ডায়াবেটিস রোগীর ডেঙ্গি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ

বাংলাদেশ গত ৩ দশকের মধ্যে এ মৌসুমে ডেঙ্গির মারাত্নক প্রাদুরভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গি জ্বরের প্রকোপ অতীতে যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি।
১১ আগস্ট ২০১৯ সরকারি হিসবে শুধু ধাকাতেই ৯৮১ জন এবং ঢাকার বাইরে ১,৩৫৩ জন ডেঙ্গি রোগী ভর্তি হয়েছেন; সারা দেশে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৪০ জন (বেসরকারি হিসেব মতে ১২৪) মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের মধ্যে চিকিৎসকও আছেন। স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গি জ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

গত বছর পর্যন্ত বিশেষজ্ঞগণের ধারণা ছিল এটি শহরের, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ঢাকার একটি মশাবাহিত রোগ। কিন্তু এবার ডেঙ্গি সারা বাংলাদেশের মারাত্নক রোগ। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী প্রায় সকল দেশের মানুষের জন্য এবার ডেঙ্গি চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

সকল বয়সের পুরুশ-মহিলাই ডেঙ্গির ঝুঁকিতে আছেন। তবে, মৃত্যু ঝুঁকি বিবেচনা করলে, শিশুরাই সবচে’ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যে ক’জন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন, শিশুদের সংখ্যা এতে উপরের দিকে।

আর যারা ইতোমধ্যে অন্য কোন রোগে ভোগছেন, তাদের ডেঙ্গি জ্বর হলে মারাত্নক শারীরিক অবস্থা হবার সম্ভাবনা থাকে। এ তালিকায় রয়েছে ডায়াবেটিস, কিডনি ফেইলুর, হার্ট ফেইলুর ইত্যাদি। গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গি জ্বর মা ও গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জন্যেই ভয়াবহ হতে পারে।

বাংলাদেশে ১ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে ভোগছেন, যাদের কমপক্ষে ৩০% আবার কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস রোগীর গ্লুকোজের কারণে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, পানি শুন্যতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যাদের ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ ভালো নয় (রক্তের গ্লুকোজ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে বেশি) তাদের ডেঙ্গি জ্বর হলে ক্ষতির তীব্রতা বেড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।

ডেঙ্গি রোগের মৃত্যুর কারণ প্রধানত ডেঙ্গি শক সিন্ড্রোম (ডিএসএস)-এর জন্যে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষণা এটি নিশ্চিত করেছে যে, ডায়াবেটিসের রোগী ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গি শক সিন্ড্রোম হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এদের মাঝে মৃত্যু হারও অনেক বেশি।

ডেঙ্গিতে জ্বরে সংক্রমন হলে রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট)-এর সংখ্যা কমে যেতে থাকে। অন্য অনেক জ্বরেও রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কমে যেতে পারে; কিন্তু ডায়াবেটিসের রোগী ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত হলে তার রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) দ্রুত কমতে থাকে এবং শরীরের ভিতরে ও বাইরে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

ডেঙ্গি জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গি ভাইরাসের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে হয়ে থাকে। ডেঙ্গি জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত হয়।

লক্ষণ – ডেঙ্গি জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচ দিনের সময় সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। এই অবস্থাটা যেকোনো সময় জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন অন্য সমস্যার পাশাপাশি যদি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন: চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে ও চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে।

মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেক দিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি হতে পারে। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসা যথেষ্ট। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।

যেমন:

* শরীরের যেকোনো অংশে রক্তপাত হলে

* প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে

* শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি এলে

* প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে

* জন্ডিস দেখা দিলে

* অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে

* প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।

প্রতিরোধ

ডেঙ্গি জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গি প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

* বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

* যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।

* ঘরের বাথরুমে বা কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।

* এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য কোনো সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীরে ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।

* দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।

* বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফ প্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে।

* মশা নিধনের স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে।

* ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে কোনো মশা কামড়াতে না পারে।

* ডেঙ্গি জ্বরের মশাটি এ দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে। মশা প্রজননের ও বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
ফোন: ০১৯১৯০০০০২২