গর্ভকালীন সময়ে নারীকে ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’ বিষয়ে সচেতন হতে হবে

শায়লা শারমিন, ৩৫, সাত মাসের গর্ভবতী। চিন্তিত মুখে হাসপাতাল থেকে বের হন এবং বলেন, ‘এতদিন শরীর খারাপ লাগতো না বলে ডাক্তারের কাছে যাইনি। শুধু পাঁচ মাসের সময় একবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিলাম। ওখানে বলেছিলো কোনো সমস্যা নেই। ভেবেছিলাম যেহেতু সমস্যা নেই, তাই আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাইনি। ভুল হয়েছে। এখন শুনছি, বাচ্চা নিয়ম অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়নি এবং আমার ব্লাড সুগার বেড়েছে। আগে চেকআপ করালে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ সমস্যা হতো না।’

চিকিৎসকরা বলছেন, শায়লার মতো অনেকেই এখনো গর্ভকালীন সময়ে ‘অ্যানটেনেটাল কেয়ার’ (এএনসি) বা ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’-এর বিষয়ে সচেতন নন বা গুরুত্ব দেন না। এতে অনেক অঘটন ঘটে থাকে। এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন।

‘বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মরটালিটি এন্ড হেলথকেয়ার সার্ভের (বিএমএমএস)-এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘বাংলাদেশে শতকরা ৩৭ ভাগ নারী চারবার প্রসবপূর্ব চেকআপ করান।’ ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বলছে, ‘একজন গর্ভবতী মা তার গর্ভকালীন সময়ে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে আটটি ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’ করাবেন।’ সংস্থাটি সম্প্রতি ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’কে মানবাধিকারের বিষয়ের সাথে অন্তর্ভূক্ত করেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা দেওয়ান জানান, আটটি সম্ভব না হলে কমপক্ষে চারটি চেকআপ করানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি বলেন, ‘পিরিয়ড মিস করার সময় থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে একটি, ২৪-২৮ সপ্তাহের মধ্যে একটি, ৩২-৩৪ সপ্তাহের মধ্যে একটি এবং প্রসবের পূর্বে একটিসহ মোট ৪টি চেকআপ অবশ্যই করাতে হবে। এতে আমরা মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো খেয়াল করি এবং ঝুঁকি আছে কিনা তা দেখে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। ভ্রুণের হার্টবিট ঠিক আছে কিনা, ভ্রুণ ঠিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা-এ বিষয়গুলো নিয়মিত মনিটরিং করা অত্যন্ত জরুরি। এতে ভ্রুণের তিন, পাঁচ বা সাত মাসের সময় যে রকম গঠণ ও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তা যদি না পায় তাহলে চিকিৎসকরা ব্যবস্থা নিতে পারেন।’

ডা. ফারহানা আরো বলেন, ‘অনেক সময় ভ্রুণ জরায়ুতে না থেকে ডিম্বাশয়ে থাকতে পারে। ডিম্বাশয় তার থাকার জায়গা নয়। তাই সেখানে ভ্রুণ বাড়তে পারে না। এ রকম হলে ডিম্বাশয় ফেটে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। অনেক সময় জরায়ুতে কোনো ত্রুটি বা ফাটা থাকতে পারে।

আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে এগুলো শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যায়। মায়ের ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, উচ্চ রক্তচাপ এমনকি ইনফেকশনও থাকতে পারে। চেকআপের মাধ্যমে এগুলো জানা সম্ভব। মা ভালো আছেন, তার কোনো সমস্যা নেই- এসব গুরুত্ব দেয়া ঠিক নয়। এতে অনেক অঘটন ঘটে।’

এই অঘটন যাতে না ঘটে সেজন্য সরকার বদ্ধ পরিকর। এ কারণে গ্রাম পর্যায়েও রয়েছে নানা পদক্ষেপ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম বলেন, ‘মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতকের মৃত্যু ও জটিলতা কমাতে সরকার প্রসবপূর্ব চেকআপের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য জেলা, থানা এমনকি কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়েও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যেক হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ কর্ণার’ নামে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা রয়েছে। যেখানে গর্ভবতী মায়েরা সেবা পান। সেখানে চিকিৎসক, প্রশিক্ষত নার্স, মিডওয়াইফ বা স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ না করালে মা ও শিশুর ঝুঁকিগুলো চিহিৃত হয় না। এতে মা ও শিশুর যেমন মৃত্যুঝুঁকি থাকে, তেমনি মাতৃমৃত্যু এবং মৃতশিশু জন্মানোর হারও বৃদ্ধি পায়। এজন্য এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।’

সচেতন না হলে শিশু নানা জটিলতা নিয়ে জন্মাতে পারে বলে জানান আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল এন্ড হাসপাতাল-এর শিশু বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. কুন্তল রায়। তিনি বলেন, ‘মা যদি ঠিকভাবে ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’ না করান বা নিয়মগুলো মেনে না চলেন তাহলে তার প্রি-ম্যাচিউর শিশু জন্মায় কিংবা পরে শিশুর নানা সমস্যা দেখা যায়। এতে শিশুর ধুনষ্টংঙ্কারসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে মার যদি ডায়াবেটিস ডায়াগনোসিস না হয় বা তার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে তাহলে পরবর্তীতে শিশুর খিঁচুনি হতে পারে, ব্লাড সুগার কমে যেতে পারে। এমনকি শিশু নানা জন্মগত ত্রুটি নিয়েও জন্মায়। যেমন হার্টের ফুঁটা ইত্যাদি থাকতে পারে।’

যেখানে মা ও শিশুর সুরক্ষার জন্য সরকার সব ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং স্বাস্থ্যসেবা সকলের জন্য সহজলভ্য করেছেন সেখানে অবহেলা বা অজ্ঞতা নয়, সচেতনতার মাধ্যমে তা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। তাহলেই বাঁচবে জীবন এবং স্বাস্থ্যকর হবে আমাদের ভবিষ্যৎ- এমনই প্রত্যাশা চিকিৎসকদের। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান