ব্যবসাবান্ধব স্থিতিশীল নীতিমালা দরকার

এম. নাসিমুল হাই, এফসিএস
আমাদের দেশের ব্যবসা প্রসারে মূল বাধা সম্পর্কে বলতে হয়, একটা স্থায়ী ব্যবসা বান্ধব নীতিমালার প্রয়োজন। যার মাধ্যমে এর দীর্ঘমেয়াদী সুফল ব্যবসায়ীরা পাবে। যে নীতিমালার দ্রুত পরিবর্তন হবে না। এমন একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

এমন নীতিমালা না থাকায় কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে : আমরা ব্যবসার জন্য প্রচুর পণ্য আমদানি করছি। অর্থাৎ বহিঃবিশ^ থেকে আমরা সস্তায় পণ্য নিয়ে আসছি যেগুলো মান সম্পন্ন নয়। এই ব্যাপারটা তদারকির জন্য যদি কেউ থাকতো তাহলে ভালো হতো, তাছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা না থাকলে, ব্যবসা ক্ষেত্রে আমরা আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। এর ফলে আরো অনেক স্পন্সর এদেশে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত হতেন। আজ আমরা বিদেশিদের উৎসাহিত করছি আমাদের দেশে বিনিয়োগের জন্য, এতে কিন্ত আমরা প্রয়োজনের তুলনায় তেমন সাড়া পাচ্ছি না। অথচ আমাদের দেশের বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে বাইরে। চাইলে তাদেরকেই আমাদের দেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারতাম।

বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের ব্যবসা ডাইভারসিফিকেশনের মাধ্যমে, আজ এই পর্যায়ে আসার পেছনে কোন ব্যাপারটি কাজ করেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,বসুন্ধরা যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৮৭ সালে। তখন আমরা ছিলাম রিয়েল এস্টেট সেক্টর নিয়ে। সে সময় আমাদের শহরের বাসস্থানের ব্যাপক সমস্যা ছিল। আমাদের ভূমির সমস্যা থাকলেও আরবান এলাকায় এটা প্রকট ছিল। যার অভাব বোধ থেকে বসুন্ধরা তার প্রথম উদ্যোগ নেয়া শুরু করে। এর পর আপনারা দেখবেন, সরকার বা রাজউকের চাইতেও আমরা অনেক ভালো মানের বাসস্থান নির্মাণ করেছি। যেগুলো অবশ্যই নিরাপদ বাসস্থান। মানুষের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য প্রয়োজন সিমেন্ট। এক সময় আমরা বাইরে থেকে সিমেন্ট আমদানি করে আনতাম। এ প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখেই সর্বপ্রথম একক মালিকানায় আমরা সিমেন্ট খাতকে গুরুত্ব দিয়ে, দ্বিতীয় ধাপে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি স্থাপন করি, যা ছিল মংলায়। যেখানে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না। বসুন্ধরা কিন্ত এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মাধ্যমে সর্বপ্রথম সেখানে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। এ খাতের কথা যদি চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের মধ্যে কিন্ত আমরাই পাইয়োনিয়ার। তারা কিন্ত আমাদের দেখেই উৎসাহিত হয়েছে। যার ফলে আমরা দেখেছি, প্রতি বছরই দেশে একের পর এক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি স্থাপন হচ্ছে ।

১৯৯৭ সালে আমরা বাজারে নিয়ে আসি বসুন্ধরা পেপার মিলস্। তারই অন্যতম একটা প্রডাক্ট বসুন্ধরা টিস্য্। এই প্রাডাক্টটা আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে সারা দেশে পৌছে দিতে সমর্থ হয়েছি। কিন্ত এর আগে আমরা পুরোপুরি আমদানি নির্ভর ছিলাম। এর সাথে শিশুদের ডায়াপারও নিয়ে আসি বাজারে। তারপর আমরা হাত দিয়েছি এল পি গ্যাসে। একটা সময় কিন্ত আমাদের দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। যেভাবে আমরা আমাদের রিসোর্স ব্যাবহার করছি, এর এক পর্যায়ে গিয়ে এর সার্ভিস আমরা পাইপের মাধ্যমে দিতে পারব না। আমরাই প্রথম এর বিকল্প চিন্তা করে রেখেছি, প্রায় ১৮ বছর আগে। আমরা সে সময় বসুন্ধরা এলপি গ্যাসকে ইউনিয়ন এলপি গ্যাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি, যা এখন বসুন্ধরা এলপি গ্যাস হিসেবে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। আপানারা জানেন ঢাকা শহরে, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্যাসের কত সংকট যাচ্ছে। বসুন্ধরা কিন্ত এ ক্ষেত্রেও পাইয়োনিয়ার। আমাদের পথ ধরেই এখন দেশে অর্ধ ডজনের মতো কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কিছুদিন আগে আমরা বসুন্ধরা ফুড এন্ড বেভারেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে সারা দেশে যে হারে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি, এর ভিরে আমরা আমাদের এই ফুড পণ্য বাজারে নিয়ে আসছি। যার একটাই উদ্দেস্য, আর তা হলো ভেজাল মুক্ত খাবার। আপনারা জানেন ইতিমধ্যে খাবারের বেসকিছু প্রডাক্ট আমরা বাজারে নিয়ে এসেছি। আর অবস্যই সেটা আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত হচ্ছে। এক সময় আমরা এসব পণ্যসহ অনেক ধরনের পণ্যের জন্য আমদানি নির্ভর ছিলাম। এখন এর বেশিরভাগই আমাদের দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এ জন্যই বলছি, এখনই সময় আমাদের সঠিক নীতিমালার। যার মাধ্যমে কম মূল্যের মানহীন পণ্য আমদানি বন্ধ করা সম্ভব হবে। না হলে আমরা যারা দেশে বেসিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি, আমরা কিন্ত মার খেয়ে যাব। এজন্য সরকারি প্রটেকশনের প্রয়োজন। তা হলে আমাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হবে। এবং মানসম্পন্ন পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে পারব।

এতোবড় মাল্টিপল ব্যবসার ব্যবস্থাপনা পরিচালনা কিভাবে করেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ম্যানেজম্যান্ট ও বোর্ডকে আলাদা করে ফেলেছি। যেটা কর্পোরেট গভর্নন্সের প্রথম শর্ত। অর্থাৎ কোম্পানির এন্টিটি ও বোর্ডের এন্টিটি আলাদা করায় যেটা হয়েছে, আমরা ম্যানেজমেন্টে যারা আছি, আমরা আমাদের গতিতে চলি। বোর্ড তার কোম্পানির প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন। আর আমরা সেটা ম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে পরিচালনা করি, তাদের সিদ্ধান্ত ইমপ্লিমেন্ট করি। যে কোন ভালো কোম্পানির গতিশীলতার মূলমন্ত্রই হলো তার ম্যানেজমেন্ট ও গভর্নিংবডিকে আলাদা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। যার কারণে ম্যানেজমেন্ট টিম যে কোন বিষয়ে বোর্ড অব ডিরেক্টরদের কাছে রিপোর্ট করে। বোর্ড অব ডিরেক্টর্স নির্ভর করে ম্যানেজমেন্টের ওপর। এবং উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও আস্থা রয়েছে বলেই বসুন্ধরা গ্রুপের আজকের এই অবস্থান।

পুঁজিবাজারে বসুন্ধরা গ্রুপের অংশগ্রহণ: মেঘনা সিমেন্ট হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে দেখেন, সেটা বসুন্ধরা গ্রুপেরই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আমাদরে আরেকটা ব্র্যান্ড রয়েছে বাজারে, বসুন্ধরা সিমেন্ট। এটা কিন্ত পুরোপুরি আলাদা একটা কোম্পানি। আর মেঘনা সিমেন্ট থেকে আসে কিংব্য্রান্ড সিমেন্ট। এটা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, যা পুঁজিবাজারের লিস্টিংয়ে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। আমাদের বোর্ড অব ডিরেক্টর্স বিশ^াস করে, বিনিয়োগকারীদের গুরুত্ব সহকারে ভ্যালু দেয়ার বিষয়টা। ইনভেস্টররা যে আস্থা রেখে আমাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে তাদের সবসময় আমরা সম্মানিত করার চেষ্টা করি। লিস্টেড হবার পর আমরা এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার ডিভিডেন্ট দিয়েছি। প্রতি বছরই আমরা আমাদের শেয়ার হোল্ডারদের সম্মানজনকহারে ডিভিডেন্ট দেয়ার চেষ্টা করছি । তারাও আমাদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে আস্থাবান আছেন। তাদের সেই আস্থার জায়গা থেকেই আমাদের আরেকটা কোম্পনিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। সেটা হলো বসুন্ধরা পেপার মিলস্।

বসুন্ধরা পেপার মিলস্-এর মোট প্রোডাক্টের পরিমাণ ৮৭টির বেশি। কেবল পেপারেই তো রয়েছে আমাদের বিশাল তালিকা। সিগারেট পেপার থেকে শুরু করে রাইটিং পেপার, অফসেট পেপার, বিভিন্ন ধরনের র‌্যাপিং পেপার্স সবই আছে। এমনকি আপনারা যে সিমেন্টের ব্যাগ দেখেন, তার সবগুলোর কাগজ আমরা তৈরি করে সাপ্লাই করি। তাছাড়া শিক্ষা উপকরণের জন্য বর্তমানে বাজারে বাচ্চাদের জন্য বসুন্ধরা খাতা তৈরি করে দিচ্ছে। এ ক্ষত্রে আমরা সাবসিডি দিই। শুধু তাই নয় যদি কেউ এমন প্রডাক্ট তৈরি করে নিতে চায়, সেটা আমরা আমাদের ব্যবস্থায় তাদের প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করে দিতে পারি। মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণেই বসুন্ধরার পথ চলার শুরু, এবং এখনও আমরা সেই কমিটমেন্টেই এগিয়ে যাচ্ছি।

এম. নাসিমুল হাই,এফসিএস
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ও গ্রুপ কোম্পানি সেক্রেটারি
বসুন্ধরা গ্রুপ