হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ‘কোচ’ সম্প্রদায়ের নববর্ষ উৎসব ‘বিহু’

ময়মনসিংহে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম কোচ সম্প্রদায়। এক সময়কার প্রভাবশালী জনগোষ্ঠি কোচ সম্প্রদায়ের বসতি এলাকা এখন সীমিত হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যাও অনেক কমে গেছে। কোচ সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। নববর্ষে এ সম্প্রদায় ‘বিহু’ উৎসব পালন ও বৈশাখি বাস্তু পূজা করে থাকে। শেরপুরে কোচপল্লীগুলোতে একসময় বিহু উৎসবের ঘিরে নানা আয়োজন হলেও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। কোচদের ‘বিহু’ উৎসব ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোচদের এই বর্ষবরণ ‘বিহু’ উৎসব উপভোগের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন সম্প্রদায় ও ভাষাভাষী মানুষেরা। কিন্তু আগ্রাসন, দারিদ্রতা আর অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভরতার কারণে ক্রমেই কোচরা সংকুচিত হয়ে আসছে। নানাভাবে জমি হারানোর পাশাপাশি কোচদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি লুপ্ত হতে চলেছে। তাই বৈচিত্রময় সমাজ গঠন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব স্বত্তা ফিরিয়ে আনতে কোচদের নববর্ষ উৎসব ‘বিহু’ সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শেরপুর জেলা সদর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার গারোপাহাড়ের পাদদেশে রাংটিয়া এলাকায় কোচ পল্লীর সারি সারি মাটির দালান। প্রতিটি কোচবাড়ি, ঘরদোড়, উঠোন একেবারে নিকোনো। প্রতি বাড়িতে জবা, গোলাপসহ দেশীয় ফুলের গাছ রয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে ছোট আকৃতির মন্দিরও। গুরুচরণ-দুধনই আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক যুগল কিশোর কোচ বলেন, ‘ওই এলাকায় প্রায় শতাধিক ঘর কোচ পরিবার রয়েছে। পহেলা বৈশাখে তারা নববর্ষ বা ‘বিহু’ পালন করে থাকেন। ইতোমধ্যে বাড়িতে বাড়িতে বিহু উৎসব পালনের জন্য চালের গুড়া, শুটকি শুকানো, ঘরদোর পরিষ্কার করাসহ নানা প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে এক সময় আয়োজন করে কোচপল্লীগুলোতে ‘বিহু’ বা নববর্ষ উৎসব পালিত হতো। এ উপলক্ষে ‘কচ কাহিনী’,‘দেবী যুদ্ধ’,‘থুবল মাগাইনি’,‘লেওটানা’ ও পালাগানের আসর বসতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কালো, মৃদঙ্গ, ঢোল, গঙ্গ, করতাল ও বাঁশির বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ আর গান হতো। রাতে খাবার পর পরিবারের সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে জমতো ‘ফেলাওনি’ বা আড্ডা। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব আর দেখা যায় না।

তিনি বলেন, ‘আমরা কোচরা সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও আমাদের কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। কোচ সমাজ সাধারণত দেও-দেবতা ও প্রকৃতি- পূজারি। আমাদের নববর্ষ বা বিহুতেও অদৃশ্য দেও বা ওই প্রকৃতি পূজার প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া বিশেষ ধরনের খাবার-দাবার ও লোকাচার পালন করা হয়ে থাকে।’ ‘এখন বাড়ি বাড়ি বিহু’র আচারাদি হয়, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করে ‘বিহু’ করা হয় না। এজন্য খরচ অনেক, পরিশ্রমও অনেক। তবে যদি সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো, তাহলে হয়তোবা এটা আনুষ্ঠানিকভাবে করা যেতো। এতে ঐতিহ্য টিকে থাকতো। অন্যরাও কোচদের জীবনাচার, লৌকিকতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারতো,’ যোগ করেন তিনি। কোচ নেতা মুক্তিযোদ্ধা নবীন কোচ বলেন, ‘বিহুর দিনে সকল কোচ বাড়িতেই ঐতিহ্যবাহী কাঁথামুড়ি পিঠা, মেরা, তেলের পিঠাসহ নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। সাথে থাকে ‘মেরা’। অতিথিদের আমরা পিঠা ও মেরা দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকি। এদিন সবাই নতুন জামাকাপড় পড়বেন। ভালো কাজ করবেন। কোন ধরনের ভারী কাজ করবেন না। বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যাবেন না। একেবারে বাধ্য না হলে কোন ধরনের যানবাহনে চড়বেন না। কোচ নারীরা তাদের এহিত্যবাহী পোষাক নতুন ‘লেফেন’ পড়বেন। নতুন জামা-কাপড় পড়ে কোচ পুরুষ-নারীরা নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। আনন্দ-উৎসব করে ‘কাঁথামুড়ি’ পিঠাসহ অন্যান্য পিঠা খাবেন এবং ‘মেরা’ পান করবেন। এভাবেই সারাদিন কাটাবেন।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, প্রতিটি কোচ বাড়িতেই রয়েছে ছোট্ট আকারের ‘কানিওয়াই’ দেবতার মন্দির। এটাকে কেউ কেউ ‘পদ্মা মন্দির’ বলে থাকেন। কোচের বিশ্বাস এই দেবতা সর্বদা তাদের অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন সকালে ফুলপাতা, ধুপ-আরতি দিয়ে কোচ পরিবারগুলো বাড়ির এ ‘কানিওয়াই’ দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়ে দিনের কাজকর্ম শুরু করেন। নববর্ষ বা বিহুর দিনও ঘুম থেকে ওঠে বাড়ির বউ-ঝিরা ঘরদোর পরিষ্কার করেন, লেপা-মোছা করার পর গোসল করেন। তারপর ‘কানিওয়াই’ বা পদ্মার মন্দিরে ধুপ-দোনা, ফুল দিয়ে পূজা করে দেবতার আশির্বাদ প্রার্থনা করেন। এরপর অন্যান্য কাজ করেন। নববর্ষ বা বিহুর দিন কোচ পরিবারগুলো সকাল-সন্ধ্যায় আরও দুটি বিশেষ পূজা করে থাকেন। সকালে করেন ‘হাজংবড়ি ওয়াই’ পূজা। এটি অনুষ্ঠিত হয় গাছতলায়। কোচদের বিশ্বাস, এ পূজা করলে কাজ করতে গিয়ে দা-কুড়ালের আঘাত কিংবা যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। হাজংবড়ি ওয়াই দেবতা সর্বদা তাদের রক্ষা করবেন। আর এদিন সন্ধ্যায় তারা করেন ‘গাসুম ওয়াই’ পূজা। এ পূজাটি করা হয় ঘরের ভেতর। কোচদের বিশ্বাসমতে, এ পূজা করলে জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে এবং হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে তারা রক্ষা পাবেন। এ দু’টি পূজার জন্য একজোড়া মুরগি বলি দিতে হয়। সকালে পূজার সময় একটি এবং সন্ধ্যায় আরেকটি মুরগি বলি দেয়া ছাড়া ‘হাজংবড়ি ওয়াই’ এবং ‘গাসুম ওয়াই’ পূজা হবে না। বিহুর দিনে এ দু’টি পূজা করলে সারাবছর তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সকল প্রকার বিপদ-আপদ ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবেন বলে বিশ্বাস করেন।

রাংটিয়া গ্রামের হারেজ চন্দ্র কোচের স্ত্রী সুরবালি কোচ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি বছরের প্রথম দিনটি যদি ভালোভাবে কাটে, তাহলে সারাবছর ভালো যাবে। এজন্য নববর্ষ বা বিহুর দিন পূজাপালির বাইরে আনন্দ করে কাটাতে চেষ্টা করি। প্রতিবার বিহুর সময় বাবার বাড়ি যাই। ওইদিন গাড়িতে না চড়ে হেঁটেই যাওয়া-আসা করি। ঝিনাইগাতীর ফাখরাবাদ একতা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিরুজ্জামান লেবু বলেন, বিহু মুলত কোচ সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও একদা ধর্ম-বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনেরও বিহু’র আনন্দ অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় হতো। ছোটকালে আমরা এমনটাই দেখেছি, নিজেও তাদের নানা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। বিহু ছিলো অনেকটা সামাজিক উৎসব। কিন্তু কালের বিবর্তনে কোচ সম্প্রদায়ের বিহু উৎসব অনেকটা হারাতে বসেছে। বিহু উৎসব রক্ষা করা গেলে কোচদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রক্ষা পাবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া দরকার। তিনি বলেন, আমি মনে করি শেরপুর অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা প্রয়োজন। তাতে করে এই অঞ্চলে কেবল কোচ নয়, অন্যান্য আরও যে সকল জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে, সকলেরই নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করা সহজ হবে। এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব বলেন, শেরপুর জেলায় কোচ, গারো, হাজংসহ আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকজন বসবাস করেন। তাদের অনেকের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠানাদি রয়েছে। ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলসিমালার সুগন্ধে’ শেরপুরের জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম জোরদার করতে সেসব সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়া হবে। তাছাড়া শেরপুর জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর একটি কালচারাল একাডেমি যাতে স্থাপন করা যায় সেজন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, শেরপুরে ছিলো কোচ রাজ্য। শ্রীবরদীর গড়জড়িপা ছিলো দলিপা কোচ রাজার রাজধানী। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও গাজীপুর অঞ্চল পর্যন্ত কোচ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। কিন্তু আজ কোচরা সংকুচিত হতে হতে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মতো কোচদেরও অনেক নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। বতর্মানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার জুকাকুড়া, পানবর, পশ্চিম বাঁকাকুড়া, পূর্ব বাঁকাকুড়া, দক্ষিণ গান্ধিগাঁও, উত্তর গান্ধিগাঁও, ভালুকা, গজনী, হালচাটি, ডেফলাই, নওকুচি, রাংটিয়া, বড় রাংটিয়া, শালচুড়া, নকশী গ্রাম, নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা, সমশ্চুড়া, বুরুঙ্গা, দাওধারা এবং শ্রীবরদী উপজেলার বাবেলাকোনা, হাতিবর, বালিজুড়ি, খাড়ামুড়া গ্রামসহ ২০ গ্রামে বর্তমানে প্রায় চার হাজারের মতো কোচ সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। এখন আর উৎসব আয়োজন করে শেরপুরের কোচ পল্লীগুলোতে ‘বিহু’ পালন হয় না। তবে কোচ পরিবারগুলোতে এখনও বাড়ি বাড়ি নববর্ষে বিহুর আচার অনুষ্ঠানাদির প্রচলন রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৫ সালে ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে কোচদের বিহু উৎসব পালিত হয়েছে। বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি এ বিহুর আয়োজন করেছিলো। গত বছরও ওই একাডেমির উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে কোচ সমাবেশ, মেলা ও বার্ষিক বিহু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাঝে একবার নালিতাবাড়ীর খলচান্দা গ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস’ বিহু উৎসবের আয়োজন করেছিলো। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান