তারেক-মিশুক নিহতের মামলায় বাসচালকের যাবজ্জীবন

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের মামলায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে আদালত ওই চালককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিচারক। তবে রায় ঘোষণার সময় আদালতে নিহতদের পরিবারের কোনো লোকজন উপস্থিত ছিলেন না।

বুধবার মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল মাহমুদ ফাইজুল কবীর এ রায় ঘোষণা করেন। এ সময় আসামি জামির হোসেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের মোট ২৪ জন এবং আসামিপক্ষের দুজন সাফাই সাক্ষী গ্রহণ সম্পন্ন করেছেন আদালত।

এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি রবিবার দুপুরে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল মাহমুদ ফায়জুল কবিরের আদালতে যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার দিন ২২ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। এদিন আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক বাসচালক জামির হোসেনের জামিন বহাল রাখেন।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, মাইক্রোবাস চালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন নিহত হন। এ সময় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক আহত হন।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বাসচালক জামির হোসেনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেন ঘিওর থানার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই লুৎফর রহমান। এ ঘটনায় ঘিওর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফর রহমান মামলা করেন। এরপর অভিযান চালিয়ে বাসচালক জামির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর সিআরমসি ৫২৫/১১ জেলা ও দায়রা জজকোর্ট থেকে ওই চালক জামিনে ছাড়া পান।

এরপর তদন্ত শেষে ঘিওর থানার তৎকালীন ওসি আশরাফ উল ইসলাম ২০১২ সালের ২১ মার্চ চালককে অভিযুক্ত করে ২৭৯/৩৩৭/৩৩৮(ক)/৩০৪ ধারায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আর একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের শুনানি করা হয়।

২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ধার্য করা সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম দিনে জেলা ও দায়রা জজ এ কে এম মোস্তফা দেওয়ানের আদালতে অভিযোগকারী ঘিওর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফর রহমানের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য গ্রহণের দিনে মানিকগঞ্জ সহকারী জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ রফিকুল ইসলামের আদালতে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

এরপর কয়েকটি কার্যদিবসে আরও আটজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন বিচারিক আদালত। আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে কৌঁসলি হিসেবে অভিযোগকারীর পক্ষে পিপি এ কে এম নুরুল হুদা রুবেল, এপিপি আফছারুল ইসলাম মনি ও আজাহারুল ইসলাম আরজু এবং আসামি পক্ষে মাধব সাহা উপস্থিত ছিলেন।

তারপর থেকে মানিকগঞ্জ অতিরিক্ত দায়রা ও জেলা জজ আব্দুল্লাহ আল-মামুন ফয়জুল কবীরের আদালতে এই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা হয়। সাক্ষ্যদাতারা হলেন- ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ফায়ারম্যান মো. কামাল হোসেন ও তৎকালীন গাড়ি চালক মোতালেব হোসেন।

আলোচিত এই মামলায় ৩৯ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হলো। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালতে জামিনে থাকা আসামি বাসচালক জামির হোসেন হাজির ছিলেন।

মামলা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শালজানা গ্রামে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তার নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’-এর শুটিং লোকেশন নির্বাচনের জন্য আসেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের সিইও মিশুক মুনীর, অধ্যাপক ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলিসহ নয়জন।

ঢাকা ফেরার পথে সাড়ে ১২টার দিকে জোকায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-০৩০২) সঙ্গে বিপরীতমুখী চুয়াডাঙ্গাগামী বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪২৮৮) মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ, মিশুক মুনিরসহ মাইক্রোবাস চালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন নিহত হন। আর গুরুতর আহত হন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, অধ্যাপক ঢালী আল-মামুন ও তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি একেএম নুরুল হুদা রুবেল জানান, পাঁচ সাক্ষী আদালতে হাজির হওয়ার কথা থাকলেও ওই তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অপর দুই সাক্ষীর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সহ-যান্ত্রিক কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মারা গেছেন। আর অনুপস্থিত ছিলেন স্কয়ার হাসপাতালের ডা. সানোয়ার হোসেন।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে ভাস্কর্য : সড়ক নিরাপত্তায় সচেতনতা বাড়াতে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরের স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।

সুত্র: দ্য রিপোর্ট