পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে ইআরএফের একগুচ্ছ প্রস্তাব

পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানো, লভ্যাংশ আয়ে কর সুবিধা বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার অফলোড ও কার্যকর বন্ড মার্কেট চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে ইআরএফ।

শনিবার,১৩ মে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাকবাজেট মতবিনিময় সভায় এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক ও অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান। এ সময় অর্থসচিব হেদায়েত আল মামুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক ও অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে পুঁজিবাজারে অনেকগুলো সংস্কার করা করেছে। তার কিছু সুফলও মিলতে শুরু করেছে। তবে বাজারের সম্ভাবনাকে দ্রুত কাজে লাগাতে আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানো, লভ্যাংশ আয়ে কর সুবিধা বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার অফলোড ও কার্যকর বন্ড মার্কেট চালু করার অনুরোধ জানান ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক ও অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান।

তার প্রস্তাবের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের পুঁজিবাজার এখন আর ফাটকাবাজার নয়। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা পরিচালনাকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। সেগুলোকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির সময় এসেছে।

মুহিত বলেন, একটা সময় পুঁজিবাজার ফাটকা বাজারই ছিল। কোনো আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি ছিল না। এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার। এখন আর ফাটকা বাজার নয়; এর ফলাফল আমরা দেখছি। বাজার অনেকটা স্থিতিশীল। এ পরিস্থিতিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বলতে পারি, তোমরা পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ো। যে সব রাষ্ট্রায়াত্ত্ব কোম্পানি এখনও পুঁজিবাজারের অন্তর্ভুক্ত হয়নি- তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, শিল্পায়নে আমাদের পুঁজিবাজারকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু নিজস্ব ইক্যুইটি আর ব্যাংক ঋণে শিল্পের প্রকৃত বিকাশ হবে না।

জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের অর্থনীতির বিবেচনায় পুঁজিবাজারের আকার খুবই ছোট। জিডিপি-বাজার মূলধন বিবেচনায় আমরা বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার চেয়েও পিছিয়ে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পুঁজিবাজারে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগানো প্রয়োজন।

বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তিঃ এ বিষয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানি এ দেশে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। এসব কোম্পানি তাদের মুনাফার বড় অংশই নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে পুনর্বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। দেশের সাধারণ মানুষ এসব মুনাফার কোনো ভাগই পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার কথা বলা হলেও কোনো সাড়া মিলছে না। অথচ প্রতিবেশী ভারতে ইউনিলিভার, নেসলে, নোভার্টিস, এসকেঅ্যান্ডএফ, সনোফি, মেটলাইফসহ প্রায় সব বড় বহুজাতিক কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। এমন অবস্থায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। একদিকে বিশেষ কর সুবিধা, অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হ্রাসঃ ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক ও অর্থসূচক সম্পাদক বলেন, আমাদের করপোরেট করের হার অনেক দেশের চেয়ে বেশি। পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানো যেতে পারে। এতে তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবধান বাড়বে। ফলে কর সুবিধা নিতে অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারমুখী হবে।

তিনি বলেন, কর হার কমলেও এ খাত থেকে রাজস্বের পরিমাণ কমার কোনো আশংকা নেই। কারণ তালিকাভুক্ত হলে একটি কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেড়ে যায় বলে কোম্পানিগুলোর পক্ষে কর ফাঁকি দেওয়া বেশ কঠিন।

লভ্যাংশ আয়ে কর সুবিধাঃ বর্তমানে লভ্যাংশ আয়ে ১০ শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তন করা হয়। এটিকে চুড়ান্ত হিসেবে নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া করমুক্ত লভ্যাংশ-আয়ের সীমা ৩০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন তিনি। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার ধারণ করার প্রবণতা বাড়বে, যা বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।

অর্থমন্ত্রী বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেযারম্যানকে প্রস্তাব দুটির বিষয়ে নোট নিতে বলেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার অফলোডঃ অর্থসূচক সম্পাদক রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির শেয়ার অফলোডের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসব কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার ব্যাপারে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু নানা অজুহাতে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসছে না। অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে দায়ী হচ্ছে আমলাতন্ত্র। তাদের ভয়, কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে এগুলোর উপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। তাদের অনেকেই এসব কোম্পানি থেকে নানা অন্যায্য সুবিধা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তালিকাভুক্ত হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেড়ে যায় বলে এসব সুবিধা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত করা গেলে কোম্পানিগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বাড়বে; কার্যক্রমে আরও গতি আসবে। তাতে কম শেয়ার হাতে থাকলেও সরকার বর্তমানের চেয়ে বেশি কর-ভ্যাট ও লভ্যাংশ পাবে।

আমাদের পুঁজিবাজার এখনও ইক্যুটিনির্ভর উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাজারের ব্যাপ্তি বাড়াতে এখানে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা দরকার। কর প্রণোদনাসহ কিছু নীতি সমর্থন দিয়ে হলেও এই বাজার গড়ে তোলা দরকার। তখন সরকারও এখান থেকে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে।

অর্থসূচক সম্পাদক আরও বলেন, নানামুখী চাপকে উপেক্ষা করে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন (এফআরএ) প্রণয়ন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া এই আইনটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত একটি কাউন্সিল গঠন করতে পারেনি সরকার। পুঁজিবাজারে আরও স্বচ্ছতা বাড়াতে দ্রুত এই কাউন্সিল করার উপর জোর দেন তিনি।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে/১৩ মে,২০১৭