পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ার সময় নির্ধারণ দরকার

তানিয়া শারমিন : চীনকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পাওয়াতে আমাদের কী লাভ হলো এমন আলোচনার শুরুতে আমি বলবো, যখন চায়না ও ইন্ডিয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল যে কে পার্টনার হবে? তখন কিন্তু কিছু অ্যাডভানটেজ তো চায়নার ছিল।

কিছু দিন আগে একটা প্রোগ্রামে আমাদের বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেছেন, এই পুঁজিবাজারটাতে চায়না আসার ফলে একটা মজবুত জায়গায় চলে আসবে। আমার যেটা মনে হয়, চায়নার যে অভিজ্ঞতা, সেটাকে যেন আমরা কাজে লাগাতে পারি। যেমন ইন্সট্রুমেন্ট, আমরা তো ইকুইটি বেইজড, ইকুইটি ছাড়া আমাদের কিছুই নাই। এসইসি চেষ্টা করছে, কমিউডিটি মার্কেট বলেন, ডেরেভেটিভ বলেন এগুলোর রুলস-রেগুলেশনগুলো হয়তো ডেভেলপ করছে।

কিন্তু ইমপ্লিমেন্টেশনের ক্ষেত্রে আমরা এখনো রেডি না বা ইউজটু না। এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের অনেক বড় সাপোর্ট দিবে। এখনো প্লাটফর্মটাই তৈরি হচ্ছে না। শুধু রুলস-রেগুলেশন করা এক জিনিস। আর এগুলো বাস্তবায়ন করা আরেক জিনিস। যেমন স্মল ক্যাপ মিডিয়াম ক্যাপের প্লাটফরম আলাদা হওয়ার কথা, অনেকদিন হয়ে গেছে, গেজেট হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার হিসেবে আমরা আশা করি, যারা আমরা শুধু সেকেন্ডারি মার্কেটই নয়, প্রাইমারি মার্কেট নিয়েও কাজ করি তারা অনেক বড় স্বপ্ন দেখি, তাদের টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট বলেন, আর তাদের এক্সপেরিয়্যান্স বলেন, এগুলো নিয়ে যদি আমরা কাজ করতে পারি, তাহলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে আমরা একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারব।

স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে চায়না: প্রাইমারি মার্কেট বলেন আর সেকেন্ডারি মাকেট বলেন, আমরা যেমন ইকুইটি নিয়ে কাজ করি, তারা যদি ডেট নিয়ে কাজ করে তাহলে তাদের স্ট্র্যাটেজিটা আমাদের কো-আপ করে নিতে হবে। তাদের সাথে মিলে তাদের এক্সপেরিয়্যান্স আর আমাদের এক্সপেরিয়্যান্সটার মধ্যে যে ম্যাচিংটা ওই জায়গাটাতে আসতে হলে আমাদের একটু হলেও সময় লাগবে। ওই সময়টা কিন্তু আমাদের দিতে হবে।

আমি যদি বলি, আজকে এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে গেছে, কালকেই মার্কেট আপ হয়ে যাবে। সেটা কিন্তু সম্ভব না। আমরা যতটুকু শুনেছি, তারা কিছু টাকাও ইনভেস্ট করবে, ব্রোকারদের মাধ্যমে শেয়ার কিনবে। এবং সেটার প্রভাব কিন্তু একটু লংটার্ম। আর লংটার্ম হওয়াই ভালো আমি মনে করি।

আইপিওর ক্ষেত্রে যেমন টাইম ফ্রেম বেধে দেয়া থাকে, সেরকম একটা ইস্যু এপ্রোভাল থেকে লিস্টিং হওয়া পর্যন্ত যদি একটা টাইম ফ্রেম দিয়ে দেয়া হয় আমাদের রেগুলেটরি থেকে, তাহলে আমরা আরও কুয়িকলি কাজ করতে পারব। আইপিওর সাবসক্রিপশনের ক্ষেত্রে যদি আমরা নতুন আইন করে একটা টাইম ফ্রেমের মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, যেটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, আমরা আদৌ পারবো কিনা।

আগে ব্যাংকে লম্বা লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে হতো। নতুন করে সফটওয়্যার তৈরি করে ব্রোকারেজের মাধ্যমে আমরা সবাই করলাম এবং পারলাম। তাহলে লিস্টিং বা এপ্রোভালের ক্ষেত্রে কেন একটা টাইম ফ্রেম থাকবে না? যদি টাইম ফ্রেম করে দেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে আমরা অটো ইমপ্লিমেন্ট করতে পারছি। আমি তখন একটা ব্রোকারেজ হাউজে ছিলাম, তখন দেখেছি বাধা আসছে নানা দিক থেকে, এটা কোনোভাবে সম্ভব না, অতিরিক্ত লোক নিতে হবে, আইটি সাপোর্ট লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্ত আসলে পুরো বিষয়টা খুবই স্মুথলি হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যদি রেগুলেটরি থেকে মেন্ডেটরি করে দেওয়া হয়, তবে এই কাজগুলোও স্মুথলি হয়ে যাবে।

ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি: শুধু রেগুলেটরির আইন শীথিল হলেই যে সব ভালো কোম্পানি লিস্টেড হবে এমনটা কিন্তু না। যদি সরকার থেকে একটা নিয়ম করে দেয়া হয় যে নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হয়। যেমন ব্যাংক বা ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে একটা সময় বেধে দেয়া আছে, এত বছর পর তালিকাভুক্তি হতেই হবে। এরকম মেন্ডেটরি করে দেওয়া হয় তবে কিন্তু তারা আসবে। বড় গ্রুপ যেমন আকিজ গ্রুপ বা পারটেক্স গ্রুপ তারা কিন্তু শেয়ার মার্কেটে আসে না।

আমরা যখন তাদের কাছে তালিকাভুক্তির প্রস্তাব নিয়ে যাই তখন দেখতে পাই, তারা ফ্যামিলি বিজনেস থেকে বের হতে চায় না। তারা ভাবে, তাদেরকে নানা রকম ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আবার লিস্টেড হওয়ার পরে আরো কমপ্লায়েন্স এবং আরো নানারকম ঝামেলা তাদের ফেস করতে হয়। তাদেরকে যাতে অপ্রয়োজনীয় কোনো ঝামেলা ফেস না করতে হয়, সে ব্যাপারে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে।

ধরুন কেউ একটা প্লান করলো, আমি এ টাকাটা দিয়ে এই কাজটা করবো। কিন্তু সে অনুমোদনই পেলো দুই বছর পর। দুবছর পর তার কিন্তু এই দরকারটা নাও থাকতে পারে। এরই মধ্যে সে কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকাটা নিয়ে নিতে পারে। আবার ব্যাংক থেকে টাকা নিতে তাকে অনেক কমপ্লায়েন্স মেইন্টেইন করতে হচ্ছে না। অনেক করপোরেট গভার্নেন্স না থাকলেও চলে। কিন্তু লিস্টেড হতে হলে এসব মেনে আসতে হয়।

আমি আইন ভঙ্গ করার কথা বলছি না। একটু রিলাক্স করা, একটু আকর্ষনীয় করা সরকারের পক্ষ থেকে। যেমন ট্যাক্সের ক্ষেত্রে ১০ পার্সেন্ট বেনিফিট পাওয়া যায়। অনেকের জন্য এই ১০পার্সেন্ট গ্যাপটা ঝামেলার তুলনায় কিছু না। আমি একটা গ্রুপ অব কোম্পানিকে বলতে শুনেছি, এতো ঝামেলা, কমপ্লায়েন্স ফেস করার বিনিময়ে ১০ পার্সেন্ট বেনিফিট কিছুই না, এর চেয়ে ব্যাংকই ভালো।

ইস্যু মানেজার হিসেবে মাঝে মাঝে আমাদের অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখিন হতে হয়। এর জন্য দেখা গেলো তিন মাস পিছিয়ে যেতে হলো। পাশাপাশি এসময়ে কোম্পানির মধ্যেও আগের সেই আগ্রহ হারিয়ে যায়। অন্য আগ্রহী কোম্পানি যখন এসব কোম্পানির সাথে কথা বলে এবং জানতে পারে তাদের তালিকাভুক্তিতে দুই তিন বছর সময় লেগেছে, তখন ওই কোম্পানিদের আগ্রহও হারিয়ে যায়।

একটা ইস্যু মানেজার হিসেবে আমাদেরকে যদি একটা টাইম দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের যদি কোনো ইনকোয়ারি থাকে, কোনো কারেকশন থাকে। একটা টাইম ফ্রেম যদি আমাদের জন্য থাকে তবে একটা ফাইল সাবমিট করার তিন মাস হোক বা ছয় মাস হোক এর মধ্যে এটা বের হয়ে আসতো। সেটা নেগেটিভ হোক আর পজিটিভ হোক। এমন হতে পারে সেটা ক্যানসেল। ক্যানসেল হলে ক্যানসলে। বাট টাইমটা আমরা ফিক্সড চাচ্ছি। সেটা তিন মাস হোক আর ছয় মাস হোক। অনেক দেশেই দেখবেন ১৫ দিনেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। আমাদের রেগুলেটরিতে লোকবলের অভাব আছে হযতো এজন্য দেরি হয়। কিন্তু এসব বলে বলে আমরা অনেকদিনই পার দিচ্ছি। বিষয়টার কারেকশন আর হচ্ছে না।

আমাকে যদি একটা বাইন্ডিংস-এর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়, এর মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিতে হবে, তাহলে তুমি ১৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত পেয়ে যাবা। আর সেটা যদি ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে আমার ব্রেনে থাকে, আর ইস্যুয়ার কোম্পানি তারাও কিন্তু তখন সবকিছু কুইক করে। যে সমস্ত পেপার বা ডকুমেন্ট দরকার সবই তখন তাড়াতাড়ি জমা দেয়া যায়। সময় বাধা না থাকলে কোম্পানির পক্ষ থেকেও ঢিলেমি থাকে।

যেমন আরজেসির কাগজ, কিংবা ট্যাক্সের কাগজের আপডেট দরকার, কোম্পানি থেকে হয়তো বলা হলো এই দিচ্ছি দিচ্ছি করে কিন্তু দেরি হয়ে যায়। টাইম ফ্রেমটা থাকলে কোম্পানির জন্য যেমন বেটার তেমনি আমাদের জন্যও বেটার। তাহলে আমরা কিন্তু সেই টাইম ফ্রেম ধরেই কাজ করব। সময় বাধা না থাকলে আস্তে আস্তে কোয়ালিটিটাও চলে যায়। আর কোম্পানির কাছেও আমাদের আর সেই রিপুটেশনটা থাকে না। কোম্পানি আমাদেরকে বলে আপনাদের এতো টাইম লাগছে কেন? কবে ফাইল সাবমিট করলাম, সব কাগজ দিলাম, তারপরও দেরি হচ্ছে কেন? আমরা আসলে তখন কোনো আনসার দিতে পারি না। এই জায়গাটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

আমাদের গভমেন্টের পক্ষ থেকে যদি নির্ধারিত করে দেয় হয়, যেমন ব্যাংক বা ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে মেন্ডেটরি করে দেওয়া আছে যে, তোমাকে আসতেই হবে। আসলে এর কোনো বিকল্প নাই। মাল্টিন্যাশনালের ক্ষেত্রেও তা যদি করা হয় তবে আমরা তাদেরকে পাব। তাদের মেন্ডেটরি কিছু নেই বলেই আমরা স্টক এক্সচেঞ্জে তাদের পাচ্ছি না। দেশীয় গ্রুপ যারা বড় আছে, তারা কিন্তু তাদের ফ্যামিলি বিজনেস থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে না। তারা মনে করে যে শেয়ার দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এই জায়গাটাতে মনে হয় ডিএসসি’রও মার্কেটিংয়ের একটা জায়গা আছে।

আসলে শেয়ার বাজারে আসলেই যে শেয়ারটা অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু তা না। মিনিমাম কিন্তু বলা আছে টেন পারসেন্ট। অ্যাডভানটেজটা যদি একটু বেশি হাইলাইটস করা হয় যেমন আমরা যদি প্রথমেই পজিটিভগুলো নিয়েই বলতে থাকি। আমাদের সাথে সাথে যদি রেগুলেটরও পজিটিভগুলো নিয়ে বেশি বেশি মার্কেটিং করে তাহলে মনে হয় মাল্টিন্যাশনাল ও গ্রুফ অব কোম্পানিগুলোকেও আমরা পাব। মাল্টিন্যাশনাল ও গ্রুফ অব কোম্পানিগুলোকেও মনে হয় গভর্মেন্টের পক্ষ থেকে একটি টাইম ফ্রেম দিতে হবে, তিন বা পাচ বছর ব্যবসা করছো, প্রফিট করছো এর পর বাধ্যতামূলক পুজিঁবাজারে আসতেই হবে। তাহলে আমরা মাল্টিন্যাশনালসহ ভালো ভালো গ্রুপ অব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে পারব।

সিএপিএম-এ আমার টিমটা খুব ভালো। এখানে সবাই এক্সপার্ট। আমরা আসলে চেষ্টা করি গুডইউলটা যেন থাকে। এমন কিছু আমরা করব না বা এমন কোনো কোম্পানি নিয়ে আমরা কাজ করব না যাতে আমাদের গুডইউলটা নষ্ট হয়। গুডইউলটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র টার্গেট। আর গুডইউলটা তখনই হবে যখন আমাদের কাজের কোয়ালিটিটা ঠিক থাকবে। কাজের কোয়ালিটিটা আমরা চেষ্টা করি আমাদের টীম চেষ্টা করে হান্ডেড পারসেন্ট করার জন্য। আর আগের চেয়ে সিএপিএম অ্যাডভাইজরিকে এখন সবাই চিনে গুডইউলের কারণে। আমরা কোয়ালিটির নিয়ে কমপ্রোমাইজ করি না।

তানিয়া শারমিন
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এন্ড সিইও
সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড।

জাকির/রাসেল/