরও বছেরের বাকি ৯মাস ঘরে বসে কাটাতে হয়। পরিবার পরিজন নিয়ে অতি কষ্টের দিনাতিপাত করতে হয়। তারা জানান, ইউনিয়নের চেয়্যারম্যানের কাছে সমস্যা থেকে পরিত্রাণে লিখিত ভাবে অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এর কোন সুরাহা হয়নি।

এ ব্যাপারে বাগ আঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের(ইউপি)চেয়ারম্যান মো ইলিয়াস কবির বকুল বলেন, ঝিকরগাছার শংকরপুর ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া হতে সামটা খাল পর্যন্ত বেতনা নদীতে ও খালে যে পরিমান কচুরীপানা তৈরি হয়েছে তাতে কুলবাড়িয়ায় বেতনা নদীতে নির্মিত স্লুইসগেট এবং সামটা খালের স্লুইচগেট দিয়ে পানি অপসারনে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে ওইসব এলাকায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এলাকাবাসীদের এ সমস্যাটি সমাধানে শার্শা উপজেলার মাসিক সভায় তিনি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আসছেন জানিয়ে তিনি এ সমস্যার সমাধান সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও)পুলক কুমার মন্ডল বলেন, বেতনা নদীসহ সংযুক্ত যেসব খাল গুলোর পুনঃখনন করার একটি তালিকা করে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন নদী ও খালে কোন নেট-পাটা ও বাঁধ গুলো মোবাইল কোটের মাধ্যমে জেল জরিমানা করে অপসারণ করেছি। তারপরও যদি কোথাও কোন নেট-পাটা দিয়ে কেউ অবৈধ ভাবে মাছ চাষ করছে এমন কোন অভিযোগ পাই তবে তার বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেব।

যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাহরিয়ার সরকার বলেন, ছোট নদী, জলাশয় ও খাল পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় যশোর জেলায় ৭টি ছোট নদী, জলাশয় ও খালের পুনঃখনন কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় শার্শার যশোর অংশের বেতনা নদী ও তার সংযুক্ত খালগুলো পুনঃখননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড যাবতীয় তথ্যসহ তা অনুমোদনের জন্য গত বছরের অক্টোবর মাসে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কোন অনুমোদনের আদেশ যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড হাতে পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন অনুমোদন পেলেই পুনঃখনন কাজ শুরু হবে।

স্লুইসগেট সম্পর্কে জানতে চাইলে এ প্রকৌশলী বলেন, `স্লুইসগেট দেখভাল করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কর্মচারী নেই। স্থানীয়দের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি এর দেখভাল করে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের দিকে আমরা মন্ত্রণালয়ে গেট সংস্কারের জন্য সুপারিশমালা পাঠিয়েছিলাম কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার অনুমোদন আসেনি, যোগ করেন তিনি। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান