বাংলাবাজার থেকে ছাপাখানা-বাঁধাই ঘর সরিয়ে নেয়া হোক

এরশাদ সরকারের সময়ে আলোচিত ছাত্রনেতা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আলমগীর শিকদার লোটন। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরেও রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। বাবা সাবেক সাংসদ ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. সাদত আলী শিকদার ছিলেন শিকদার পাবলিসার্সের কর্ণধার। বাবার পুস্কক ব্যবসাকে আপন করে নিজেও যুক্ত করেছেন আকাশ প্রকাশনা সংস্থা নামক আরও একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকাশনা ব্যবসার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবিটিভি’র সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বই প্রকাশনা শুধুই ব্যবসা নয়
বই প্রকাশনা,পুরোটাই মুনাফা নয়। এটা এক ধরনের সেবা। এর প্রতি আমার ব্যক্তিগত দরদ রয়েছে। জাতিকে কিছু দেয়ার একটা কমিটমেন্ট থাকে তাতে। পারিবারিক কারণে এ ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা ভালোও লাগে না। ব্যবসায়ী হিসেবে বলুন আর সেবাদানকারী হিসেবে বলুন, স্বপ্ন হলো ভালো বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া। যত কম দামে ভালো একটি ট্রেক্সট বা একাডেমিক অথবা গল্পের বই,যাই বলুন না কেন-একটি গঠনমূলক, টেকসই বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে আমরা চেষ্টা করি। পাঠক যেন খরচ করে কেনা বইটি তার সংগ্রহে দীর্ঘদিন রাখতে পারে। করতে পারে সঠিক জ্ঞান আহরণ। এটা একজন প্রকাশকের সবচে বড় দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। সে ক্ষেত্রে সব সময় তো পারা যায় না। কাগজের উর্ধ্বমুখী বাজার দর,সরকারি নীতিমালার চাপ এবং বই সেবা নিশ্চিত করতে কাগজের ভর্তুকির অভাব- এরকম অনেক কাক্সিক্ষত ব্যবসায়িক পরিবেশ বা সুযোগ-সুবিধা তো আমরা পাচ্ছি না। যার কারণে কখনও কখনও বইয়ের বাজার বা ব্যবসা যাই বলুন না কেন,বেশ অস্থির হয়ে পড়ে। এতে যেমন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই, তেমনি পাঠকরাও বঞ্চিত হন ভাল মানের এবং কম মূল্যের একটি বই পাওয়া থেকে।

বই প্রকাশনায় বাধা
ব্যবসায়িক বিড়ম্বনা বা অন্তরায় যাই বলুন না কেন,এটা তো সব ক্ষেত্রেই আছে। বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম। পার্থক্যের জায়গাটা হলো, সেবা দেয়াটা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ উৎকৃষ্টমানের একটি বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়ার পেছনে অনেকগুলো ধাপ থাকে,যেমন ভাল লেখক,উন্নতমানের ছাপা,মজবুত বাঁধাই এমনকি প্রকাশকের মানসিকতাও বড় ধরনের ফ্যাক্টর। প্রকাশকের সৃজনশীল মানসিকতা না থাকলে বই ব্যবসায় আন্তরিকতা থাকে না। সেটা হোক সৃজনশীল বা ট্রেক্সট অথবা একাডেমিক, সব ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রেই মানসিকতা যদি না থাকে, তাহলে সেবা বা ব্যবসা দুটোই সফলতার মুখ দেখবে না। এছাড়া বই প্রকাশনায় সরকারি কিছু অপ্রয়োজনীয় নীতিমালার চাপ আমাদের ভোগায়। তারপরও আমরা চেষ্টা করি পাঠককে একটি মানসম্পন্ন উন্নত ছাপার কম মূল্যের বই পৌঁছে দিতে। সরকারেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে,আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে,সব মিলিয়ে ব্যাটে-বলে সব সময় হয়ে ওঠে না। কখনও চার হয়,কখনও দুই হয়,আবার কখনও দৌঁড়ে ছয় করি। কিন্তু পুরোপুরি ছক্কা মারা হয় না। উন্নত বিশ্ব ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশে বসে বই ব্যবসায় ছক্কা মারাটা সহজ নয়। এখানে মুখ্য বিষয় হলো কাগজের উর্ধ্বমূল্য। পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্রে বই প্রকাশনায় কাগজে ভর্তুকি দেয়া হয়। এখানে তো কাগজের সেই সুযোগটা নেই। অন্যান্য দেশে বইয়ের দাম অনুপাতিকহারে অনেক কম,এখানে সেটা সম্ভব নয়। কারণ প্রকাশক তো ভর্তুকি পায় না। যে কারণে ভালো মানের বই করতে গেলেই দাম বেশি হয়। এছাড়া ওসব দেশে অনেক ধরনের সরবরাহ ব্যবস্থা আছে,আমাদের দেশে তেমনটা নেই। যেমন দেখুন এত বড় কর্মযজ্ঞ আমাদের প্রকাশনা ব্যবসা,অথচ সরকার এখনও আমাদের শিল্পের স্বীকৃতি দেয়নি। এটাকে যদি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়,তাহলে আমরা প্রকাশকরা ব্যাংকিং বলুন,কাগজের ক্ষেত্রে বলুন বা প্রাতিষ্ঠানিক বলুন-তখন আমরা ব্যাপক আয়োজন করতে পারি। যেহেতু আমরা স্বীকৃতিও পাইনি এবং সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত নয়, সে কারণে আমাদের অবস্থানের দিক থেকে ব্যবসায়িক হাত সংকুচিত।

অন্যান্য যে কোন ব্যবসার তুলনায় আমাদের বাধা তো অনেক। আমরা ভর্তুকি পাই না। শিল্প হিসেবে ঘোষণা করলে,ব্যবসায়িক অনেক সুযোগ-সুবিধা পেতাম। এক্ষেত্রে প্রকাশনা ব্যবসায় সবচে বড় চাওয়া হলো কাগজে ভর্তুকি। কপি রাইট আইনটা শক্তভাবে দরকার,এনসিবিটি যেসব বই বাজারজাত করে,তা প্রকাশকদের হাতে নেই-তার ব্যবস্থা করা উচিত. দরপত্রের মাধ্যমে এনসিবিটি নিজেদের মধ্যেই রাখছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা যে খুব একটা ভালো অবস্থায় আছি তা বলা যাবে না। কয়েকটি মাত্র বড় কোম্পানির সঙ্গে পুরো প্রকাশনা জগতকে মেলানো যাবে না। ছোট ছোট প্রকাশনার সংখ্যাই বেশি। এসব প্রকাশকরা এর মধ্যে দিয়েই জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে সবই করছে। নিজের ব্যবসা এবং পাঠকের সেবা দুটো বিবেচনায় এর কতটুকু পারছি তা হয়তো বের করা কঠিন হবে। কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রকাশকরা। তবে সরকার যদি এদিকটাতে একটু মনোযোগ দেন তাহলে আমরা শতভাগ সাফল্যের মুখ দেখবো। সরকার তো বলছে-এ সরকার বই বান্ধব সরকার। কিন্তু কাজে-কার্মে তো, তা দেখছি না।

বই ব্যবসার নীতিমালা
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নিজস্ব নীতিমালা তো অবশ্যই আছে। প্রকাশক,লেখক ও বিক্রেতাদের নিয়ে একটি নির্বাচিত কমিটি হয়। আর সে কমিটি যে নীতিমালা তৈরি করে,তার অনুসরণেই বই ছাপা, দর নির্ধারণ এবং বিক্রি হয়। তবে এটা ঠিক অনেক ব্যবসায়ী আছেন,যারা অধিক মুনাফার জন্য নীতিমালা মানে না। অনৈতিক মানসিকতার কিছু কিছু মানুষ আছেন, সেটা পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন? এমনটা সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ঠিক তেমনি কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা হয়তো কখনও কখনও নীতিমালা মানেন না। তবে নীতিমালা থাকলে হয় কি, বইয়ের দরটা সহনশীল বা শোভন একটা অবস্থায় রাখা সম্ভব হয়। আর নীতিমালা না থাকলে প্রতিযোগিতার বাজারে বেশি মুনাফালোভীরা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তাই পাঠক যেন না ঠকে,সে জন্যই নীতিমালার প্রয়োগ জরুরি। অধিক মুনাফার জন্য কিছু ব্যবসায়ী হয়তো ৫ টাকা দরের বই ৭ টাকায় বিক্রি করছে। অর্থ্যাৎ অনৈতিক ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে দ্রুত লাভের লোভে অল্প কিছু ব্যবসায়ী এমনটা করছে। এক্ষেত্রে আমাদের কোন ধরনের ছাড় নেই। আমরা পুস্তক প্রকাশক সমিতি সেগুলো ধরছি এবং জরিমানা করছি। কিন্তু নীতিমালা আমাদের শক্ত। কিন্তু রাষ্ট্র তো এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টি রাখে না। বই প্রকাশনায় রাষ্ট্রীয় কারিকুলামই তো পাঠক বা শিক্ষাবান্ধব নয়। যেমনটা দেখুন উন্নত বিশ্বে দিনের পড়া শিশুরা স্কুলের ক্লাসেই শেষ করছে,অথচ উন্নত বিশ্বকে অনুকরণ করার কথা বলছেন কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা বা পাঠ্যবই প্রকাশনায় সঠিক কারিকুলাম নেই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের চিন্তা-ভাবনা থেকে কারিকুলামা তৈরি করে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ড। যা কোনভাবেই প্রকাশনা বলুন আর শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই বলুন কোনটার জন্যই সুখকর নয়। যদি এক্ষেত্রে রাষ্ট্র দলীয় সরকারের আসা-যাওয়ার বিবেচনা মাথায় না রেখে যুগপোযোগি উন্নত কারিকুলাম তৈরি করে,তাহলে ছোট্ট একটি শিশুকে আর চার-পাঁচ কেজি ওজনের বইয়ের বোঁঝা কাঁধে টানতে হবে না।

বই প্রকাশনার ধরণ
বই প্রকাশনায় নানা ধরণ আছে। যেমন পাঠ্য বা একাডেমিক বই প্রকাশনা,সৃজনশীল বা গল্পের বই,মাদ্রাসা বা ইসলামিক বই,কেজির বই, ধর্মীয় বই সব মিলিয়ে আমাদের বিশাল আয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরণ অনুযায়ী আলাদা আলাদা প্রকাশনা চলছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারো বড় বিনিয়োগ থাকলে,সে সবকিছুই একসঙ্গে করছে। সেটা ভিন্ন মাত্রার। এটার সংখ্যা অনেক কম। বাস্তবতা হলো ধরণ অনুযায়ী যে যেটা করছে,সে সেটা নিয়ে আছে। মাদ্রাসা বা ইসলামিক অথবা ধর্মীয় বই যিনি ছাপছেন, তিনি গল্পের বা সৃজনশীল বই ছাপছেন না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী ধরণ ঠিক রেখেই প্রকাশনা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বই বিক্রির অবস্থা
ইন্টারনেটের যুগে বই বিক্রি কমে গেছে। মানুষ এখন আর আগের মতো বই কেনা না। তারপরও নৈতিকতার দিক থেকে আমরা ব্যবসায়িক প্রতিশ্রুতি ঠিক রেখে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও পাঠকের জন্য উৎকৃষ্ট ও উন্নতমানের তথ্যবহুল এবং কম মূল্যের বই ছেপে যাচ্ছি।

এখন দেখুন বইতেও ভ্যাট ট্যাক্স ধরা হচ্ছে। এক সময় তো এটা ছিলো না। সেবামূলক ব্যবসায় ভ্যাট তো চিন্তার অবান্তর। বিক্রির কথা বলছেন,বিক্রি কোথায়-উন্নতমানের কাগজ ও ছাপা এবং মানসম্পন্ন লেখা নিয়ে যদি বই করি,তাতে দাম ধরা যাক ৮শ’ টাকা। আপনি বলছেন এতো দাম কেন? এখন দেখুন বলছেন দাম কম চাই। কিন্তু কাগজের দাম তো কমাচ্ছেন না। যেখানে সারা বিশ্বজুড়ে বই প্রকাশনায় কাগজে ভর্তুকি দেয়া হয়,সেখানে আপনি দিচ্ছেন না। তাহলে দাম কম রাখা কি করে সম্ভব হবে বলুন। যদি ভর্তুকি হয়,তাহলে আপনি একজন পাঠক বা অভিভাবক আপনার সন্তানের জন্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকা বই পেলেই তো নিজেকে বা সন্তানকে শিক্ষায় এগিয়ে নিতে পারবেন। এতে আপনার উৎসাহ বাড়বে। আর যদি দাম বেশি হয়, তাহলে এর কোনোটাই হবে না। আপনার সাধ্যের একটা বিষয় তো রয়েছেই। তাহলে বিক্রি কোথায়? আমি তো তেমনটা দেখছি না। দেখুন একটা সময় সরকার কাগজে ভর্তুকি দিয়েই প্রকাশনাকে এগিয়ে নিয়েছিল। আর সেটা হয়েছিল,সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। তার একটি প্রমাণও আমি সম্প্রতি পেয়েছি,মুক্তধারার প্রকাশিত বইয়ে। এরপর প্রকাশনা ব্যবসায়ের অন্যতম প্রয়োজনীয় সুবিধাটি আর দেয়া হয়নি।

দেখুন উন্নত বিশ্বে উৎসবকে কেন্দ্র করে জিনিসপত্রের দাম কমে,আমাদের দেশে তার উল্টো। একই কায়দায় বইয়েও কাগজের দাম বাড়ে মৌসুমে। বইয়ের ব্যবসার সিজনটা নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারী এই তিন মাস। স্কুল-কলেজ-মেলা সবই শীতের এই সময়ে। আর কাগজের দামটাও তখনই বাড়ে। অক্টোবরে যে কাগজের দাম ১৮শ টাকা রিম,নভেম্বরে গিয়ে দেখেন তা ২১শ টাকা ছাড়া হাত দেয়া যাবে না। প্রতি রিমে যদি ৩শ টাকা করে বেশি দেয়া লাগে,তাহলে বইয়ের দাম কি বাড়ে না? তখন অনেকে বলেন,জুন-জুলাইয়ে বইয়ের দাম কম ছিলো,এখন আবার বাড়লো কেন? তখন উত্তর কী ? দেখুন শুধু কি কাগজ, কালির দামও বেড়ে যায় একই সময়। এ ছাড়া আগের তুলনায় বেড়েছে বিদ্যুতের খরচ, ছাপাখানা ও কর্মী খরচও বেড়েছে অনেক। আর কাগজের দাম তো বেড়েই আছে,তো স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের দাম বেড়ে যায়। আর তখনই থমকে যায় পাঠক-প্রকাশকের স্বাভাবিক সম্পর্ক। প্রশ্ন আসে প্রকাশকরা বইয়ের দাম বাড়িয়ে চলেছে,পড়ালেখা জ্ঞান অর্জন কী করে সম্ভব? কিন্তু আমাদের কী করার আছে,বলুন? আমরাও তো চাই পাঠক সেবা নিশ্চিত করে সামান্য ব্যবসা করতে। কিন্তু সেটা তো আর হয়ে ওঠছে না। সরকার যদি একটা নির্দেশনা দিতো যে, এ সময় কাগজের দাম বাড়ানো যাবে না,তাহলে বইয়ের মূল্য ক্রেতা বা পাঠকের সাধ্যের মধ্যে রাখা সহজ হয়।

এছাড়া আমাদের সরবরাহ খুব একটা বেশি নয়,সরকারও দিচ্ছে কিছু। একটি ভালোমানের মাত্র ১০ ফর্মার বই করতে গেলো নিচে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার দরকার। ছাপা,বাঁধাই ও কর্মী খরচসহ। মানুষ তো এখন বই কিনে না। তবে এক শ্রেণীর পাঠক আছে যারা নেটে পাওয়ার পরও,কাগজের বইটা হাতে নিয়ে পড়তে চায়। আমরা ঐ পাঠককে সেটাই দেয়ার ব্যবস্থা করি।

সৃজনশীল বইয়ের ক্ষেত্রে মেলা হয়,পুরো বছর জুড়ে শহর কেন্দ্রিক মানুষরা মেলার অপেক্ষায় থাকে যে,সুলভ মূল্যে নতুন নতুন বই পাবে। আর আমরাই ওই কেন্দ্রিকই বই ছাপি। আর ঢাকার যেসব মেলা হয় সে ব্যাপারে আমার একটু আপত্তি আছে। কি লন্ডন কি ফ্রাংককুট বুক ফেয়ার অথবা পার্শ্ববর্তী ভারতের বই মেলাই বলি, আমরা দেখেছি-বই মেলা হলো বাজার মেলা। সবকিছু পাবো সেখানে। একুশের বই মেলার বেলায় আমাদের একটা সেন্টিমেন্ট আছে যে,ওখানে ইংরেজি,হিন্দি,উর্দু বা অন্য কোন দেশের বই যাবে না। ভাষা শহীদের মাস তাই আমরা এসব অনুমোদন দেব না। এটা ঠিক আছে,কিন্তু ঢাকার বাইরে বইয়ের মেলায় যে শুধু গল্পের বই বিক্রি হবে তা তো নয়। এ টু জেড সব বই এখানে বিক্রি করতে হবে। মেলায় আপনি বই কেনার ক্ষেত্রে ভালো একটা ছাড় পাচ্ছেন। তাই গল্পের বইয়ের পাশাপাশি একাডেমিক বা টেক্সট বই অথবা অন্য সব বই কেনায় যদি ছাড়ের সেই সুযোগটা পান তাহলে পাঠক বা অভিভাবক লাভবান হচ্ছে না? এমনকি হাতের নাগালে বইটা পাওয়া গেলো। কম দামে বই পাওয়ার সুযোগ থেকে ঢাকার বাইরের মানুষকে কেন বঞ্চিত করবো? তাই ঢাকার বাইরে শুধু গল্পের বইয়ের জন্য মেলা হবে এটা আমি মানতে রাজি নই। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বার বার বলার পরও উনারা আমলে নিচ্ছেন না। শুধু গল্পের বই কেনার জন্য জেলা পর্যায়ে খুব একটা পাঠকের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। সরকার চায়, ভর্তুকি দেয়, মেলা হয়। কিন্তু এতে যদি সব ধরনের বই সরবরাহের অনুমতি দেয়া হয়,তাহলে পাঠক-প্রকাশক এবং সরকার সবার জন্য ভালো হবে। মেলা কি শুধু একুশ কেন্দ্রিক? তা তো নয়। সারা বছর জুড়ে তো নানা ধরনের মেলা হচ্ছে। সে সব মেলায় পাঠ্য,একাডেমিক বা গল্পের বই-সবই দিতে পারবো,তখন এক মেলা থেকে একজন পাঠক বা অভিভাবক অথবা শিক্ষক তার নিজ শহরে থেকেই চাহিদার সব ধরনের বই ২৫/৩০শতাংশ কমিশনে ন্যায্য দামে সংগ্রহ করতে সক্ষম হবেন।

আরেকটা বিষয়, যেমন আগে পাকশির কাগজ সরবরাহ ছিল। এখন তো আর সেটা নেই। এখন আমরা সরাসরি আমদানি করি বাইরে থেকে। যেমন সুইজারল্যান্ড থেকে যে কাগজ আমদানি করা হয় তার ট্যাক্স যদি কম হয়,তাহলে তো সুফল পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি যে হয় না তা না। দেখা যাবে কাগজ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ হয়তো,প্রকাশকদের দেবে একশ টন আর সরকারকে দেখাবে এক হাজার টন। সোজাসাপ্টা কথা, একটি শক্ত নীতিমালা যদি করা যায়,তাহলে পাঠক-প্রকাশক সবাই বাঁচে। আর দেশে উৎপাদিত কাগজ তো দামে বাইরের চেয়ে অনেক বেশি। কি কাগজ আমদানিকারক কি উৎপাদক-এরা সবাই মিলে এমন একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে,প্রকাশকরা তাদের উৎপাদিত কাগজই কিনতে বাধ্য হন। কিন্তু বাইরের কাগজের মান ও দাম দুটোই প্রকাশনার জন্য উপকারী। কিন্তু সিন্ডিকেট আর ট্যাক্স আমাদের কাগজ আমদানিতে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সে কারণে প্রকাশকদের ক্ষেত্রে কাগজে যদি ছাড় দেয়া হয়,তাহলে বই ভালো হবে,বইয়ের মান ভালো হবে এবং পাঠক কম দামে বই কিনতে পারবেন। এতে বিক্রিও বাড়বে।

বই প্রকাশনায় বাংলাবাজার
এক সময় ছোট্ট শহরে,ছোট্ট একটা জগত ছিল, বই বিক্রি ও বাংলাবাজারের প্রকাশনা ব্যবসা। ধীরে ধীরে এই জগতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়লেও পুরো বাংলাবাজা এলাকা তো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। নগরীর উন্নত বা পরিকল্পিত এলাকাগুলোয় যোগাযোগে যেমন চার-পাঁচটি বাইপাস রয়েছে,তেমনটা তো বাংলাবাজারে নেই। সে অবকাঠামো আমরা গড়ে তুলতে পারি নি তো? উন্নত অবকাঠামো না থাকার পরও আমরা পাঠককে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হ্যা, উন্নত অবকাঠামোর জন্য এখন আমরা যা চাচ্ছি-প্রেসটাকে এখন থেকে সরাতে,বাঁধাইও শহরের বাইরে নিয়ে যেতে চাই। এতে আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। এটা আমার চাচ্ছি,সরকারের কাছে প্রস্তাবনা রেখেছি,বাস্তবায়ন সরকার করবে। এতে বাংলাবাজারে প্রকাশনা ব্যবসায় চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। তখন বিদ্যুত সরবরাহটাও স্বাভাবিক থাকবে। এখন দেখুন প্রেসে বিদ্যুত দিতে হচ্ছে,বাঁধাইয়ে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয় কিন্তু প্রকাশকের বিক্রয় কেন্দ্রে বিদ্যুত নেই। আমরা যেটা চাচ্ছি তাহলো, শীতলক্ষ্যা বা বুড়িগঙ্গার ওপারে বা অন্য কোথাও চলে গেলো,তখন ওরাও কিন্তু বড় জায়গা পেলো-এতে করে কাজটাও ভালো হবে এবং সময় মতো হবে। কিন্তু বাং এখন বাংলাবাজারের অলিতেগলিতে প্রেস বা ছাপাখানা। এ কারণে উন্নত অবকাঠামোর অভাবে ব্যবসার গতি স্বাভাবিক নয়। অনেকে যে এখান থেকে যাচ্ছে না তা নয়,কিন্তু সরকারের চামড়া শিল্পের মতোই বাংলাবাজারে শুধু প্রকাশনা ব্যবসায়ীদের অফিস বা বিক্রয় কেন্দ্র রেখে বাদ বাকি আমাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী অন্যত্র সরিয়ে নেয়া উচিত।

এক সময় লেটার প্রেস ছিলো,যখন কম্পিউটার এলো-তখন ভাবা হলো এ শিল্প মনে হয় ধংস হয়ে যাবে,জড়িত কর্মীরা বেকার হয়ে যাবে। কিন্তু কই তা তো হয়নি? কম্পিউটারের দিকেই মানুষ ঝুঁকেছে। যেমনটা এক সময় ইত্তেফাক ছিলো,যখন ইনকিলাব বা প্রথম আলো এলো,তখন ভাবা হলো তাহলে ইত্তেফাকের কী হবে? কিন্তু এরপরও তো হাজারো কোম্পানি এসেছে। ইত্তেফাক তো মরে যায়নি। বিটিভির পর এখন প্রায় ২৯ থেকে ৩৫টি চ্যানেল হয়েছে,আপনারাও করছেন,তাতে মানুষ বিটিভি দেখা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে? তা নয়,বরং দর্শক বেড়েছে। ঠিক তেমনি বাংলাবাজারের বাইরে ছাপাখানা এবং বাঁধাই এ দুটো সরিয়ে নেয়া গেলে পুরো প্রকাশনা জগতই লাভবান হবে।
বছর বছর পাঠ্য বইয়ের অস্থিরতা কেন?

নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত বড় বড় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই তো পাঠ্যপুস্তক কার্যক্রমে অংশ নেন। তারপরও তো দেখুন এবারও পাঠ্যপুস্তকে অজ¯্র ভুল হয়েছে। শুধুই বানান ভুল,তা নয়-অর্থের ভুল, তথ্যের ভুল এমনকি বিষয়গত ভুলও হচ্ছে। আর বই ছাপায় তো ভুল হচ্ছে হরহামেশাই। যেমন ছাত্র সংখ্যা বা চাহিদা আট লাখ,বই ছাপা হয়েছে ৭ লাখ। স্বাভাবিকভাবে এক শ্রেণীর মানুষ তো মুনাফার জন্য চুরির পথে হাঁটে। মানুষ তো ব্যবসা করতে চায়। সুযোগ, ফাঁক-ফোকর খোঁজে। তখনই তো অনৈতিক কাজগুলো সে করে। এনসিটিবি যদি প্রকাশকদের নিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশনার কাজটি করে,তবে পাঠ্যপুস্তকের ভুল-ভ্রান্তি,অনৈতিক চেষ্টা, সর্বোপরি অস্থিরতা অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু এনসিটিবি সব সময় প্রকাশক সমিতির সঙ্গে একটা বিমাতাসুলভ আচরণ করে। তারা খুব ঠেকায় না পড়লে,নেহাৎ ঠেকায় না পড়লে প্রকাশকদের শরণাপন্ন হয় না। যেমন এনসিটিবি’র ইন্টারমিডিয়েটের বই গুদামে পড়ে আছে। কেউ কেনে না। এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান জানালেন। জানতে চাইলেন কি করার আছে। বই তো নকল হচ্ছে। আমি বললাম,বই প্রকাশক সমিতিকে দিন। দেখুন ওই যে শুরু করলাম,তারপর তো একটি বইও গুদামে নষ্ট হয়নি। এখন তো আমরা প্রকাশকরা টেন্ডার করে নিয়ে আসি। তো আমরা তো অনেক বেশি সহযোগিতা করছি। সরকারের লোকসানে থাকা খাতকে আমরাই তো সচল করলাম। দেখুন আমরা টেন্ডার করলাম,বই ছাপালাম এবং এনসিটিবি’র পড়ে থাকা বইগুলো একসঙ্গে বাজারজাত করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিলাম।

পাঠ্য বইয়ের স্বল্পতা বলুন বা অস্থিরতা বলুন, আসলে সরকার বাড়তি ভর্তুকি দিতে চায় না,তাই আনুপাতিক একটা হার ধরেই বই ছাপে। সরকারের কাছে যে চাহিদার তথ্যটা থাকে না তা নয়, ঐ যে বললাম প্রয়োজন হলে, ফের ছাপবো- এই ধরনের একটি পরিকল্পনা মাথায় থাকে সব সময়। যদি সরকারের লোকসান হয়ে যায়-এই আশংকা থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা মনে করেন,বই লাগবে ৮ লাখ,ছাপাও ৬ লাখ। কি রে ভাই, ২ লাখ কম ছাপলেন কেন? আগে এগুলো যাক,লাগলে রিএডিশন দেবো-এই হলো মনমানসিকতা। শুধু তাই নয়,তাদের তো আবার চাকরিও ভয়ভীতি আছে। তুমি বেশি ছেপে সরকারের এত বড় লোকসান করলে? এত ছাপতে গেলা কেন,এখন ভর্তুকি কে দেবে? এ ধরনের নানান পিছুটান রয়েছে। তাই সরকারের আইনগত জটিলতার কারণে দায়িত্বশীলরা ঝুঁকিটা নিতে চান না। হ্যা লাল ফিতার দৌরাত্ব তো আছেই। তবে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে এনসিটিবি নভেম্বর-ডিসেম্বর বইয়ের টেন্ডার করতো,এখন কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পহেলা জানুয়ারীতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। যার কারণে এনসিটিবি এখনই মাঠে নামছে। আমার কথা হলো যদি ইচ্ছা থাকে,একটু আন্তরিক হন,তাহলে অবশ্যই সময় মতো শিক্ষার্থীদের হাতে সব শ্রেণীর বই পৌঁছে দেয়া সম্ভব।

রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা
সবচে বড় কথা হলো আমি রাজনীতি করি,রাজনীতিবিদ হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করিনি। রাজনীতি করি,এটাও পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে। বাবা দু’বার সাংসদ ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আমি। সে কারণে আমি একটি দল করি। আমার নেতা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাজনীতিটাও এক ধরনের সেবা। সমাজের জন্য কিছু করতে গেলে আমাকে রাজনীতি করতে হবে,সেটা যে দলই হোক না কেন? তবে রাজনীতি আর ব্যবসা আমার কাছে একেবারে আলাদা। কোনটাকে একসঙ্গে দেখি না,বা একটি আরেকটির উপর খুব একটা প্রভাব ফেলে না। যখন ব্যবসায় সময় দিই,তখন পুরো মনোযোগই ব্যবসায় থাকে। আর যখন রাজনৈতিক কর্মকা-ে ব্যস্ততা থাকে,তখন ধান-জ্ঞান পুরোটাই থাকে দল,কর্মী এবং দলের হয়ে সমাজের জন্য কিছু করার প্রত্যয়ে। ব্যবসা তো জীবন-জীবিকার জন্য। পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকা-ের জন্যও তো অর্থের প্রয়োজন হয়। তাহলে সেখানেও তো ব্যবসা লাগে।

রাজনীতিতে থেকে ব্যবসায়, কিছুটা তো প্রভাব থাকেই,এটা স্বাভাবিক। যেমন ধরুন, কোন কাজের ক্ষেত্রে আসলে,আগে সরকার দলের মানুষরাই কাজ পায়,তারপর না হয় আচ্ছা আকাশ, উনি তো জাতীয় পার্টি করে,আচ্ছা ঠিক আছে দাও একটা। রাজনীতি করে কোন ঝামেলায় না ফেলে? এধরনের একটা প্রভাব তো আছেই। আসলে সব জায়গায় দলীয়করণ,দলীয়করণ থেকে তো আমরা বের হতে পারিনি এখনও। সেক্ষেত্রে আমিও দলীয়করণেই পড়ি।

আলমগীর সিকদার লোটন
প্রকাশক,আকাশ প্রকাশনা সংস্থা ও সিকদার প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন