আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি পরিবারের সদস্যদের মতো : শিবু খান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব, কৈশোর ও রাজনৈতিক জীবনের অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত এই জনপদ। ঘটনাবহুল অনেক সোনালি দিন কেটেছে এখানে। শুধু শৈশব স্মৃতিই নয়, ছেলেবেলা লেখাপড়া করেছেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে। তাই, ছাত্র জীবনের কিছু সময়, ছাত্র রাজনীতির স্মৃতিময় বেশ কিছু দিন, রাজনীতির মাঠে, বন্ধুত্ব এবং আত্মীয়তার সুবাদে এই জনপদে তাঁর স্মৃতি রয়েছে নানা অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে।

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য থাকা তেমনি একজন হলেন আজিজুর রহমান শিবু খান। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমার চাচা আহম্মদ আলী খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমান সাহেব একত্রে চাকরি করতেন। তারা থাকতেন সরকারি কোয়ার্টারে। লক্ষীগঞ্জ আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপাড়ে। এখন সেসব নেই; পুরনো শহর নদীগর্ভে চলে গেছে অনেক আগেই। তখন ১৯৩৪-৩৫ সালের দিকে শেখ মুজিবুর রহমান মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে লেখাপড়া করতেন। সে সময় আমার চাচাতো ভাই অর্থাৎ চাচা আহম্মদ আলী খানের ছেলে মজিবর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। বঙ্গবন্ধু এক বা দুই বছর এখানে লেখাপড়া করেছেন। তারপরে গোপালগঞ্জ ও কলকাতায় লেখাপড়া করতেন। সেই সুবাদে আমাদের পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তারপর থেকে ছাত্র রাজনীতি, মূলধারার রাজনীতি। এক সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতি। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ হয়ে গেল।

তিনি বলেন, আমার বাবা আছমত আলী খান মাদারীপুর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর করেন। বাবা তখন মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ সময় মাদারীপুরে মহিষেরচরের লতিফ হাওলাদার একজন কাউন্সিলর। আমার বাবা লতিফ হাওলাদারকে ডেকে বললেন, লতিফ শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের নিতে হবে। তাকে মাদারীপুর থেকে কাউন্সিলর করে সম্মেলনে পাঠাতে হবে। তখন লতিফ হাওলাদার তার নাম প্রত্যাহার করে নেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কাউসিলর করে সম্মেলনে পাঠানো হয়।

ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তিনি মাদারীপুরের প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। সেই থেকে আমাদের পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কটা আরো গভীর হয়ে ওঠে। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যতবার আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ততোবার কাউন্সিলর হিসেবে বঙ্গবন্ধু নাম যেতো মাদারীপুর থেকে। বঙ্গবন্ধু আমার বাবাকে লিডার বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরকে নিজের জন্মভূমি মনে করতেন।

বঙ্গবন্ধু বহুবার মাদারীপুরে এসেছেন, মিটিং করেছেন, সাংগঠনিক কাজে কর্মীসভা করেছেন, আসতেন থাকতেন, আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করতেন। বিভিন্ন সময় আমরা তাঁর বাসায় গেছি এটা ওটা যেমন মাছ, ডাল, গুড় ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। আমরা বাসায় গেলে তাঁর স্ত্রী আমাদের ১০টাকা দিতেন। আমরা খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসতাম। বহুবার তাঁর বাসায় গেছি।

তিনি আরো বলেন, আমি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, একেবারে পরিবারের সদস্যদের মতো। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে কখনো আমাদের পরিবারের কোন বাধা ছিলো না।

স্বাধীনতার পরের ঘটনা আমার বড় ভাই শাজাহান খান জাসদ করতো। একবার অস্ত্রসহ গোপালগঞ্জে ধরা পরে। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব পাঠায় তুমি লেখাপড়া করতে ইংল্যান্ডে চলে যাও। বড় ভাই তখন সেন্ট্রাল জেলে। একবার আমি ও আম্মা বড় ভাইয়ের সাথে সেন্ট্রাল জেলে দেখা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। তিনি আম্মাকে দেখামাত্র বলেন, “কী শাজাহানের সঙ্গে দেখা করবেন? যান আমি বলে দিচ্ছি।” তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে দিলেন। “আমরা জেলখানায় ভিআইপি মর্যাদায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি।

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর এসে নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে জনসভা করেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে মাদারীপুর আসেন, মিটিং করেন, আমার চাচাতো ভাই বাদশা খানের চরমুগরিয়ার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করেন। তখন আমি আর আমার বড় ভাই শাজাহান খান কারাগারে। আমি শুনেছি বাদশা ভাইয়ের ঘরে ঢোকার সময় দরজার উপরের চৌকাঠে বঙ্গবন্ধুর মাথায় আঘাত লাগে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাদশা তুই খাটো বলে সবাইকে খাটো মনে করোস নাকি? আমরা তো লম্বা। ঘরের দরজা একটু লম্বা করিস।’

নাস্তা খাওয়ার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু লতিফ হাওলাদারকে দেখে বলেন, এই লতিফ ওখানে কি করোস এদিকে আয়-বলে কাছে ডাকলেন।

লতিফ হাওলাদারকে তিনি খুব বেশি স্নেহ করতেন। কারণ, লতিফ হাওলাদার তার নিজের কাউন্সিলর পদ প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কথা সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। ১৯৭৪ সালে লতিফ হাওলাদার গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু এই খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি তাঁর এই যে ভালোবাসা, তা বলে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে মাদারীপুরে আসেন, এটা ছিল তার শেষ আসা, এরপরে তিনি আর আসতে পারেননি। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান