বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যানকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতায় এই মহান বানী দুটি প্রতিটি মানুষের কাছেই অনুপ্রেরণার উৎস।শুধু তাই নয়,পুরুষদের কাছে স্পৃহা বা উদ্দীপনা বাড়ায় সেও কিন্তু নারী। হতে পারে সে কখনো তার মা,তার বোন, ভালো কোন বন্ধু অথবা প্রেয়সী।এবং অবশ্যই স্ত্রীরই সেটা হওয়া উচিত।
বিধাতার অজস্র সুন্দর সৃষ্টির মাঝে নারী হচ্ছে এক অনুন্য সাধারন অপরূপ সৃষ্টি!কোন এক নৈসর্গিক আবেশে অপরূপ প্রকৃতির মাঝে হঠাৎ শাড়ীর আচল হাওয়ায় উড়িয়ে, হেঁঠে চলা কোন এক নারীকেই কল্পনা করেন কবি।শুনতে পান নারীর সশব্দে মায়াময় হাসি।যা চিরকাল কবিরা শুনতে ভালোবাসেন।হতে পারে এক মুঠো রেশমী কাঁচের চুড়ি পড়া মায়াবতীর হাতছানি,অথবা রুনুঝুনু শব্দে দৌড়ে চলা আলতা পড়া ফর্সা পায়ের সৌন্দর্যময় কিশোরী!এসবই কবি,তার কবিতার তুলিতে নারীকে নিয়ে বন্দনা করেন।কবি-সাহিত্যিকরাই যুগে যুগে প্রকৃতি ও নারীর মাঝে খোঁজে ফেরেন নীটল রহস্য।ফুটিয়ে তোলেন এ দুয়ের ভেতর অসামান্য সামঞ্জস্যতা!নারীদের নিয়ে হাজারো স্তুতিগান গেয়ে থাকেন তাদের রচনায় বা পঙতিমালায়।

জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি একজন নারী অজস্র ভূমিকা পালন করে থাকেন।বাবার বাড়ীতে বেড়ে ওঠা আহলাদি কিশোরী হঠাৎ করে দায়িত্ব সম্পর্কে বুঝে উঠতে শুরু করে।সে যেমন তার বাবা, ভাই সবার দিকে পরম মমতায় খেয়াল রাখে;তেমনি সাংসারিক কাজে মাকে সাহায্য করতে উদ্যত হয়।বিয়ের পর স্বামী এবং সংসারে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে নারী।ভালোভাবে স্নাতকোত্তর পাশ করেও এমনকি উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েও নারী ঘরে বসে থাকে শুধুমাত্র সন্তানের কথা চিন্তা করে।যে সন্তান ও স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ীর জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয় যে নারী তাকেই একসময় তাদের কাছ থেকে শুনতে হয়,”তুমি তো সারাদিন ঘরে বসেই থাকো।’

কখনো পুরো পরিবারের জন্য নিজের জমানো পুরো টাকা নিঃসঙ্কোচে খরচ করে ফেলে তবু দিন শেষে তার পাতে ভাতের ছিঁটে ফোঁটাও থাকে না।এমন উদাহরন এখনো অনেক পাওয়া যায়।বয়সকালে স্বামীহীনা অসহায় নারী পুত্র বা কন্যার কাছেও বোঝা হয়ে ওঠে।একজন উচ্চপদস্থ সরকারী নারী কর্মকর্তা শেষ বয়সে সন্তানের জন্য নিজের বাড়ী বিক্রি করে দিয়েও মন পাননি।চরম অবহেলার শিকার অগত্যা বোনের বাসায় গিয়ে ওঠেন।একসময় দেহাবসান ঘটিয়ে ঝরে পড়েন নারী।এটাই নারীর জীবন।মোমের মতো সবাইকে আলোকিত করে নিজেই ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যান আত্মত্যাগকারী নারী। কোন এক নিভৃতে অশ্রু ফেলা নারীর দীর্ঘশ্বাস, “সাড়ে তিন হাত মাটিই বুঝি আমার প্রধান আশ্রয়?’
তবে না দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে।যেমন নারীর প্রতি সবাইকে তেমনি নারীর নিজেকেও।পুরুষরা তো বাইরে অার্থিক উপার্জনেই ব্যস্ত?পুরো সংসারের বোঝা,সুখ-দুঃখ,হাসিকান্না নারীরাই সামাল দেন ।কাজেই তার পরম মমতার উষ্ণ ছোঁয়াতেও কঠিন পাথর পরশ পাথরে পরিণত হতে দেরী হয় না।

নারীর প্রেম নিয়ে অস্কার ওয়াইলডের শ্রেষ্ঠ বাণী -“নারীরা ভালোবাসার জন্য,জানার জন্য নয়।’
নারীর রয়েছে একটা অসাধারন কোমল মন।কথায় আছে নারী যা মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, ধ্যানে-জ্ঞানেই সেই সদা বিচরণ করে।বাঙালি সাধারন প্রেয়সী বা গৃহবধুই তার উৎকৃষ্ট উদাহরন।অস্কার বিজয়ী টাইটানিক ছবিটির একটি বিখ্যাত উক্তি,”A woman’s heart is deep ocean of secret -Old Rose’
অর্থাৎ প্রতিটি নারী হৃদয় যেন গভীর সমুদ্রের মতোই অতল।সত্যই তাই।নারী তার চপল-চঞ্চল,মুগ্ধ চোখে পুরো পৃথিবীকে দেখে এক অসামান্য রূপে।খোঁজে নীবিড় দার্শনিকতা!শান্তির ধর্ম ইসলামে নারীর মর্যাদা খুবই তাৎপর্যপূর্ন।ইসলামে বাবার চাইতে মাকে অধিক গুরুত্ব(পরপর তিনবার)দেয়া হয়েছে।এছাড়া সব ধর্মে মায়ের মর্যাদা বিশেষ অগ্রগণ্য।

প্রাচীনকালে যৌবনা অসহায় নারী পেটের দায়ে কারো দাসী হতে বাধ্য হতো।এমনকি জাহেরি-বাতেনি যুগে নারীরা ধনবানদের ভোগ-বিলাসের শিকার হতো।সহ্য করত অসহনীয় অপমান।নারী শিশুটিকে কবরে পর্যন্ত দিয়ে দেয়া হতো।বিধবা নারীকে স্বামীর সাথে চিতায় জ্বলতে হতো।সেই নারী এখন পৃথিবীর কোথায় বিচরণ করছে না?এমনকি চাঁদেও অবতরণ করছে।নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আন্দোলন আগের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত।গড়ে উঠেছে নারী নির্যাতন সংস্থা,বিভিন্ন এন জি ও,আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)।যেখানে নারীরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারছেন।নারী শিক্ষক,পাইলট,ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, উকিল,ব্যারিষ্টার অথবা জজ এমনকি প্রশাসনিক কাজেও (র‍্যাব,পুলিশ, সৈনিক)দায়িত্ব পালন করছেন।সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতেও ভূমিকা পালন করছে আজকের নারী।বিভিন্ন সুন্দরী প্রতিযোগীতা,নাচ,গান অথবা অভিনয়ে, নিজেদের সর্বোচ্চ প্রতিভাকে তুলে ধরছে। এমনকি পুরো পৃথিবী জুড়েই এটি বিশেষ আকর্ষনীয় ব্যাপার হয়ে উঠছে নারীদের কাছে।আর রন্ধনশিল্পে নারীদের বন্দনা তো ঘরে বাইরে সবখানে।কথায় আছে,শ্বশুরবাড়ীর মন পেতে চাইলে ভালো করে পেট পুজো করাও ব্যাস হয়ে গেল।কর্পোরেট পেশাতেও নারী পিছিয়ে নেই।এছাড়া ঘরে বসে অাউটসোর্সিং এর মাধ্যমে শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী নারী রোজগার করতে পারছেন।অনলাইন বুটিকস বা জুয়েলারি প্রভৃতি ব্যবসাতেও নারীদের আগ্রহ বেড়ে গেছে।বলতে দ্বিধা নেই দেশের প্রধান ক্ষমতাধর ব্যক্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী(শেখ হাসিনা),প্রধান মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী (রওশন আরা এরশাদ)এবং জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার (শিরীন শারমীন চৌধুরী) সবাই নারী।
সমরেশ মজুমদার একটি কথা বলেছেন,

“ছেলেরা ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে যে কখন সত্যি ভালোবেসে ফেলে তা নিজেও জানে না।মেয়েরাও সত্যিকার ভালোবাসতে বাসতে যে কখন অভিনয় করে তারা নিজেরাও জানে না।’
নারীদের কাছে পুরুষদের হৃদয় প্রতারণার জাল অথবা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।কারন পুরুষরা আর যদি সে কাব্যিক পুরুষ হয় তার মায়াজালে আটকা পড়তে পারে হাজারো অবুঝ নারী।এভাবে বহুবার পুরুষরা নারীদের কাছে ধরা পড়ে নাজেহাল হয়েছেন বৈকি।তবে বর্তমানে প্রেমের ক্ষেত্রে পুরুষ নয়,নারীরাই বেশী অবিশ্বাসী।বিশেষ করে যেসব নারী আর্থ-সামাজিক ভাবে উন্নত বা আত্মনির্ভরশীল তারা এ কাজটি বিশেষ কৌশলের সাথে করে থাকেন।ভারতে একটি জরিপে তা দেখা গিয়েছে এমন কিছু নারীর একাধিক সঙ্গী।এবং ভয়াবহ ব্যাপার তারা এ বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিক ভাবছেন।তবে ধর্মীয় মুল্যবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষার যথেষ্ট অভাব থাকলে ব্যাক্তিগত,পারিবারিক বা সামাজিক অবক্ষয় ছাড়া কিছুই ঘটবে না।হোক সে নারী অথবা পুরুষ।এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে নারীদেরকে ছলনাময়ী বলা হচ্ছে।নারীর কারনে ঘরে আগুন লাগে,নারীর কারনে ট্রয় নগরী ধবংস ইত্যাদি বিদ্বেষী মূলক উক্তিতে দায়ী করতে চান,কিছু পুরুষবাদী মানুষ।তাই,সংস্কৃতির ভাষায় নারী কখনো পদ্মমনি(গুনবতী ও লক্ষী হিন্দুদের আরাধনার প্রিয় দেবী বা ভালো নারী),কখনো দুষ্ট,বিষধর সর্পিনী বা হস্তিনী(দুষ্ট ও হিংসুটে নারী)বলা হচ্ছে।তবে প্রকৃতই,এক পাল্লায় সব নারীকে মাপা সঠিক নয়।কারন নারীই মা জাতি।সবই অশুদ্ধ নয়,তবে তো পৃথিবী কবেই ধ্বংস হয়ে যেত?জীবনে পঁচা শামুকে পা কেঁটে গিয়েছিল কারো ছলনায়, তাই বলে গোবরেও পদ্ম ফুল ফোঁটে।সাধনা করে যখন সে মহামুল্যবান পদ্মমনি পায় স্রষ্টার কৃপায় জীবন আশীর্বাদেও ভরে যায়।

নারীদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্য যেমন বাল্যবিবাহ,যৌতুকের ছোবল,শ্বশুরবাড়ী কর্তৃক নিরীহ গৃহবধু নির্যাতন,গৃহকর্মী নির্যাতন,খুন,ধর্ষন,ইভটিজিং এখনো সামাজিক ব্যাধি।এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা বাড়াতে হবে।দুই বছর হওয়ার সাথে সাথে কন্যা শিশুটির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন ও বাধা নিষেধগুলো মেনে চলতে পারলে পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে শিশুটির সুস্থ,সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে উঠবে।
শেষতোক কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,”নারীরা দাসী বটে,সেই সঙ্গে নারী রানীও বটে।’
রানী হও নারী,জয়ি হও শুভকামনা।

হাসিনা সাঈদ মুক্তা
ক্যান্টনমেন্ট,ঢাকা।