চালের মূল্য স্থিতিতে চাই লাভজনক ধান চাষ

চালের মূল্য স্থিতি রাখতে চাই লাভজনক ধান চাষ। কৃষক ধান উৎপাদন করে লাভজনক হলেই চালের দাম স্থিতি থাকবে। কৃষককে চালের ন্যায্য মূল্য পেতে হবে। কৃষক ন্যায্য মূল্যে চাল বিক্রি করার জন্য যদি চালের মূল্য কিছুটা বৃদ্বি পায়, তাহলে সেটাকেও ইতিবাচক ভাবেই দেখা উচিত। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করলে, কৃষককে কম দামে চাল বিক্রি করতে হবে, ফলে চাল বা ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন কৃষক। তাই কৃষক লাভজনক মূল্যে চাল বিক্রি করতে পারলে, চাল উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আলোচিত বিষয় চালের বাজারে সংকট এবং মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে খেলামেলা নানা বিষয়ে আজকের বাজারের সঙ্গে কথা বলেন দেশের এগ্রিবিজনেসের অন্যতম পরিচিত মুখ ও এসিআই এগ্রিবিজনেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এফ এইচ আনসারী। এছাড়া লাভজনক চাল উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এস এম জাকির হোসাইন।

ড. এফ এইচ আনসারী বলেন, কৃষকের নিজস্ব উৎপাদিত ফসল ধান উৎপাদন করে যদি কৃষক লাভবান হয় তাহলে কৃষক ধান চাষে উৎসাহিত হবে এবং ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন করবে। যদি কম দামে চাল বিক্রি করতে হয় তাহলে কৃষক চাল উৎপাদন কমিয়ে দিবে এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদন করবে। কারন কৃষক যখন দেখবে চিংড়ি চাষে লাভবান হওয়া যায়, সবজি চাষে অধিক লাভবান হওয়া যায় তখন চাল উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দিবে। এইসব পরিস্থিতির ফলে এক সময় বিদেশ থেকে বেশি দামে চাল আমদানি করতে হবে। কারন আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত আর তাই ভাতের জন্য তখন বেশি দামে চাল আমদানি করতে হবে।
চালের মূল্য বৃদ্বি পেলে কৃষক সেই সুবিধা কতটুকু ভোগ করতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টার প্রকৃত কোন পরিসংখ্যান নেই গবেষণা করে দেখতে হবে আসলে আমার মনে হয় সবসময় কথাটা সত্যি নয়। কারন আমাদের দেশে যা ধান উৎপাদন হয় তার মাত্র ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ টন সরকারিভাবে ধান মজুত করার ব্যবস্থা আছে। বাকি ধান মজুদ করার কৃষকের নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই ফলে বেসরকারি ভাবে মিলারের কাছে কৃষক ধান মজুদ রাখে এবং যখন প্রয়োজন হয় তখন বাজার দর অনুযায়ী মিলার থেকে টাকা বুঝে নেয়। আসলে আমার ধারনা হয়তো অল্প কিছু সংখক লোক যারা ব্যবসা করে তারা কেউ মজুদ করতে পারে লাভবান হওয়ার জন্য সেটা অন্য আলোচনার বিষয়, কারন সেটা আমাদের দেশের আইন সাপোর্ট করে কি করেনা সেটা দেখতে হবে। ঢালাওভাবে প্রায় বলতে শুনি মধ্যসোক্তাভুগি বা এক শ্রেনির মানুষ অথবা মিলাররা চাল আটকে রেখে চালের দাম বাড়িয়ে দেয় আসলে আমাদের এই একে অপরের দোষারপ এই বিষয়টার সুরাহা না করতে পারলে এর ফল হবে কখনো দাম বাড়বে আবার কখনো দাম কমবে। কৃষককে চাল উৎপাদনে লাভবান করতে হলে বিষয়টাকে সুরাহা করতে হবে এবং এই সংক্রান্ত আইন-কানুন ঠিক করতে হবে। তবে বাজারে চালের দাম স্থিতি থাকবে।

কৃষককে লাভবান করতে এসিআই এগ্রিবিজনেসের ভুমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. আনসারী বলেন,সবসময়ই বলি কৃষককে লাভবান করতে হবে, কিন্তু কিভাবে ? কৃষকের উৎপাদন বাড়লে খরচ কমে যাবে। ফলে লাভ হবে তার বেশি। যদি ম্যানুয়ালি ১ কেজি চাল উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ২৭ টাকা আর যান্ত্রিক ব্যবহার হলে, মেশিনে ধান রোপণ করে, মেশিনে ধান কাটে তাতে প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ কমে যাবে।সরকার ফার্ম মেকানাইজ পদ্বতি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে কৃষককে ভর্তুকি দিচ্ছে,এটা অনেক উৎসাহের ব্যাপার কিন্তু এটার পরিমাণ খুব বেশি না। পরিমাণ বাড়ানো দরকার।আমাদের সারের উপর যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তার থেকে কমিয়ে ফার্ম মেকানাইজে যদি ভর্তুকি বাড়ানো হয় তাহলে উৎপাদন খরচ অনেক কমবে। তখন কম দামে চাল বিক্রি করেও কৃষক লাভবান হবে ক্রেতাও চাল কম দামে কিনতে পারবে।

কৃষিতে আমাদের দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে জবাবে ড. আনসারী বলেন, আমরা এসিআই ২টা ক্ষেত্রেই ব্যাপক কাজ করছি, ভালো বীজ উৎপাদনে গত ৩ বছরে মেসিভ আকারে কাজ করছি যা ইউএসএআইডি আইআরআই আমাদের সাপোর্ট করছে ।

তিনি আরও বলেন, যৌথভাবে ইউএসআইডি এবং এসিআই যে কাজ করছি তা করতে পারলে ৪ টন থেকে ৭ টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তার মানে একই খরচে অধিক উৎপাদন করা যাবে। ফলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে, সাথে সাথে ফার্ম মেকানাইজের জন্য আমরা কৃষককে ট্রাক্টর দিচ্ছি, পাওয়ার টিলার দিচ্ছি, ধান রোপণ করার যন্ত্র দিচ্ছি, ধান কাটার যন্ত্র দিচ্ছি, যেসব যন্ত্র দিচ্ছি সেগুলো আমাদের দেশের মাটির উপযোগী, অন্যান্য পাওয়ারটিলারের তুলনায় আমাদের গুলো দ্বিগুণ কাজ করে এগুলো ব্যাবহারে অল্প সময়ে অধিক লাভবান হওয়া যায়।

ড. আনসারী বলেন, কৃষককে সমৃদ্বশালী করতে হলে কৃষিকে লাভজনক করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। কারন সরকারের এটা এসডিজি গোলের ও একটা অংশ। বেশি উতপাদনশীল বীজ লাগবে, বর্তমানে বাংলাদেশে ধানের যে উৎপাদন তা প্রায় ৪ টন। কিন্তু এটাকে ৬ থেকে ৭ টনে নেয়া সম্ভব। যেটা ভিয়েতনামে এবং চীন করেছে। এটা করতে হলে ভালো বীজ এবং অনেক গবেষণা লাগবে, অনেক অর্থ দরকার। সাথে যদি মেকানিক্যাল পদ্বতি ব্যবহার করা যায় তাহলে ২টা ইনিসিয়েটিভ একসাথে নেয়া গেলে আমাদের চাল উৎপাদন খরচ ১৫ টাকায় চলে আসবে।তাহলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং কৃষকের আয়ও বেড়ে যাবে।

ফাইন গ্রেনের নামে কি খাওয়ানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষ খায় পুষ্টির জন্য, আমরা বাজারে গিয়ে যেই চাল চিকন, পরিষ্কার এবং ছোট দেখি সেটাই কিনি। আসলে আজকাল মিল গুলো বড় ধানকে কেটে ছোট করার পদ্বতি থাকায় চালের প্রায় ৭০ ভাগ কেটে চিকন করতে পারে। ফলে চালে পর্যাপ্ত নিউট্রিয়েশন থাকে না। বেশি দামে বিক্রির জন্য মিল গুলো এই অন্যায় কাজ করে থাকে, যার ফলে চাল থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তাই এইসব চাল না কিনার পরামর্শ দেন ড. আনসারী ।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিৎ যারা এরকম কাজের সাথে জড়িত তাদের মিল বন্ধ করা সহ তাদের বিরুদ্বে শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিৎ।

ড. এফ এইচ আনসারী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) 

এসিআই এগ্রিবিজনেস লিমিটেড