ফিদিয়া আদায় করে যাদের রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে

রমজান মাসে রোজার ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত। তারপরও এমন অনেকেই আছেন যাদের এ মাসে রোজা না রাখলেও চলে। এখানে আমরা কাদের জন্য এবং কোন কোন অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে- এই বিষয়ে আলোচনা করবো।

১. মুসাফির

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)

মাসয়ালা : শরয়ি সফর (অর্থাৎ ৪৮ মাইল তথা ৭৭ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন যিনি) তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে মুসাফিরের জন্য উত্তম হচ্ছে যদি কষ্ট কম হয়, তাহলে রোজা পালন করা। (সূরা বাকারা : ১৮৪; হেদায়া : ১/২২১; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/২০)

মাসয়ালা : অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোজা রাখা মাকরূহ। এ অবস্থায় রোজা না রেখে পরে তা কাজা করে নিতে হবে। আছিম (রহ.) বলেন, হজরত আনাস (রা.) কে সফরকালে রোজা রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘যে রোজা রাখবে না সে অবকাশ গ্রহণ করল। আর যে রোজা রাখল সে উত্তম কাজ করলো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/১৩২)

মাসয়ালা : সফর অবস্থায় নিয়ত করে রোজা রাখা শুরু করলে তা ভাঙা জায়েজ নয়। কেউ ভেঙে ফেললে গোনাহগার হবে। তবে কাফফারা দিতে হবে না। শুধু কাজা করবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৩১)

মাসয়ালা : যে ব্যক্তি মুকিম (স্থায়ী বাসিন্দা) অবস্থায় সাহরি খেয়ে সফর শুরু করেছে তার জন্য সফরের অজুহাতে রোজা ভাঙা জায়েজ নয়। ভাঙলে গোনাহগার হবে এবং শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২০৬)

মাসয়ালা : মুসাফির সফরের কারণে রোজা রাখেনি, কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই মুকিম হয়ে গেছে। সেদিনের অবশিষ্ট সময় রমজানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। আর পরে এ রোজার কাজা করে নেবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/২২১, হাদিস : ৯৪৩৬-৯৪৩৮)

২. অসুস্থ ব্যক্তি

মাসয়ালা : রোজা রাখার কারণে কোনো জটিল রোগ সৃষ্টি বা পুরাতন রোগ বৃদ্ধির প্রবল ধারণা হলে, তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। সুস্থ হওয়ার পর কাজা করে নেবেন। (সূরা বাকারা: ১৮৪)

উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে। (আল মুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৫৯; আদ দুররুল মুখতার: ২/৪২২)

শুধুই খেয়ালের বশে রোজা ভেঙ্গে ফেলা জায়েয নেই। বরং যখন কোনো মুসলমান দ্বীনদার চিকিৎসক কর্তৃক রোজা না রাখার ব্যাপারে আদিষ্ট হবে, কেবল তখনই শরিয়ত রোজা ভাঙ্গার অনুমতি দেয়। (দুররে মুখতার : ২/৪৪২)

মাসয়ালা : কঠিন কোনো কাজ করার ফলে ভীষণ পিপাসার্ত হয়ে পড়লে এবং এতে প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে রোজা ভেঙ্গে ফেলা জায়েজ আছে। পরবর্তিতে এর কাজা আদায় করতে হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা প্রয়োজনে এমন কাজ করা গোনাহ। কিন্তু কেউ যদি এতোই দরিদ্র বা দুঃস্থ হয় যে, ঘরে তার খোরাকির কোনো ব্যবস্থা নেই, তখন অপারগতাবশত এমন হলে গোনাহ নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪২০০)

৩. দুর্বল ব্যক্তি

মাসয়ালা : অতিশয় বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে অক্ষম হলে। যে ব্যক্তি বার্ধক্যজনিত কারণে কিংবা কোনো স্থায়ী জটিল রোগের কারণে রোজা রাখতে অক্ষম, ভবিষ্যতেও সুস্থতা লাভের সম্ভাবনা নেই তিনি ফিদিয়া (প্রতি রোজার জন্য পৌঁনে দুই সের গম বা তার মূল্য) আদায় করবেন। কিন্তু যদি পরবর্তীকালে কখনো সুস্থ হয়ে যান, তাহলে এ রোজাগুলোর কাজা করে নেয়া জরুরি। (সূরা বাকারা : ১৮৪; রদ্দুল মুহতার : ২/৪২৭; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/১২০)

বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত সাবেত বুনানি (রহ.) বলেন, হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) যখন বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না, তখন তিনি রোজা না রেখে (ফিদইয়া) খাবার দান করতেন। (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৫৭০)

৪. গর্ভবতী

মাসয়ালা : রোজা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলার নিজের কিংবা সন্তানের প্রাণহানি বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির প্রবল আশঙ্কা হলে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। পরে এ রোজা কাজা করে নেবে। (আল মুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৫৯)

মাসয়ালা : রোজার কারণে দুগ্ধপোষ্য সন্তানের ক্ষতির পূর্ণ আশংকা বোধ করলে তিনিও রোজা রাখবেন না। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪২২; আল ফাতাওয়াল হিন্দিয়া : ১/২০৭; আলহিদায়া : ১/২২২; আপকা মাসায়েল আওর উনকা হল : ৪/৫৬৭)

৫. দুগ্ধদানকারী নারী

মাসয়ালা : রোজার কারণে সন্তান দুধ না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা হলে দুগ্ধদানকারীনীও আপাতত রোজা ভাঙ্গতে পারবে এবং পরে কাজা করে নিবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪২২)

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা মুসাফিরের জন্য রোজার হুকুম শিথিল করেছেন এবং নামাজ কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনীর জন্যও রোজার হুকুম শিথিল করেছেন। (জামে তিরমিজি: ১/১৫২, হাদিস : ৭১৫)

৬. ঋতুবর্তী মহিলা

মাসয়ালা : মাসিক ঋতুস্রাব তথা পিরিয়ডের (হায়েজ) সময় এবং সন্তান জন্মদানের পরবর্তী ৪০ দিন (নেফাস) মহিলাদের ওয়াজিব হল রোজা বর্জন করা। এ অবস্থায় নামাজ ও রোজা কোনোটাই আদায় করা জায়েয হবে না। সুস্থতার পর তাদের রোজার কাজা আদায় করতে হবে। নামাজের কাজা আদায় করতে হবে না। হাদিসে এসেছে, উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো হায়েজ থেকে পবিত্রতার পর মহিলারা কি নামাজ ও রোজার কাজা আদায় করবে? তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় আমাদের রোজার কাজা আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নামাজের নয়। ’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)

রোজা কাজা করা আর নামাজ কাজা না করা সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) যা বলেছেন সমস্ত উলামায়ে কেরাম তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অর্থাৎ ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এসব লোকের রোজার দিন অবশিষ্ট সময় যেভাবে কাটাবে-

১. অসুস্থতা, বার্ধক্য ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কোনো সমস্যার কারণে কেউ রমজানের রোজা রাখতে সক্ষম না হলে সে পানাহার করতে পারবে। তবে রোজাদারদের অগোচরে পানাহার করা উচিত।

২. মুসাফির যদি দিনের বেলা সফর থেকে বাড়ি ফিরে আসে তাহলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৬/২২১)

৩. তদ্রুপ দিনের বেলা কোনো মহিলার পিরিয়ড বন্ধ হলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৬/২২০; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক)

অক্ষম ব্যক্তিদের ফিদিয়া আদায়ের পদ্ধতি

অসুস্থতা কিংবা বার্ধক্যজনিত কারণে কেউ কেউ রোজা রাখতে অপারগ হয়ে যান। তখন তার করণীয় কী এবং শরিয়ত তার জন্য কী সুযোগ রেখেছে— সেটা অনেকে জানেন না। অথচ রোজার মোটামুটি সবকিছু জেনে রাখা একজন মুমিনের কর্তব্য।

অক্ষমদের জন্য ফিদিয়া

কোনো ধরনের ভুলভ্রান্তি হলে শরিয়তের পক্ষ থেকে যে বিনিময় বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়— তাকে ফিদিয়া বলে। অপারগতার কারণে কোনো শারীরিক ইবাদত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ওই বিনিময়কে শরিয়তের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়।

পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন— আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া— একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যারা সওম পালনে সক্ষম নয়, তাদের জন্য একজন মিসকিনকে খানা খাওয়ানোই ফিদিয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ আয়াত রহিত হয়নি। এ বিধান ওই অতিবৃদ্ধ পুরুষ ও স্ত্রীলোকের জন্য, যারা সওম পালনে অক্ষম। এরা প্রতিদিনের সওমের পরিবর্তে একজন মিসকিনকে পেট পুরে আহার করাবে।

ফিদিয়া কখন দিতে হয়

পবিত্র রমজান মাসে যারা রোজা রাখতে অক্ষম, তাদের জন্য বিকল্প বিধান রাখা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের ওপর অসাধ্য কিছু চাপিয়ে দেননি। তাই যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের বিবেচনায় রোজা রাখতে অক্ষম হন এবং পরে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সুস্থ হওয়ার পর রোজার কাজা আদায় করতে হবে। ওই ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া নয়।

আর যদি ওই অসুস্থ ব্যক্তি কাজা করার আগেই ইন্তেকাল করেন, তাহলে তার পক্ষ থেকে আত্মীয়-স্বজন ফিদিয়া আদায় করবে। কেননা মারা যাওয়ার কারণে তার আর কাজা করার সুযোগ নেই। (হেদায়া : ২/১২০)

আর যদি অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে কিংবা এমন বৃদ্ধ হন— যে কখনোই রোজা রাখার মতো সামর্থ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, তাহলে ফিদিয়া আদায় করবে। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৫/৪৫৫)

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। (কাজা করে নেবে) আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া আদায় করা— অর্থাৎ একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)

দরিদ্ররা যেভাবে ফিদিয়া দেবে

ফিদিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। তবে দারিদ্র্যের কারণে ফিদিয়া দিতে একেবারেই অক্ষম হলে- তাওবা করবে। পরে কখনো সামর্থ্যবান হলে- অবশ্যই ফিদিয়া আদায় করে দেবে। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৫/৪৫৫)

ফিদিয়ার পরিমাণ

রোজার ফিদিয়ার বিষয়ে কোরআনে এসেছে, ‘আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া— একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)

অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি রোজা রাখতে একান্ত অপারগ হলে সে প্রতিদিন একজন দরিদ্রের পেট ভরে দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করবে। কেউ চাইলে নগদ টাকাও দিয়ে দিতে পারে। প্রত্যেক রোজার জন্য ফিদিয়ার ন্যূনতম পরিমাণ হলো, সদকায়ে ফিতরের সমান। (আল ইনায়াহ : ২/২৭৩)

কাকে দেওয়া যাবে?

ফিদিয়ার হকদার হলো- গরিব-মিসকিনরা; যারা জাকাতের হকদার। ফিদিয়া কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান— যেখানে জাকাতের হকদার আছে, সেখানেও দেওয়া যাবে। (আল ইনায়াহ : ২/২৭৩)

একটি ভুল ধারণা

আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা রয়েছে, তা হলো বদলি রোজা। অনেকে মনে করেন, কেউ অসুস্থ হলে বা রোজা রাখতে সম্পূর্ণ অক্ষম হলে— অন্য কাউকে দিয়ে বদলি রোজা রাখাতে হয়। বিষয়টি আসলে সে ধরনের নয়। বদলি রোজা বলতে ইসলামে কোনো পরিভাষা নেই। যাকে আপনি বদলি রোজার জন্য ঠিক করা হয়— তার রোজা কে রাখবে? আমরা যেটিকে বদলি রোজা ভাবি, তা মূলত ‘ফিদিয়া’। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান