বাজেটে কৃষি গবেষণা ও টেকনোলজিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

ড. এফ এইচ আনসারী : বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্র। যদিও জিডিপি’তে কনট্রিবিউশন চৌদ্দ পনের মতো। এ ক্ষেত্রে আমি যেটা বলব, দেশে অর্ধেকের চেয়ে কিছু বেশি লোক এবং অর্ধেকের মতো শ্রমিক কৃষি কাজে আছে এবং তারা নিজেরা কাজ করে এবং সেখান থেকে ইনকাম করে এবং সারভাইভ করে। গ্রামের মানুষ কিন্তু কৃষি নিয়েই বেঁচে আছে।

আর আমরা যে খাবার খাই মোস্টলি আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করি। অল্প কিছু বাহির থেকে আমদানি করতে হয়। তাহলে দেখা গেল যে, আমরা যা এখানে উৎপাদন করছি তা আমরা খাচ্ছি। যদি আমরা উৎপাদন করতে না পারি এবং আমাদেরকে বাহির থেকে যদি আমদানি করতে হয় তাহলে কী হবে? আমরা এক্সপোর্ট করে যা আয় করি, আমাদের দেশীয় শ্রমিক বাহিরে কাজ করে যে টাকাটা পাঠাচ্ছে, সেটাকার যদি আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হয় তাহলে কিন্ত দেশ ঝামেলায় পড়ে যাবে।

আমি মনে করি যে, এখনই সময়, এটা চিন্তা করা উচিত। আর যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে হবে সেটা ইমিডিয়েট ইমপ্যাক্ট না হলেও মিড টার্ম বা লং টার্ম একটা ভালো ইমপ্যাক্ট আসবে এবং স্ট্র্যাটেজি গোল কিন্তু এচিভ করা খুব সহজ হবে। আমরা যে ডেভেলপিং কান্ট্রিতে স্টেপিং করলাম, এই কমিটমেন্টটা এটাকে সাপোর্ট করাটা কিন্তু খুব সহজ হবে। আমি মনে করি যে, আমাদের এখন রির্সাচে এবং টেকনোলজিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমরা প্রায় দশ বার হাজার কোটি টাকার মতো সাবসিডি দেই। কিন্তু সেটা আমরা সারে দিই, ডিজেলে দিই।

তো আমরা মনে করি যে, অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা টাকাটা ব্যবহার করতে পারি না। আবার আমরা পারি আর না পারি সেটা বড় কথা না। আমার মনে হয় বাজেটে একটা প্রভেশন রাখা উচিত চার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকা আমাদের কৃষি রিসার্চে এবং টেকনোলজিতে ইনভেস্টমেন্ট করার জন্য। রির্সাচ ও টেকনোলজিকে যদি আমরা দুইভাবে বলি, রিসার্চটা এ রকম আমাদের দেশে সাত আটটা গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে, অনেকগুলো ইউনিভারসিটি আছে যারা কৃষি নিয়ে গবেষণা করে। ক্রপে করে, সবজিতে করে, ফ্রুটসে করে, মুরগীতে করে, মাছে করে ও গরুতে করে।

আমরা মনে করি যে, এ সমস্ত জায়গায় যে সমস্ত ফান্ড দেওয়া হয় বাজেট থেকে গতানুগতিকভাবে কয়েক বছর ধরে সেটা থেকে তাদের বিল্ডিং মেইনটেনেন্স এবং তাদের সেলারিটা হয়। কৃষিতে যদি রিসার্চ করতে হয় তাহলে কিন্তু আমাদের হাত বড় করে বাজেট করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি যেটা আমরা দিচ্ছি সেটা কিন্তু যথেষ্ট না। এক্ষেত্রে যেটা করা উচিত, সেটা হচ্ছে যে যাতে য্ন্ত্রপাতি কিনতে পারে কেমিকেল কিনতে পারে সেভাবে ম্যাসিভ স্কেলে দুই হাজার তিন হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া উচিত সরকারি একজিস্টিং যে সব ল্যবরেটরি আছে তাদেরকে। কিন্তু এটাও যদি আমরা মনে করি যে , ইনোভেশনটা বা রিসার্চটা কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে গ্লোবালি। তাহলে এ সমস্ত রিসার্চাররা তো আর বিনা পয়সায় সরকারকে এগুলো দিবে না।

এ দেশের প্রাইভেট সেক্টরগুলোতে যে সমস্ত রিসার্চ মেটেরিয়াল বা ইমপোর্টগুলো আনতে পারে সেক্ষেত্রে আমি মনে করি প্রাইভেট সেক্টরের জন্য একটা ফান্ড ক্রিয়েট করা উচিত কৃষিতে। সেক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর জিরো ইন্টারেস্টে লোন করবে লং টার্ম কমিটমেন্ট করে এবং এ টাকাটা ইন্টারেস্ট ফ্রিভাবে দশ বছর পরে ফেরত দিবে সরকারকে এবং সেখানে সিকিউরিটি থাকবে। অন টপ অব ইট ভালো কিছু প্রোজেক্টকে গভর্মেন্টকে ফিন্যান্সিং করা উচিত প্রাইভেট সেক্টরে। তাতে লাভ হবে এই, প্রাইভেট সেক্টর ফান্ড পেলে নিজেরা আরও কিছু ফান্ড আর্ন করে আরও ম্যাসিভ স্কেলে রিসার্চ করবে এবং আমাদের যে এসডিজি গোল আছে এটাকে ম্যাচ করার জন্য যে সমস্ত আউটপুট আসবে সেখানে প্রোডাক্টিভ এগ্রিকালচারে কিন্তু রিসার্চ করবে। এই কাজটা ইমিডিয়েটলি করা উচিত এবং মনে করি না এটাকে মিস করা উচিত।

আর সরকার যদি ইলেকশনের বছর আমার মনে হয় কৃষককে দেওয়ার জন্য ট্রেডিশনালি যা করেছে সারে ভুর্তকি, ডিজেলে ভর্তুকি এটা তো আছেই, কম দিল কি বেশি দিল সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু যদি বলা হয় যে কৃষি ব্যবস্থাকে প্রোডাক্টটিভ করার জন্য, কৃষকের ইনকাম বাড়ানোর জন্য আমরা ম্যাসিভ স্কেলে আমরা রিসার্চের বাজেট দিয়েছি। তাহলে মনে করি দেশের মানুষ অনেক খুশি হবে, কৃষক অনেক খুশি হবে এবং তারা আশার আলো দেখবে।

আরেকটা প্রবলেম হয়েছে যেটা সবচেয়ে মারাত্মক আমাদের দেশে আমরা ধান উৎপাদন করছি। কিন্তু ধান ক্ষেতে পড়ে থাকছে, কেউ কাটতে যাচ্ছে না। ধানের চাষ হচ্ছে কিন্তু ধান লাগাতে কেউ যাচ্ছে না। তার কারণটা হল, আমাদের লেবার কস্ট অনেক বেড়ে গেছে। গত দুই তিন বছরে প্রায় দেড় গুণ দুই গুণ লেবার কস্ট বেড়ে গেছে। এখন লেবার কস্ট তো বাড়বেই কারণ এ দেশে জিডিপি গ্রথ হলে, পার ক্যাপিটা ইনকাম হলে, ইনফ্লেশন হবে এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে তখন লেবার কস্ট তো তারা ক্লেইম করবে অনেক বেশি।

আমি মনে করি যে যদি এমন হয় যে লেবার কৃষি কাজ করবে না বা যদি করতে হয় তবে অল্প সংখ্যক লেবার আছে তখন তো দাম বাড়বেই। এই ব্যবস্থাটাকে যদি সুষম রাখতে হয় তাহলে আমাদের কী করতে হবে? এখন আমাদের কৃষিতে যন্ত্রপাতি কিন্তু ইন্ট্রোডিউজ করতে হবে। সরকার সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে। গত চার পাঁচ বছর ধরে সাবসিডি দিচ্ছে। সাবসিডির অঙ্কটা অনেক বড় করতে হবে। আমাদের কাছে একটা সাধারণ হিসাব আছে, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে সাধারণত সাতাশ আটাশ টাকা খরচ হয়।

আর এই এক কেজি ধান যদি আমরা যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন করি, এটা ট্রেডিশনালি যন্ত্রপাতি দিয়ে যদি করি তাহলে ষোল সতের টাকার মধ্যে করা সম্ভব। এতো বড় টাকার অঙ্ক কিন্তু সেভ করা সম্ভব। থার্টি পারসেন্ট পর্যন্ত। আমরা যদি সারে ভর্তুকি দিই তাহলে এক কেজি ধানে কিন্তু দেড় থেকে দুই টাকার ইমপ্যাক্ট আসবে। আর যদি আমরা কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভুর্তকি দিই তাহলে ইমপ্যাক্টটা আসবে প্রায় থার্টি পারসেন্টের মতো। সাত-আট টাকা বা দশ টাকা। আমি মনে করি সেক্ষেত্রেও প্রায় চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে একটা ট্রেন্ড তৈরি করা উচিত।

কৃষিতে একটা বিপ্লব আনা উচিত। তারপর দেখা যাবে, কৃষক আর মুখ ফেরাবে না, কৃষির শ্রমিক আর মুখ ফেরাবে না। তারা কৃষিতে থাকবে। স্থানীয়ভাবে যারা যুবক আছে তারা, গ্রামে যারা যুবক আছে তারাও ইনভেস্টমেন্ট করবে সেখানে। তারা ভর্তুকিতে এ সমস্ত যন্ত্রপাতি কিনবে। কৃষককে সার্ভিস দিবে। দেশের বাহিরে যাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে তারা, যারা ফিরে আসছে তারাও কিন্তু যেটুকু টাকা নিয়ে আসছে সেটুকু দিয়ে যন্ত্রপাতি কিনবে। সরকার যে ভর্তুকি দিবে সেটা আর্ন করবে। তখন অভার অল এক দিকে যেমন রিসার্চে আমরা ইনভেস্টমেন্ট করে মিড টু লং টার্মে আমরা বেনিফিটেড হব। আরেক দিকে ইমিডিয়েট বেনিফিটের জন্য আমাদের টেকনোলজিতে ইনভেস্টমেন্ট করা উচিত।

তাহলে ওদিকে যদি চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেয় আর এদিকে যদি চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেয় তাহলে অভার অল বাজেটটা অনেক সুন্দর একটা বাজেট হবে। একদিকে যেমন দেশের কৃষক সন্তুষ্ট হবে। নতুন একটা খবর পাবে। অন্যদিকে দেশের যুবক যাদেরকে বেসিকেলি ভোটব্যাংক বলা হয়, তারা কিন্তু অনেক আশার আলো দেখতে পাবে এবং আমি মনে করি যে তারাও মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট থাকবে। তারা মেন্টাললি প্রিপারড হয়ে কৃষিকাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ভাবেই কিন্তু আমাদের কৃষিতে প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে, কৃষিতে ইনকাম বাড়বে। আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করে খেতে হবে না এবং আমি মনে করি এটা একটা ভালো সুষম কৃষি ব্যবস্থা হবে।

সরকারের যে সমস্ত কৃষি গবেষণাগার আছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে এরা তো অনেক দিন ধরে গবেষণা করছে। এই রিসার্চটাকে গতিশীল করতে গেলে একটা ফান্ড দরকার হবে। যেটা বলছিলাম চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা। যেগুলো প্রোডাক্ট প্রায় রেডি হয়ে আসছে রিসার্চে আউটপুট সেগুলো কিন্তু গতি পাওয়ার কারণে ইমিডিয়েটলি রিলিজ হয়ে যাবে। এক-দুই বছরের মধ্যে কিন্তু এগুলোর ফল কৃষক পেতে থাকব। আর কী হবে? আমাদের প্রিপারেশনটা হবে মিড টু লং টার্মের জন্য। তখন দেখা যাবে যে সাসটেইনেবল একটা কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং ভালো একটা কিছু হবে।

আর আরেকটা ভাগ যেটা প্রাইভেট সেক্টর অনেকে ভাবছে আমরা রিসার্চে যাব কি যাব না, আমরা এই কাজটা করব কি করব না, এরাও কিন্তু যেহেতু বাড়তি টাকা আছে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে টাকা-পয়সাকে ডাইভার্ট করে এই যে বাড়তি যে সাবসিডিটা পাবে বা যে ফান্ডটা পাবে এটাকে তারা উইটিলাইজ করবে। সেক্ষেত্রে হয়তো চার-পাঁচ বছর থেকে শুরু হবে বেনিফিট। কিন্তু এটা অনেক ফাস্ট হবে এ কারণে যে দেশের বাহিরেও তো রিসার্চগুলো আছে, তারা একটা কমিটমেন্ট করে রয়েলিটি করে কোনোভাবে এগুলোকে নিয়ে এসে লোকালি এডাপট করা শুরু করবে এবং কাজগুলো শুরু করতে পারবে।

তো জয়েন্টলি সরকারি রিসার্চ ব্যবস্থা এবং প্রাইভেট রিসার্চ ব্যবস্থাগুলো এমনভাবে এক্সপোডায়েট হবে যার কারণে বেনিফিটটা কিন্তু ইমিডিয়েটলি পাওয়া শুরু করব। দশ বছরের মধ্যে দেখা যাবে যে একটা সুষম কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে যে কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে সেখানে হয়তো কৃষি যন্ত্রপাতি হয়তো আসছে, চাষে আসছে, পানি সেচের ক্ষেত্রে আসছে, ধান লাগনোর ক্ষেত্রে আসছে, ধান কাটার ক্ষেত্রে আসছে। এগুলোকে কিভাবে আরও গতিশীল পাবে? যখন এটাতে সাবসিডি দিবে তখন এটা অনেক সস্তা হয়ে যাবে। আমাদের দেশের ইয়াং যারা আছে তারা তো রেডি আছে। তারা এটা কেনা শুরু করবে এবং সার্ভিস দেওয়া শুরু করে দিবে।

আমরা তো বলেছি যে কৃষি ব্যবস্থা, সেখানে আমি কৃষি বলতে যা বলেছি যে আমরা মাঠ ফসলের কথা বলেছি, সবজির কথা বলেছি, ফলের কথা বলেছি, মাছের কথাও বলেছি, পোল্ট্রির কথা বলেছি, আমি ক্যাটলের কথা বলেছি। আমি মনে করি যে ক্রপে বিশেষ করে ইমপ্রেসাইজ দেওয়া উচিত আর ক্যাটলে সবচেয়ে বেশি ইমপ্রেসাইজ দেওয়া উচিত।

মাছের ক্ষেত্রে মোটামুটিভাবে ভালো একটা প্রগ্রেজ হয়েছে। সেখানেও হয়তো কিছুটা প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। পোল্ট্রির ক্ষেত্রে অতটা হয়তো রিসার্চে এই মুহূর্তে প্রায়োরিটি দেওয়া লাগবে না। কিন্তু আমি মনে করি ক্রপে, বিশেষ করে মাঠ ফসল, সবজি এবং আমাদের ফলে একটা প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত।

আর সাথে সাথে ক্যাটলের ক্ষেত্রে। ক্যাটলের ক্ষেত্রে যেটা করতে হবে আমাদের পার ক্যাপিটালে ক্যাটলের মিল্ক আমাদের বাড়াতে হবে। এটা বাড়াতে হলে আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইনসিফেশন লাগবে। তার জন্য অনেক ভূমি স্টেশন করতে হবে দেশে। সরকারের যেটা আছে তার পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও করতে হবে।

তাহলে কি হবে অনেক বেশি ক্যাটলকে আর্টিফিসিয়াল ইনসিফেশন করলে হাই কোয়ালিটির আমাদের ক্যাটল আসবে এবং তার দুধ দেওয়া ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের ইনভেস্টমেন্ট করা উচিত সরকারের। তো এক দিকে যেমন ক্রপ আরেক দিকে আমি এনিমেল ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রায়োরিটি হওয়া উচিত ক্যাটলের। এই দুটো জায়গাতেই কিন্তু ইমপ্রেসাইজ করা উচিত এবং প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত।

ড. এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এসিআই এগ্রিবিজনেস।

রাসেল/