কৃষির সমৃদ্ধিতে অঞ্চল নির্ধারণ দরকার

প্রয়োজনীয় ফলমূল দেশেই উৎপাদন করতে হবে

‘তাহলে কী করা দরকার ? আমরা কোথায় চিংড়ি চাষ করব, এটা বলে দেয়া উচিত। বলে দেয়া উচিত কোন ফল, সবজি, ফসল, কাঠ, মাছ, ধান কোথায় বা কোন এলাকায় চাষ করব? তার মানে আমি এটাও বলছি না, কৃষক ধান চাষ করতে চাইলে, সবজি করতে চাইলে, মাছ চাষ করতে চাইলে, সে তা করতে পারবে না। আমি বলতে চাইছি, যে এলাকায়, যে ফসল প্রাধান্য পায়, সে সব এলাকায় সেগুলোই চাষ করা উচিত। কমার্শিয়াল কৃষকেরা সে সব স্থান নির্বাচন করে ফল, ফসল, সবজি, কাঠ, মাছ, পশু, হাঁস মুরোগ ইত্যাদি চাষ কিংবা পালন করবে। আমাদের যারা এই লাইনে কাজ করে, তারাও এ ব্যাপারে ট্রেনিং পাবে। তাদের স্পেশালাইজড করে সব জায়গায় পোস্টিং দেয়া হবে। তারা এইসব জায়গায় কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবে তাদের পাশে থাকবে। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক ও দ্রুত হবে। না হলে দেখা যাবে, যেখানে ধান করার প্রয়োজন,নেই সেখানে ধান চাষ হচ্ছে, আর সেই ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; অথচ সেখানে মাছ চাষ করা যেত। যেখানে আমাদের চিংড়ি চাষ করার কথা, সেখানে আমাদের ধান চাষের দরকার নেই, তাহলে আর মারামারি হতো না। যেখানে পুকুর কাটার দরকার নেই সেখানে আমরা পুকুর কাটলাম না। তাহলে সার্বিকভাবে আঞ্চলিক কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে, টেকনোলজিকে প্রমোট করে, অভিজ্ঞদের পরামর্শ দিয়ে গোটা দেশে সমৃদ্ধ কৃষি অঞ্চল গড়ে ওঠবে। আমাদের যে পরিকল্পনা, ‘উই আর ক্রিয়েটিং দ্যা ফার্মার্স’ এই কর্মসূচির মাধ্যমেও সারা দেশে সম্পদশালী কৃষক গড়ে তুলতে পারব। এটাতেই আমাদের এখন জোর দেয়া উচিত। পুরো দেশকে যদি এভাবে কৃষিভিত্তিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। দেশের কোথায় কী পণ্য দ্রব্য, ফসল, ফল ইত্যাদি উৎপাদন হয়, তা চিহ্নিত করা যায়। কৃষকদের জ্ঞান ও আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে, যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়, তাহলে কৃষিকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এভাবে ভাগ দিয়ে, টেকনোলোজি সেবা বাড়ােেনা সম্ভব, তার ট্রেনিং সম্ভব, টেকনোলজিকে নিশ্চিত করা সম্ভব’— এসিআই এগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসিআই লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক, ড. এফ. এইচ. আনসারী বলেছেন এসব কথা। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবি টিভির সঙ্গে তাঁর কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আর এখানে কৃষকরাই কৃষি কাজ করে। আমাদের মিশনের মধ্যেই আছে ‘ক্রিয়েটিং ফর অল ফার্মার’। এখন যারা কৃষি কাজ করে তার সত্তর ভাগই মাঠে কাজ করে। যেখানে ধান গম অন্যান্য ফসল হয়। মাঠ ফসল হলেও, সেভাবে অনেক সময়, ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। আমরা যা করার চিন্ত করছি, সেটা হলো, যেসব অঞ্চলে যে সব ফসলের উপযুক্ততা রয়েছে, সে সব এলাকায় গিয়ে, তাদের সেইসব ফসলকে আমরা প্রমোট করবো। তো আমরা, এবার উত্তরাঞ্চলকে বেছে নিয়েছিলাম। সেখানকার যে জমিগুলো উচুঁ, প্রচুর বৃষ্টিপাতেও জমি পানিতে ডুবে যায় না। অন্যান্য নীচু জায়গায় বন্যা হয়। এসব জায়গায় যদি আমরা ফল সবজি করতে পারি, তাহলে সুবিধা হবে, কৃষকেরা ধান বা অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি এখানে শাক-সব্জি ও ফলের চাষ করতে পারবে। এর মাধ্যমে তারা বাড়তি আয় করতে পারবে। যা দিয়ে তাদের পরিবারের আলাদা করে আয় বৃদ্ধি হবে। কৃষককেরা আরো বিনিয়োগের মাধ্যমে সেখান থেকে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ এভাবে যদি আমরা কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে সবার আয় উন্নতি সম্ভব। নর্থ বেঙ্গলের প্রত্যন্ত এলাকা হলো গোদাগাড়ি। যে উপজেলাকে অনেকে চেনে আবার অনেকেই চেনে না। সেখানে বরেন্দ্র এলাকার লাল মাটি আছে, সেখানে বিভিন্ন ফসল, সবজির অবাধ চাষ সম্ভব। চাহিদা অনুযায়ী সেখানে যদি কৃষক ফল উৎপাদন করতে পারে। তাহলে আমরা বিদেশ থেকে ফল আমদানি না করে, দেশে উৎপাদিত ফল সবাইকে খাওয়াতে পারি। এ জন্য এসব জায়গায় কৃষির মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে।

বৃক্ষমেলা নয় যেন কৃষি বিপ্লব
সাধারণত সেখানে কৃষকেরা, মাঠ ফসলের পাশাপাশি আর অন্য কোনো ফসল করতে পারে না। যদি আমাদের পরিকল্পনা মতো সেখানে কিছু করা যায় তাহলে সব কিছু করা সম্ভব। এ জন্য আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় সেখানে একটা কৃষি মেলার আয়োজন করেছিলাম। আমার অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হলো সেখানে। প্রায় কয়েক হাজার কৃষকের সমাগম হয়েছিল মেলায়। আমি যখন গেলাম, তখন সেখানে স্টলগুলোতে তেমন সাড়া পড়েনি। কিন্ত বক্তব্য দেয়ার পর অনুষ্ঠানের শেষে প্রতিটা দোকান থেকে মানুষ কিনে নিয়ে গেল। আমি আবার যখন বিকেলবেলায় মেলায় আসি, তখন অবাক হয়ে দেখি, বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। প্রত্যেকের হাতেই দেখি একটা করে গাছের চারা। সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি আমি দেখলাম, তাতে আমার কাছে মনে হলো, সেখানে সত্যিই কৃষির একটা বিপ্লব ঘটে গেল।

মূলত এর পেছনে সঠিক প্রচারণাই কাজ করেছে বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সার্বিক প্রচারণা, আমাদের সবার সুন্দর আলোচনা ও উপস্থাপনা, এই সাফল্যের কারণ বলে আমি মনে করছি। সেখানকার প্রায় সকল খামারিদের উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে মেলায় অংশ গ্রহণ করিয়েছে। স্থানীয় জন প্রতিনিধি, প্রশাসন যেভাবে সবাইকে উৎসাহ দিয়েছেন, সে কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। কৃষকেরা এমন উৎসাহ পেয়েছে যে, প্রায় ১০ লক্ষ গাছের চারা বিক্রি হয়েছে। ধারণা করা যায়,ছোট্ট একটা উপজেলায় এই পরিমাণ গাছ বিক্রি হয়েছে ? এর অর্ধেকও যদি পরিচর্যার মাধ্যমে বড় হয় আর এর থেকে ফল পাওয়া যায়, তাহলে কী পরিমাণ ফল হবে! আর তা যদি হয়, স্থানীয়রা কতটা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হতে পারবে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা সেখানে বিক্রি হয়েছে। কাঠ, সবজি, ফল এসব গাছের চারা। আমি এদিক দিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী।

আমি মনে করি, এটা প্রান্তিক মানুষের আয়ের অন্যতম একটা উপায় হতে পারে। যেহেতু ওই এলাকা খরা প্রবণ এলাকা, তাই এ গাছগুলো লাগানোর ফলে পুরো এলাকায়, সবুজের সমারোহ বিরাজ করবে বলে আমি মনে করি। যদি তা হয়, তাহলে এখানে বৃষ্টিপাত হবে, পরিবেশ ঠান্ডা থাকবে। এমন উদ্যোগ শুধু এখানেই নয়; সারা বাংলাদেশের যে সমস্ত জায়গায় সম্ভব, সেখানেই আমরা যাব এবং এমন উদ্যোগ নিব। যার মাধ্যমে কৃষকের উপকারের পাশাপাশি পরিবেশেরও আমূল একটা পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।

মেলায় সমন্বিত কৃষি প্রচার
মেলায় আমাদের বিভিন্ন রকমের দোকানের স্থাপনা ছিল।ি ছল নানা রকমের সার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্ট যন্ত্র, ডিম ফুটনোর ইনকিউবেটর ইত্যাদি। স্থানীয়রা এগুলো দেখে আরো উৎসাহিত হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে, সেখানে কৃষি অর্থনীতি ও টেকনোলোজির সমন্বিত একটা প্রচার হয়েছে। যা সবার কাছেই সমাদৃত হয়েছে। এবং এটা একটা ভালো উদাহরণ হিসেবে দেখা দিয়েছে, আমরাও এ থেকে উৎসাহিত হয়েছি।

আমাদের পরিকল্পনা
দু’একটা নতুন ফলের চারাসহ আমরা গতানুগতিক বিভিন্ন গাছের চারা বিতরণ করেছি। আমাদের টেকনোলোজিক্যাল উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এখন আমাদের দেশেই অনেক ফসল, ফল উৎপাদন সম্ভব। কমলালেবু, থাই পেয়ারা এগুলো ইতিমধ্যে চাষ হচ্ছে। আমরা তো এভাবে বাইরে থেকে প্রযুক্তি এনে এখানেই সব কিছু করতে পারি। শহরে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের যেসব ডিলার রয়েছেন, তাদের কাছে আমরা এসব গাছের চারা দিতে পারি । যারা সারা দেশের মানুষের হাতে তুলে দিতে পারবে। ফলে সারা দেশে সবার কাছে বিভিন্ন জাতের ফলের চারা পৌঁছে যাবে।

আমারা নিজেরা নার্সারি করি না। যারা নার্সারি করেন, আমরা তাদের সার, বীজ উপদেশ দিয়ে সহযোগিতা করি। এগুলো দিয়ে তারা উৎকৃষ্টমানের ফলের চারা উৎপাদন করতে পারছে। কিভাবে সঠিক নিয়মে, ভালো ফসল উৎপাদন করা যায়, এজন্য কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি। কৃষি এমন একটা বিষয়, টেকনোলজি ছাড়া যার সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। আর টেকনোলোজি হচ্ছে খুবই সেনসেটিভ একটা বিষয়। তাই দুটোর ঠিকঠাক সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিতে হবে। যা আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। এখানেই অন্যদের চেয়ে আমাদের পার্থক্য। আমাদের সুপারভাইজার ও ডিলারদের মাধ্যমে আমরা সারা দেশেই এ কার্যক্রম পরিচালনা করছি প্রতিনিয়ত। এতে করে কৃষকেরা সঠিক নিয়ম মেনে, ফসলের চাষ করে, সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

কৃষিতে অনেক বড় আমার দেশ
আসলে এই দেশটা দেখতে যদিও মনে হয় অনেক ছোট। কিন্ত কৃষির দিক দিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দেশটা অনেক বড়। আমরা যদি গ্লোবাল পিকচারের দিকে দেখি, তাহলে দেখবো, ধান আবাদের দিক দিয়ে, আমরা কিন্ত চার-পাঁচের মধ্যে আছি, সবজিতে প্রায় একই অবস্থা, মাছ উৎপাদনে চার নম্বর আর আলুতে ষষ্ঠ স্থানে আছি। সার্বিকভাবে ভাবলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ কৃষির দিক দিয়ে অনেক বড় একটা জায়গা দখল করে আছে। দেশের আয়তনের সঙ্গে কিন্ত কৃষির মিল নেই; তার চেয়ে অনেক বড় হিসেবে কৃষি জায়গা করে নিচ্ছে। আবার অন্যদিকে যখন চিংড়ি রপ্তানির পরিসংখ্যান দেখি, তখন আমাদের অনেক গর্ব হয় এই ভেবে যে, আমরা দেশের বাইরে অনেক বেশি চিংড়ি মাছ রপ্তানি করছি। তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়? সমস্যা দেখি, যখন আমাদের হবিগঞ্জের বিলে ফসল নষ্ট হয়, আমরা অস্থির হয়ে যাই এবং একে দায়ী করে চালের দাম বাড়িয়ে দিই। কথা হলো, হবিগঞ্জে আমরা আসলে কী উৎপাদন করব? ধান, মাছ না অন্য কিছু?

আর যখন আমি দেখছি, উত্তরাঞ্চলে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কারণ কী? কারণ হলো, উচুঁ জমি কেটে পুকুর খনন করে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেখছি,দক্ষিণাঞ্চলে বন্দুক যুদ্ধ হচ্ছে চিংড়ি চাষ নিয়ে। কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বললে তারা বলছেন, জমিতে লবণ তুলে দিয়ে কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। অন্যদিকে চিংড়ি রপ্তানির পরিসংখ্যান দেখে গর্ব করে বলছি, অনেক বেশি রপ্তানি হচ্ছে। এই দ্বৈত-সংশয় দূর করতে হবে। আবার যদি আমরা পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখব,ওখানে পাহাড় খালি পড়ে আছে, সেখানে কিন্তু বড় বড় ফলের বাগান হতে পারে ।

এই যে ব্যাপারগুলো রয়েছে, তার মাধ্যমে কিন্তু অঞ্চলভিত্তিক কৃষির একটা ধারণা পাওয়া যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে আম হয়, দিনাজপুরে লিচু হয়। এভাবে সারা দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ফল, ফসল, কাঠ বা সবজি চাষ হচ্ছে। আবার অন্যদিকে দেখব গরু, মাছ হচ্ছে, এভাবে সারা দেশেই এলাকা ভিত্তিক অনেক কিছু চাষ হচ্ছে। মানে সারা দেশে সব কিছু মিলিয়ে কোন না কোনভাবে এগুলো আছেই। তা হলে আমরা কী করতে পারি? গোটা দেশটাকে অঞ্চলিক ভাগে বিভক্ত করে, যে অঞ্চলে যে ফল বা ফসল হয়, তাকে প্রাধান্য দিয়ে আরো কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় তার চেষ্টা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এতে করে পুরো ব্যাপারটা ফোকাস হবে। সর্বোপরি, কৃষকেরাই যেহেতু এই কাজটা করতে পারে, শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এতে উৎপাদন বেড়ে যাবে অনেকগুণ।

অঞ্চলভিত্তিক কৃষি পরিকল্পনা দরকার
তাহলে কী করা দরকার ? আমরা কোথায় চিংড়ি চাষ করব, এটা বলে দেয়া উচিত। বলে দেয়া উচিত কোন ফল, সবজি, ফসল, কাঠ, মাছ, ধান কোথায় বা কোন এলাকায় চাষ করব? তার মানে আমি এটাও বলছি না, কৃষক ধান চাষ করতে চাইলে, সবজি করতে চাইলে, মাছ চাষ করতে চাইলে, সে তা করতে পারবে না। আমি বলতে চাইছি, যে এলাকায়, যে ফসল প্রাধান্য পায়, সে সব এলাকায় সেগুলোই চাষ করা উচিত। কমার্শিয়াল কৃষকেরা সে সব স্থান নির্বাচন করে ফল, ফসল, সবজি, কাঠ, মাছ, পশু, হাঁস মুরোগ ইত্যাদি চাষ কিংবা পালন করবে। আমাদের যারা এই লাইনে কাজ করে, তারাও এ ব্যাপারে ট্রেনিং পাবে। তাদের স্পেশালাইজড করে সব জায়গায় পোস্টিং দেয়া হবে। তারা এইসব জায়গায় কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবে তাদের পাশে থাকবে। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক ও দ্রুত হবে। না হলে দেখা যাবে, যেখানে ধান করার প্রয়োজন,নেই সেখানে ধান চাষ হচ্ছে, আর সেই ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; অথচ সেখানে মাছ চাষ করা যেত। যেখানে আমাদের চিংড়ি চাষ করার কথা, সেখানে আমাদের ধান চাষের দরকার নেই, তাহলে আর মারামারি হতো না। যেখানে পুকুর কাটার দরকার নেই সেখানে আমরা পুকুর কাটলাম না। তাহলে সার্বিকভাবে আঞ্চলিক কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে, টেকনোলজিকে প্রমোট করে, অভিজ্ঞদের পরামর্শ দিয়ে গোটা দেশে সমৃদ্ধ কৃষি অঞ্চল গড়ে ওঠবে। আমাদের যে পরিকল্পনা, ‘উই আর ক্রিয়েটিং দ্যা ফার্মার্স’ এই কর্মসূচির মাধ্যমেও সারা দেশে সম্পদশালী কৃষক গড়ে তুলতে পারব। এটাতেই আমাদের এখন জোর দেয়া উচিত।

পুরো দেশকে যদি এভাবে কৃষি ভিত্তিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। দেশের কোথায় কী পণ্য দ্রব্য, ফসল, ফল ইত্যাদি উৎপাদন হয়, তা চিহ্নিত করা যায়। কৃষকদের জ্ঞান ও আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে, যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়, তাহলে কৃষিকে আরো অনেকদুর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এভাবে ভাগ দিয়ে, টেকনোলোজি সেবা বাড়ােেনা সম্ভব, তার ট্রেনিং সম্ভব, টেকনোলজিকে নিশ্চিত করা সম্ভব।

হবিগঞ্জে কী করব, মাছ না ধান?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে হবিগঞ্জে বিল ডুবে গেল, তাহলে মাছ চাষ করলে তো পানিতে মাছও ভেসে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কী করা যাবে? অবশ্যই কিছু করার আছে। আমাদের দেশে সাধারণত ছোট ছোট পুকুরে মাছ চাষ হয়। তখন বৃষ্টি বা বন্যা হলে কী করব? তখন আমরা নির্দিষ্ট ওজনের মাছ যদি আলাদা করে নেটের খাঁচার মধ্যে নিয়ে, বিলের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে পারি তাহলে কী হবে? বিলের পানির ¯্রােতের সঙ্গে যে অক্সিজেন আসবে, মাছ তা গ্রহণ করবে। তা ছাড়া ভাসমান খাবার দিলে, খাঁচার মাছ তা খেয়ে, তাড়াতাড়ি বড় হবে। এখন কেউ একজন মাছ কিনতে বাজারে গেল; তখন একই মাছকে কেউ বলছে, এটা চাষের মাছ, আবার কেউ বলছে, এটা নদীর মাছ। নদীর মাছে সাধারণত গন্ধ হয় না, স্বাদ ভালো হয়, চাষের মাছে গন্ধ থাকে। ঠিকভাবে আমরা হাইজিন মেইনটেইন করতে পারি না বলে গন্ধ হয়। খাঁচার মধ্যে যে মাছ হবে সেগুলোÍ নদীর মাছের মতো কোয়ালিটি হবে, এই মাছের দামও বেশি পাওয়া যাবে। আবার ধান ডুবে গেলে যে ভয়টা থাকে সেটাও থাকবে না। সুতরাং যেখানে মাছ হবে সেখানে মাছ, যেখানে ধান হবে সেখানে ধান, যেখানে চিংড়ি হবে সেখানে চিংড়ি। আবার সিরাজগঞ্জে হবে গরু। এভাবে চিন্তা করে এগিয়ে গেলে কৃষির আরো উন্নয়ন সম্ভব।

কৃষিতে যন্ত্রায়ন ও টাকা পয়সার হিসাব
এখানে মনে রাখতে হবে টেকনোলজির সঙ্গে অর্থের সরাসরি যোগ রয়েছে। এমন একটা বিষয়ের সঙ্গে উৎপাদন জড়িত। অর্থ যত সহজ হবে তত উৎপাদন বাড়বে। এতে করে সুবিধা হবে,একই খরচে এক হেক্টরে যদি এক টন পণ্য উৎপাদন হয়, পাশাপাশি টেকনোলজির ব্যবহারে ১০ ভাগ খরচ যদি বাড়ে আর সেখানে ৮ টন পণ্য উৎপাদন হয়; তাহলে ১০০ গুণ বেশি পণ্য উৎপাদন হলো। এতে করে কৃষকেরই উপকার হলো। কস্ট অব প্রডাকশনও কমে আসলো। তার মানে এখানে প্রফিট হলো। টাকা পয়সার সঙ্গে কিন্ত উৎপাদন ও লাভের সম্পর্ক। ওপরের উদাহরণে দেখছি, টেকনোলজিতে ক্ষতি হওয়ার ভয় কম। বরং উৎপাদন বাড়লে লাভের অংশ বেশি হবে।
যেখনে ধান সেখানে ধান, যেখানে মাছ সেখানে মাছ, এভাবে..

আসলে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় একই ফসল একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। অঞ্চলভেদে কৃষিতে আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে। এবং সেভাবেই এগোতে হবে। যে এলাকায় চিংড়ি হয় সেখানে চিংড়ি, যেখানে ধান হবে সেখানে ধান, যেখানে ফল সেখানে ফল, এভাবে আমাদের কৃষকদের ট্রেনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এক জায়গার উপযোগী ফসল অন্য জায়গায় করতে গেলে হবে না। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে কৃষির মিল থাকতে হবে। না হলে ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে না। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে। এর সঙ্গে মিল রেখে টেকনোলোজির সমন্বয় করতে হবে। তাহলে সঠিকভাবে কৃষির উন্নয়ন হবে, দেশের উন্নয়ন হবে। সর্বোপরি আমাদের সবার উন্নয়ন হবে। বাড়বে কৃষি অর্থনীতি, বাঁচবে বাংলার কৃষক।

ড. এফ. এইচ. আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এসিআই এগ্রি বিজনেস
নির্বাহী পরিচালক
এসিআই লিমিটেড

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট