কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে লড়ছেন জিন প্রকৌশলীরা

অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক প্রধান

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:

কোভিড-১৯ মহামারিতে সমগ্র বিশ্ব আজ আক্রান্ত। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের বিশ্ব জুড়ে প্রাদুভার্ব ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ ২১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এ রোগটিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আজ বিশ্বের সকল মানুষই এ রোগটিকে সবচেয়ে ভীতিকর রোগ হিসেবে ভয়ের মধ্যে কালাতিপাত করছে। উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ, সবারই অর্থনীতির চাকা মন্থর হয়ে পড়েছে। খাদ্য এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে, শিল্পপতি থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ এ যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য হিমসিম খাচ্ছেন। বিশ্ব জুড়ে গবেষকরা রূপ পরিবর্তনশীল এ ভাইরাসের ভ্যাকসিন অথবা ভাইরাস প্রতিরোধক এবং প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কারের জন্য অদম্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়া এ রোগটির উৎস যদিও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি তবুও প্রতিটি দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আক্রান্ত মানুষদেরকে আইসোলেশন এবং সুস্থ মানুষদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রেখে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:

বিশ্বের সাথে বাংলাদেশও এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪,৮৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৩,৪৪,২৬৪ জন ছাড়িয়ে গেছে (তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। বিশ্বে যখন করোনাভাইরাসে মৃত্যু হার ৩.১৫ শতাংশ (সূত্র: জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬/০৯/২০২০) সে তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যু হার ১.৪১ শতাংশ (সূত্র: corona.gov.bd, ১৬/০৯/২০২০)। মৃত্যু হার কিছুটা কম হলেও দেশ এখনও উচ্চ ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের চিকিৎসা সেবা অনেকটা অপ্রতুল কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সেবা কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সর্বস্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং অগাধ দেশপ্রেমের কারণে আমাদের দেশ এখনও এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিছুটা হলেও সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে। বলা চলে আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও সফল। সেবা খাতের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তা বিশ্বে বিরল ঘটনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার ৫০০ এর বেশি করোনা পরীক্ষা হচ্ছে এবং এ কাজে দেশের প্রায় ৯৫টি ল্যাবরেটরি জড়িত রয়েছে। উক্ত ল্যাবরেটরিগুলোতে দেশের তরুণদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বায়োটেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, মলিকিউলার বায়োলজিতে স্নাতক সম্পন্ন করে সরাসরি নিযুক্ত রয়েছেন।

শাবিপ্রবিতে ল্যাব স্থাপনের ইতিকথা:

এ বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আমাকে ফোন করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে কোভিড-১৯ ল্যাব স্থাপনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে জানতে চান। তিনি ফোনে আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রধান সাহেব, আজ সময় এসেছে ৭১-এর লড়াইয়ের মতো করোনা নির্ণয়ের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আমাদের ল্যাবের যে যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়ে যেভাবে হোক নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে করোনা নির্ণয় করব, ইনশা-আল্লাহ্। আপনাদের প্রস্তুতি কতটুকু?’ আমি জবাব দিয়েছিলাম, ‘এ যুদ্ধ যেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই আমরাও আমাদের যতটুকু সুবিধা রয়েছে তা নিয়ে এ লড়াইয়ে নেমে পড়ার জন্য তৈরি।’

আমি আমার বিভাগ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা কনিষ্ঠ চারজন শিক্ষক এবং আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডিতে গবেষণারত একজন ছাত্রকে নিয়ে একটা অন্যরকম লড়াইয়ে নেমে পড়লাম। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের মতোই আমরা প্রত্যয় নিলাম ‘আমাদের এবারের সংগ্রাম হবে অদৃশ্য মহামারিতে আক্রান্ত  জাতিকে সেবা দেয়ার সংগ্রাম।’

উপাচার্য মহোদয় পরবর্তীতে আমার বিভাগের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। করোনা যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ যন্ত্র আরটিপিসিআর আগে থেকেই থাকায় আমার জন্য সিন্ধান্ত গ্রহণ অনেকটাই সহজ হয়েছিল। আমার জিইবি বিভাগের বায়োটেক গ্রাজ্যুয়েট শিক্ষকদের অদম্য উৎসাহ সাহসে আমি আরও দৃঢ়তা পেলাম। উপরন্তু, আমার পিএইচডি ছাত্র আমার অনুমতি নিয়ে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের করোনা ল্যাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই ডাক্তারদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ ও ডাটা বিশ্লেষণের কাজ করে যাচ্ছিল।

আমি উপাচার্য মহোদয়কে সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং আলাদা ল্যাবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানোর পর পরবর্তীতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য সম্পূর্ণরূপে নতুন করে একটি ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মহোদয়ের সার্বিক দিক নির্দেশনায় আমার তত্ত্বাবধানে নিজস্ব অর্থায়নেই শুরু হলো পরিবেশ বান্ধব এবং সুরক্ষিত ল্যাব তৈরির কাজ এবং সাথে সাথে রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং সবচেয়ে জরুরি যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ। শত্রুর হানা ইতোমধ্যে চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ হয়ে উত্তর আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করেছে। সুতরাং এখন আর থেমে থাকার কোনো সুযোগ নেই। শুরু হলো দূর্বার প্রস্তুতি, জাতির জনক যেভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল’, ঠিক সেভাবেই লকডাউনের মতো পরিবেশে ল্যাব স্থাপনের মতো কাজ হাতে নেয়া। কিন্তু আমরা বায়োসেইফটি ক্যাবিনেট এবং নতুন আরটিপিসিআর মেশিন সংগ্রহ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি। একটি কোম্পানী দুই সপ্তাহ পরে এনে দিতে পারবে বললেও পুরো দেশ এবং বিশ্ব জুড়ে লকডাউন পরিস্থিতি, আর্ন্তজাতিক ফ্লাইট ও সমুদ্র বন্দর বন্ধ থাকায় কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয়। এসময় উপাচার্য মহোদয় সর্বাক্ষণিক আমাদের পাশে থেকে সরকারের উচ্চ মহলে কথা বলে যন্ত্র দুটি দেশে আনা ও বন্দর হতে খালাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, আমার বিভাগে যে আরটিপিসিআর যন্ত্রটি ছিল সেটি সরকার প্রদত্ত করোনা শনাক্তকরণ কিটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অধিকন্তু, পূর্বের যন্ত্রে একসাথে মাত্র ৪৬টি নমুনা পরীক্ষা করা যেত, যা যথেষ্ট ছিল না। সুতরাং আমরা নতুন করে আরও একটি আরটিপিসিআর মেশিন ক্রয় করি। এভাবে কঠিন এই মুহূর্তগুলো পেরিয়ে প্রায় এক মাস হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সেন্টার ফর ডিজেজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইউএসএ) এর বায়োসেইফটি-২ নীতিমালা অনুসরণ করে বিশ্ব মানের সুরক্ষিত পিসিআর ল্যাবটি গড়ে তোলা হয়। সাথে সাথে ১৯ জনের একটি দলকে প্রায় দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দিয়ে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। অবশেষে গত ১৮ মে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেন এবং ২০ মে থেকে নমুনা পরীক্ষার কাজ শুরু হয়।

প্রথম থেকেই সিলেট জেলার এবং পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বর্তমানে পুরো সিলেট বিভাগের নমুনা শনাক্তকরণের কাজ চলছে। নমুনা পরীক্ষার এই সকাল-সন্ধ্যা কার্যক্রম কোনো রকম ছুটি ছাড়াই আজ পর্যন্ত চলছে। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখলাম ঈদের দিনেও আমার সৈনিকরা কোনো রকম মনের খেদ ছাড়াই শনাক্তকরণ কাজ চালিয়ে গেছেন। ঈদের দিন যেখানে লকডাউনে ঘর বন্দী মানুষ আনন্দ করছে সেখানে আমার জিন প্রকৌশলী লড়াকু সৈনিকরা ল্যাবের ভেতর থেকে প্রিয়জনকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। যদিও ঈদের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে ছোট পরিসরে সাদামাটা ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল কিস্তু তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত ছিল না। তারা যখন ল্যাব থেকে ফিরে ডাইনিংয়ে আসছিল তখন তাদের এক একজনকে রণক্লান্ত সৈনিক মনে হয়েছে। আমার সবচেয়ে মনে কষ্ট হয়েছে এই ভেবে যে আজ এ ছেলেগুলো বাবা মায়ের সাথে ঈদ উদযাপন করতো, কিন্তু দেশের এ ক্রান্তিকালে তারা হাসিমুখে ঈদের আনন্দও বিসর্জন দিয়েছে। কোভিড-১৯ রণক্ষেত্রের সম্মুখ সমরে রয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিইবি বিভাগের ৬ জন শিক্ষক, বিএমবি বিভাগের একজন শিক্ষক, জিইবি বিভাগের ১৯ জন ছাত্র এবং দুই জন ল্যাব সহকারী স্বেচ্চাশ্রমের ভিত্তিতে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

জীব প্রযুক্তিবিদ, গবেষণা ও রোগ নির্ণয়:

একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয়ে থাকে বায়োটেকনোলজির বা জীব প্রযুক্তির শতাব্দী। এ শতাব্দীর সবচেয়ে অ্যাডভান্স বিষয় হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি। এ বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা (যারা জীব প্রযুক্তিবিদ নামেই বেশি পরিচিত) শুধুমাত্র তারাই শাবিপ্রবির কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের বিশেষায়িত ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছেন, যেখানে অন্যান্য কোভিড-১৯ ল্যাবে সম্মিলিতভাবে অনুজীব বিজ্ঞানী, প্রাণ রসায়নবিদ ও জীবপ্রযুক্তিবিদরা জড়িত। এটাই সবচেয়ে সুখকর বিষয় যে দেশের ক্রান্তিকালে জীব প্রযুক্তিবীদরা কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে অনন্য ভুমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের দক্ষ গ্রাজুয়েটরা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুরু থেকেই কাজ করে আসছেন। এছাড়াও সিলেট সিএমএইচ, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবে জীব ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও স্বশরীরে উপস্থিত থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে।

সম্প্রতি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সীমান্তিক হাসপাতালের পর্যবেক্ষণ দল আমার বিভাগের ল্যাব পরিদর্শনে এসে অভিভূত হয় এবং তাদের অনুরোধে জিইবি বিভাগের একটি দল তাদের ল্যাব স্থাপনে সরাসরি সহযোগিতা করেছে এবং এ সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তীতে তারা জিইবির একজন প্রশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটকে ল্যাব ইনচার্জ হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন। আমি আশাবাদী কোভিড-১৯ রনক্ষেত্রের বীর যোদ্ধাদের এ শ্রম বৃথা যাবেনা, তারা নিরাশা ও হতাশায় ভুগবেনা, তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবে।

এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ২২ হাজারেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলের (সুনামগঞ্জ) মানুষের প্রায় সকল নমুনা আমরা পরীক্ষা করেছি। বস্তুত, নমুনার জট এড়ানোর জন্য এবং রোগীদের দুর্দশা তথা মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা একদিনে প্রায় ৪৬৮টি নমুনার পরীক্ষা করেছি যা একদিনের হিসেবে সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি। কারণ নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশনে যাওয়া অতীব জরুরি কিন্তু কোভিড-১৯ নির্ণয়ের দীঘসূত্রতার কারণে যাতে মানুষের হতাশা না বাড়ে ও রোগ ছড়ানোর মাধ্যম না হয় এটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা একদিনে সর্বোচ্চ ৫টি সাইকেল/রান দিয়েছি। সারা দেশের সবার কাছে জীব প্রযুক্তিবিদদের এই অবদান প্রশংসিত হয়েছে এবং ইউজিসির সভায় ও শাবির সিন্ডিকেট সভায় ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়েছে।

গত ১৬ জুন সারা দেশের জীব ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিভাগগুলোর বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মহামারি করোনা মোকাবিলার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বায়োটেক গ্রাজুয়েটদের বিপুল উদ্যম এবং তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করা হয়। আমার বিভাগের গ্রাজুয়েটদের নিরলস পরিশ্রম ও উদ্যম চেষ্টা দেখে কবির কবিতার ওই লাইনটি মনে পড়ে, ‘সহস্তে রোপিত তরু পল্লবিত কুসুমিত দেখি, কি আনন্দ তাহা অন্যে বুঝিবে কি?’

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিষয়টি সারা দেশের ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় এবং প্রতি বছর প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, দেশের সবচাইতে মেধাবীরা প্রতি বছর এই বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু যাত্রা শুরুর প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও এই বিষয়ের গ্রাজুয়েটরা চাকরি ও গবেষণায় নিজেদের প্রতিভা পরিস্ফুটনের কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। অপার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হলেও দেশে জীব প্রযুক্তির এই শাখাটির বিকাশ মেলেনি। কৃষি বিজ্ঞান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের বিষয়ে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার কথা তারা আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য শক্তির সাথে লড়াই করে চলছে। সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনে প্রায়শ এমন সব যোগ্যতা চাওয়া হয় যা বায়োটেক গ্রাজুয়েটদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভবপর নয়। এমনকি বিভিন্ন জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি ডিভিশনে এই বিষয়ের গ্রাজুয়েটদের নিয়োগ দেয়া হয় না কিন্তু মলিকিউলার বায়োলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্টরা ঠিকই সুযোগ পায়। অথচ বায়োটেক গ্র্যাজুয়েটরা এই দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত জীন প্রকৌশল বিষয়ে (সর্বাধিক আধুনিক টেকনিক) সিদ্ধহস্ত। তরুণরা লেখাপড়ার শেষ পর্যায়ে নিত্য নতুন বিধি-নিষেধের দেয়ালে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে প্রতিবছর হতাশাগ্রস্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং পরবর্তীতে সেখানেই স্থিত হয়ে যান।

যাদেরকে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ভাবা হয় তারা ঠিকই তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য একটি জাতিকে সেবা দিচ্ছে, ওই দেশের উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে চলছে। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা নয়, যেখানে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় পাঁচ শতাধিক জীব প্রযুক্তিবিদ তৈরি করছে। আমার বিভাগের প্রায় শতাধিক গ্রাজুয়েট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তারা প্রত্যেকেই তাদের গবেষণার ফলাফলগুলো অনেক ভালো জার্নালে প্রকাশ করেছে। শিক্ষক হিসাবে যখন তাদের অর্জনের কথা শুনি তখন গর্ববোধ করি। মনের কোণে আক্ষেপও জমা হয় কারণ দেশ মাতৃকার সেবায় তাদের কাজে লাগাতে পারছি না।

উপসংহার:

আমরা জানি বিশ্বের শক্তিধর অনেক রাষ্ট্রই শত শত পারমাণবিক অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ রেখেছে। ৯০-এর দশকে ইরাক ইরানের যুদ্ধে ব্যাপক আলোচ্য বিষয় ছিলো জীবাণু অস্ত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ সমগ্র বিশ্ব প্রাকৃতিকভাবে জীবাণু অস্ত্র কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও স্থলভাগে আক্রান্তের মাত্রা এত বেশি যে তারা নিজেদের পারমাণবিক বোমায় সজ্জিত রণতরীকেও তীরে আসতে দিচ্ছে না। আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকা থেকে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছি। দেশের অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সীমিত সামর্থ্য নিয়েও আমাদের এই অগ্রযাত্রার মূল কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যিনি তার সুদক্ষ হাতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একই সাথে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরে গর্বিত এবং শাবির উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ মহোদয়কে শাবির জিইবি বিভাগকে নির্বাচনের জন্য অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই মহামারিসহ পরবর্তীতে দেশের উন্নয়নে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বায়োটেকনোলজিস্টদের কাজে লাগাবেন এই প্রত্যাশা করছি।

(লেখকঃ বিভাগীয় প্রধান এবং টিম লিডার, কোভিড-১৯ সনাক্তকরণ টিম, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।)