দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ঐতিহাসিক জয় বাংলাদেশের

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবারের মত  ম্যাচ জয়ের ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

গতরাতে তিন ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে  বাংলাদেশ ৩৮ রানে হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ঐতিহাসিক এই জয়ে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৯ ম্যাচ খেলেও কোন জয় পায়নি টাইগাররা। ২০তম ম্যাচে এসে অবশেষে অধরা জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে লিটন দাস-সাকিব আল হাসান ও ইয়াসির আলির হাফ-সেঞ্চুরিতে ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ৩১৪ রান করে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে  ক্রিকেটে  এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলীয় রান বাংলাদেশের। জবাবে প্রোটিয়াদের ২৭৬ রানে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশের বোলাররা।

এই জয়ে বিশ^কাপ সুপার লিগের টেবিলে ১৬ ম্যাচে অংশ নিয়ে ১১ জয় ও ৫ হারে ১১০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষেই থাকলো বাংলাদেশ। আর ১১ ম্যাচে ৩ জয়, ৬ হার ও ২টি পরিত্যক্ত ম্যাচের কারনে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের দশম স্থানে দক্ষিণ আফ্রিকা।

সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্কে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। দলকে দারুন সূচনা এনে দেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। ২১ দশমিক ৩ ওভার ব্যাট করে ৯৫ রানের জুটি করেন তারা। তবে শুরুটা সাবধানী ছিলো তামিম-লিটনের। ৯১ বল খেলে দলের স্কোর ৫০ স্পর্শ করেন তারা। ১৯তম ওভারে স্পিনার কেশব মহারাজের বলে ১টি ছক্কা ও ২টি চারে ১৬ রান  নেন লিটন।

২২তম ওভারে তামিমের আউটে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গেন স্বাগতিক পেসার আন্দিলে ফেলুকুওয়া।  লেগ বিফোর হওয়ার আগে  ৬৭ বল খেলে ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪১ রান করেন তামিম। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে লিটন-তামিম যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ ৯৫ রান যোগ করেন।

তামিমের আউটের পর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন লিটন। হাফ সেঞ্চুরির পুর্ন হওয়ার  পরের ডেলিভারিতে মহারাজের বলে বোল্ড হন লিটন। ৬৭ বল খেলে ৫০ রান করেন তিনি। ৫টি চার ও ১টি ছক্কায় নিজের ইনিংসটি সাজান লিটন।

চার নম্বরে নামা মুশফিকুর রহিম, ব্যাট হাতে সুবিধা করতে পারেননি। ১২ বলে ৯ রান করেন তিনি।

দলীয় ১২৪ রানে মুশফিক ফেরার পর দলের রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন সাকিব আল হাসান ও ইয়াসির আলি। উইকেটে সেট হয়ে দ্রুত রান তুলেছেন তারা। ৩৮তম ওভারের শেষ বলে ছক্কা মেরে হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন সাকিব। ৫০তম হাফ-সেঞ্চুরি করতে ৫০ বলই খেলেন সাকিব।

হাফ-সেঞ্চুরির পর মারমুখী হয়ে উঠেন সাকিব। পরের ১৪ বল থেকে ২৭ রান তুলেন তিনি। ব্যক্তিগত ৭৭ রানে সাকিবকে থামান লুঙ্গি এনগিডি। আউট হওয়ার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে  সর্বোচ্চ  ব্যক্তিগত ইনিংসের পথে ৬৪ বল খেলে ৭টি চার ও ৩টি ছক্কা মারেন সাকিব। ইয়াসিরের সাথে ৮২ বলে ১১৫ রান যোগ করেন সাকিব।

৪২তম ওভারে সাকিবের আউটের আগের বলেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ইয়াসির। পরের ওভারের প্রথম বলে বোলার রাবাদাকে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ইয়াসির। ৪৪ বল খেলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৫০ রান করেন ইয়াসির।

সাকিব-ইয়াসিরের পর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও আফিফ হোসেন ছোট-ছোট দু’টি ইনিংস খেলেন। এতে দলীয় ৩শ রানের পথ সহজ হয় বাংলাদেশের। শেষ পর্যন্ত ৩১৪ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।

৪৯তম ওভারে ছক্কা মেরে বাংলাদেশের স্কোর ৩শতে নেন মেহেদি হাসান মিরাজ। শেষ ওভারেও ১টি ছক্কা হাকান মিরাজ। শেষ পর্যন্ত ১৩ বলে ২টি ছক্কায় ১৯ রানে অপরাজিত থাকেন  মিরাজ। ৫ বলে ৭ রানে অপরাজিত থাকেন তাসকিন আহমেদ। মাহমুদুল্লাহ ১৭ বলে ২৫ ও আফিফ ১৩ বলে ১৭ রান করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার র্মাকো জানসেন-মহারাজ ২টি করে উইকেট নেন।

ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত  সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ^কাপে শেষবারের মত দেখা হয়েছিলো বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার। ম্যাচে প্রোটিয়াদের জয়ের জন্য ৩৩১ রানের টার্গেট দিয়েছিলো বাংলাদেশ। টার্গেট স্পর্শ করতে পারেনি প্রোটিয়ারা।

এবার ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে টার্গেট স্পর্শের স্বপ্ন ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার। তবে প্রোটিয়াদের ভালো শুরু করতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। ৩৬ রানের মধ্যে স্বাগতিকদের তিন ব্যাটারকে ফেরত পাঠান দুই পেসার তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। ওপেনার কাইল ভেরেনিকে ২১ ও মার্করামকে ০ রানে শিকার করেন তাসকিন। আরেক ওপেনার মালানকে ৪ রানে থামান শরিফুল।

শুরুর ধাক্কাতেই  পিছিয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখান থেকে দলকে খেলায় ফেরান ডুসেন ও অধিনায়ক তেম্বা বাভুমা। দলের স্কোর শতরান স্পর্শ করেন তারা। জমে যাওয়া এই জুটি ভাঙ্গতে চেষ্টা চালিয়ে যান বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম।

অবশেষে ২৭তম ওভারে তামিমের মুখে হাসি ফোটান শরিফুল। ৫৫ বলে ৩১ রান করা বাভুমাকে আউট করেন শরিফুল।

বাভুমাকে হারালেও, ভড়কে যাননি ডুসেন। ডেভিড মিলারকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন ডুসেন।

হাফ-সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরির পথেই ছিলেন তিনি। তবে তার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান তাসকিন। ৯৮ বলে ৯টি চার ও ১টি ছক্কায় ৮৬ রান করা  ডুসেন শিকার হন তাসকিনের।

ডুসেনের আউটের পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে ম্যাচ থেকে পুরোপুরিভাবে ছিটকে ফেলেন স্পিনার মিরাজ। ৪২তম ওভারে ফেলুকুওয়াওকে, আর ৪৪তম ওভারেই জানসেন ও রাবাদাকে এবং ৪৬তম ওভারে মিলারকে শিকার করেন মিরাজ। এতে ৪ উইকেটে ১৯১ থেকে ৯ উইকেটে ২৪২ রানে পরিণত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। মিরাজের তোপে ৫১ রানের ব্যবধানে ৫ উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা।

শেষদিকে বাংলাদেশের জয়কে দীর্ঘায়িত করেন মহারাজ ও এনগিডি। শেষ উইকেটে ২০ বলে ৩৪ রান করেন তারা। শেষ ব্যাটার হিসেবে মহারাজকে বিদায় দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪৮ দশমিক ৫ ওভারে ২৭৬ রানে থামিয়ে দেন মাহমুদুল্লাহ।

৫৭ বলে ৮টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৫৭ বলে ৭৯ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকার হার ঠেকাতে পারেননি মিলার। মহারাজ ২৩ ও এনগিডি অপরাজিত ১৫ রান করেন।

বাংলাদেশের মিরাজ ৬১ রানে ৪ উইকেট নেন। তাসকিন ৩৬ রানে ৩টি, শরিফুল ৪৭ রানে ২ উইকেট নেন। ১০ ওভার বল করে ৫৪ রান দিয়ে উইকেট শুন্য থাকলেও, ব্যাট হাতে ৬৪ বলে ৭৭ রানের সুবাদে ম্যাচ সেরা হয়েছেন সাকিব।

আগামীকাল বাংলাদেশ সময় বেলা ২টায় সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে টাইগাররা।

স্কোর কার্ড : (টস-দক্ষিণ আফ্রিকা)

বাংলাদেশ ব্যাটিং :

তামিম ইকবাল এলবিডব্লূ ব ফেলুকুওয়াও ৪১

লিটন দাস বোল্ড ব মহারাজ ৫০

সাকিব আল হাসান এলবিডব্লূ ব এনগিদি ৭৭

মুশফিকুর রহিম ক মিলার ব মহারাজ ৯

ইয়াসির আলি ক এন্ড ব রাবাদা ৫০

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ক ডুসেন ব জানসেন ২৫

আফিফ হোসেন ক ডুসেন ব জানেসেন ১৭

মেহেদি হাসান মিরাজ অপরাজিত ১৯

তাসকিন আহমেদ অপরাজিত ৭

অতিরিক্ত (বা-৩, লে বা-৩, নো-২, ও-১১) ১৯

মোট (৭ উইকেট, ৫০ ওভার) ৩১৪

উইকেট পতন : ১/৯৫ (তামিম), ২/১০৪ (লিটন), ৩/১২৪ (মুশফিক), ৪/২৩৯ (সাকিব), ৫/২৪৩ (ইয়াসির), ৬/২৭২ (আফিফ), ৭/২৮৮ (মাহমুদুল্লাহ)।

দক্ষিণ আফ্রিকা বোলিং :

এনগিদি : ১০-১-৭৫-১ (ও-১),

রাবাদা : ১০-০-৫৭-১ (ও-২),

জানসেন : ১০-১-৫৭-২ (ও-২, নো-১),

মহারাজ : ১০-০-৫৬-২,

ফেলুকুওয়াও : ১০-১-৬৩-১ (ও-৬, ও-১)।

দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংস :

ভেরেনি এলবিডব্লু ব তাসকিন ২১

মালান ক মুশফিক ব শরিফুল ৪

বাভুমা ক মুশফিক ব শরিফুল ৩১

মার্করাম ক মিরাজ ব তাসকিন ০

ডুসেন ক ইয়াসির ব তাসকিন ৮৬

মিলার স্টাম্প মুশফিক ব মিরাজ ৭৯

ফেলেকুওয়াও ক লিটন ব মিরাজ ২

জানসেন ক তামিম ব মিরাজ ২

রাবাদা ক এন্ড ব মিরাজ ১

মহারাজ এলবিডব্লু ব মাহমুদুল্লাহ ২৩

এনগিডি অপরাজিত ১৫

অতিরিক্ত (বা-৪, ও-৮) ১২

মোট (অলআউট, ৪৮.৫ ওভার) ২৭৬

উইকেট পতন : ১/১৮ (মালান), ২/৩৬ (ভেরেনি), ৩/৩৬ (মার্করাম), ৪/১২১ (বাভুমা), ৫/১৯১ (ডুসেন), ৬/২০৪ (ফেলুকুওয়াও), ৭/২২৯ (জানসেন), ৮/২৩১ (রাবাদা), ৯/২৪২ (মিলার), ১০/২৭৬ (মহারাজ)।

বাংলাদেশ বোলিং :

সাকিব আল হাসান : ১০-০-৫৪-০,

শরিফুল ইসলাম : ৮-০-৪৭-২,

তাসকিন আহমেদ : ১০-১-৩৬-৩,

মুস্তাফিজুর রহমান : ১০-০-৫০-০ (ও-২),

মেহেদি হাসান মিরাজ : ৯-০-৬১-৪,

মাহমুদুল্লাহ : ১.৫-০-২৪-১।

ফল : বাংলাদেশ ৩৮ রানে জয়ী।

ম্যাচ সেরা : সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।

সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ।