হাসপাতালের যন্ত্রপাতি-আসবাবপত্র ক্রয়ে হরিলুট

সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় ২৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে ২৫৫ কোটি টাকা এবং আসবাবপত্র থেকে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যাচাই-বাছাই করছে তলব করা ২৩ ধরনের নথিপত্র।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদক উপপরিচালক শামসুল আলম গত দুই বছরের ক্রয় সংক্রান্ত নথিপত্র তলব করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো তলবি নোটিসে ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ এবং ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ক্রয় সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি তলব করা নোটিসে ২৩ ধরনের নথিপত্র চেয়েছে দুদক। চাহিদাকৃত রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান কর্তৃক চাহিদাপত্র, পরিচালক ও অধ্যক্ষের চাহিদাপত্র, অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা, বরাদ্দপত্র, প্রশাসনিক অনুমোদন, দরপত্র সংক্রান্ত কমিটি গঠন, অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন, বাজারদর কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ও ওয়েবসাইটের কপি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির প্রতিবেদন, কারিগরী মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র মূল্যায়ণ কমিটির প্রতিবেদন, তুলনামূলক বিবরণী, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড, চুক্তিপত্র, কার্য সম্পাদনের জামানত ও ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ, ব্যয় মঞ্জুরি, সার্ভে কমিটি কর্তৃক মালামাল গ্রহণ সংক্রান্ত প্রমানক, ইনস্টলেশন রিপোর্ট, পরিশোধিত বিলের কপি, পরিশোধিত চেকের কপি এবং সংশ্লিষ্ট নথি।

এ বিষয়ে দুদক উপ-পরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘অভিযোগ অনুসন্ধানে তলবকৃত নথিপত্রের মধ্যে বেশকিছু রেকর্ডপত্র দুদকে এসেছে। এখনো আরও নথিপত্র আসা বাকি রয়েছে। সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। এছাড়া আমাদের টিম যে কোনো সময় সরেজমিন পরিদর্শন করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনুসন্ধান পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান দুটিকে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন ও দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধান টিমের সরেজমিন অনুসন্ধানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

তিন সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান টিমের অপর সদস্যরা হলেন- উপ-সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান।

যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যাচাই ও মূল্য নির্ধারণে সরেজমিনে অনুসন্ধান টিম পরিদর্শনকালে সবরাহকারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার কথাও দুদকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

২০১৪ সালের জুলাই মাসে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ এবং ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করা হয়। শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প নামে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ছোট বড় আটটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সিরাজগঞ্জ সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে শিয়ালকোল এলাকায় প্রায় ৩০ একর জমির ওপর শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণে প্রথম ধাপে প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৬৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির খরচ ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে ধরা হয় ৮৮৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। টাকার অংকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ বৃদ্ধি পায় ২৪৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে যন্ত্রপাতির বর্তমানে বাজার দর বৃদ্ধি, নতুন যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব সংযোজন, মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে খরচ বেড়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল।

তবে অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধীরগতি এবং হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের বরাদ্দকৃত যন্ত্রপাতির তালিকায় প্রতিটি যন্ত্র ও ফার্নিচারের দাম প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি নির্ধারণ করার কারণে প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যেই ৬০টির মতো মেশিনে অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। ওই দামে যন্ত্রপাতি কেনায় সরকারের অপচয় প্রায় শত কোটি টাকা। যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে, এসপিওয়াই ইন্ট্রাঅপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন ও ল্যাপারোস্কোপি মেশিন এবং হার্টের রোগীদের জন্য সিসিইউ এবং আইসিইউ ইউনিট ইত্যাদি।

অভিযোগ সূত্রে আরও জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্প থেকে ২৫৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় কোনো নিয়মনীতিই অনুসরণ করা হয়নি। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রায় প্রতিটি পণ্য বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে। ঠিক একই চিত্র আসবাবপত্র কেনাকাটায়। ২০ কোটি টাকার আসবাবপত্র ক্রয়ের নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান লুটপাট চালিয়েছে। যেখানে অভিযোগের তীর ঠিকাদারি ৮টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ঊর্ধ্বতনদের বিরুদ্ধে।সূত্র:ইউএনবি

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান