৪০ লাখ টন আলু নিয়ে বিপাকে কৃষক ও হিমাগার মালিকরা

সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও হিমাগার মালিকরা। দেশের ৩৯০টি হিমাগারে থাকা প্রায় ৪০ লাখ টন আলু এখন কৃষকের গলার ফাঁস। বাজারে তেমন চাহিদা না থাকায় এবং কাঙ্খিত হারে রফতানি না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি হিমাগার মালিকদের।

এদিকে ইতিমধ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে, গত কয়েক বছর ৩৩টি হিমাগার বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আসন্ন মৌসুমে আলু চাষে কৃষকেরা নিরুৎসাহিত হতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হলে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,২০১৬ সালে দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৮০ লাখ টন। চলতি বছর ওই উৎপাদন এক কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। অথচ আলুর চাহিদা ও ব্যবহার মোটেও বাড়েনি। ফলে দেশের ৩৯০টি হিমাগারে এখনো অবিক্রীত রয়েছে ৪০ লাখ টন আলু। আর হিমাগারে আলু বিক্রির যে গতি, তাতে চলতি মৌসুমের বাকি ৪ মাস শেষে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন অবিক্রীত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে বিপুলসংখ্যক কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন হয় বলে আলু চাষে লাভ অপেক্ষাকৃত বেশি। প্রতি একর জমিতে যেখানে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মণ চাল উৎপন্ন হয়, সেখানে আলু উৎপন্ন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। ফলে গত কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা অধিক হারে আলু উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদনও হয়েছে ভালো। মুন্সিগঞ্জ এলাকায় আলুর বাম্পার উৎপাদনের কথা প্রচার থাকলেও, বর্তমানে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় আলুর উৎপাদন বেড়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম এবং এশিয়ায় তৃতীয়। তবে রফতানির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে দেশ থেকে আলু রফতানি হয়েছে মাত্র ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। রফতানিকারকদের কাছে আধুনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় আলু রফতানি অলাভজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ উঠেছে। পচনশীল পণ্য হওয়ায় উৎপাদন মৌসুমে আলুর উপযুক্ত দামও পাওয়া যায় না। আর কোল্ডস্টোরেজে আলু রাখতেও খরচ হয়, তুলনামূলক বেশি।

এদিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত কয়েক বছরে ৩৩টি হিমাগার বন্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ময়নামতি আইস অ্যান্ড কোল্ডস্টোরেজ, ১০ হাজার টন ক্ষমতার মধুমতি কোল্ডস্টোরেজ, সাড়ে ১০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার রণাঙ্গন কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেড এবং ৭ হাজার ৭০০ টন ক্ষমতার শাহ মাখদুম কোল্ডস্টোরেজ প্রভৃতি। ব্যাংক কর্তৃক হিমাগার নিলামে তোলার ঘোষণায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন পাকুন্দিয়ার পূর্বাচল হিমাগারের মালিক মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক ও লালমনিরহাটের তিস্তা হিমাগারের মালিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর কামরুল হাসান আজাদ। ব্যবসায় ব্যর্থতা ও হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন বগুড়ার আশরাফি কোল্ডস্টোরেজের মালিক আবদুল মালেক এবং লালমনিরহাটের লিমন কোল্ডস্টোরেজের মালিক মঈনুল ইসলাম খন্দকার।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে চালের সাথে হিমাগারে সংরক্ষিত এসব আলু বন্যাদুর্গত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে বিতরণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর সে দাবি আদায়ে এরইমধ্যে অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারা বলছেন, ত্রাণকার্যে আলু বিতরণ করা হলে, হিমাগারগুলোতে সংরক্ষিত আলু সময়মতো খালাস করা সম্ভব হবে। আর তাতে আলুচাষিরা উপকৃত হবেন। পাশাপাশি হিমাগার মালিকেরাও ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সমর্থ হবেন। তা করা না গেলে পরবর্তী বছর আলুর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোশাররফ হোসেন জানান, ২০১৭ সালে দেশে আলুর বাম্পার ফলন অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মেট্রিক টন আলু উৎপন্ন হয়েছে। আর দেশের ৩৯০টি হিমাগারে ৫৩ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে বাজারে শাক-সবজির দাম বেশি থাকা সত্ত্বেও হিমাগারে সংরক্ষিত আলু অন্যান্য বছরের তুলনায় অত্যন্ত কম পরিমাণে ও ধীরগতিতে নিন্মমূল্যে বাজারজাত হচ্ছে। এ পর্যন্ত সংরক্ষিত আলুর মাত্র ১০ শতাংশ বাজারজাত হয়েছে। আলুর দাম ও চাহিদা সবচেয়ে কম ও মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

বিগত এক মাস ধরে হিমাগারগুলো থেকে আলু অত্যন্ত ধীরগতিতে বাজারজাত হচ্ছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও উদ্বেগজনক। অথচ আলু বাজারজাতকরণের সময়কাল মাত্র ৪ মাস। এ অবস্থা অ  ব্যাহত থাকলে চলতি সালে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন আলু অবিক্রীত ও উদ্ধৃত্ত থেকে যাবে। অথচ কোল্ডস্টোরেজের মালিকেরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিজ নামে ঋণ নিয়ে সেখান থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। আলুর উপযুক্ত মূল্য পাওয়া না গেলে, কৃষক এ ঋণ শোধ করতে পারবে না। স্বাভাবিক কারণেই ব্যাংকিং সেক্টরেও পড়বে এর প্রভাব।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে/ ২৭ আগষ্ট ২০১৭