চাল ও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড

ভুগিয়েছে বছরজুড়ে

বিদায়ী ২০১৭ বছরটিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিই গেছে। মোটামুটি বছরজুড়েই তা বিরাজ করেছে। তবে উৎপাদন বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যতটা হওয়ার মতো প্রত্যাশা ছিল, তা পুরো মাত্রায় পাওয়া যায়নি। বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল সহনীয় মাত্রায়। তবে চালের দামের উর্দ্ধমূখীতা এবং বছরের শেষ দিকে এসে পেঁয়াজের রেকর্ড গড়া দাম সাধারণ মানুষকে বেশ ভোগিয়েছে। এছাড়া অকাল বন্যা ও বছরের শেষ দিকে হঠাৎ নেমে আসা রোহিঙ্গা স্মরণার্থীদের ঢল বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

মূল্যস্ফীতির সহনীয়তা : দু’একটি ভোগ্যপণ্যবাদে বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল সহনীয় মাত্রায়। আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিতই করে এই সূচকটি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও যদি যথাসময়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত, তবে দ্রব্যমূল্যে কিছুটা হলেও তার সুফল পাওয়া যেত। বিদায়ী বছরে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশী ছিল সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ১২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। তবে পরে মাসে অর্থ্যাৎ অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৬ দশমিক শূণ্য ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্য স্ফীতিকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার প্রাক্কলন করেছে।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। অর্থবছররের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হয় ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।

সরকার বলছে, প্রলম্বিত বর্ষার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কারণ বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় না করতে পারায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রয়েছে। তাই আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শীতের ফসল ঘরে তোলা শেষ হলে এবং সবজি বাজারে আসলে মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নভেম্বর মাসে দাম আরও কমবে।

চাল ও পেঁয়াজের দামের উর্দ্ধমুখীতা : বিদায়ী ২০১৭ বছরে সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে চালের দামে উর্দ্ধমুখীতা। বছর জুড়েই চড়া মূল্যে চাল কিনে খেতে হয়েছে সাধারণ মানুষদের। গেল বছর যে মোটা চাল প্রতিকেজি ৩২ থেকে ৩৩ টাকায় কেনা গেছে, সেই মোটা চাল এ বছর প্রতিকেজি ৫০ টাকা কিনতে হয়েছে। সরু চাল কেনার জন্য প্রতিকেজিতে গুণতে হয়েছে প্রতি কেজিতে ৬৫ থেকে ৬৭ টাকার বেশি।

অন্যদিকে সরকার চাল আমদানির উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারসহ চাল আমদানি করেও দাম কমাতে পারেনি। হাওর অঞ্চলের সাত জেলায় এ বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। আর ১৯ জেলায় ধানখেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই কারণে এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। এই অবস্থায় ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অন্যদিকে, পেঁয়াজের ঝাঁজে রীতিমতো কোঁদেছেন ক্রেতারা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ১৪০ টাকা পর্যন্ত ছুঁয়েছে! আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের কেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। রেকর্ড গড়া পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে পেঁয়াজের। বিশেষ করে ভারতীয় পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়ায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির বাজারে আগুন লেগেছে। সম্প্রতি হঠাৎ করেই ভারতীয় পেঁয়াজের রফতানি মূল্য একলাফে টন প্রতি ৩৫২ ডলার বাড়ানো হয়।টিসিবির হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম প্রায় ১৫৩ শতাংশ এবং আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা : চলতি অর্থবছরে রফতানিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রবৃদ্ধি এক মাসে বেড়েছে তো পরের মাসে কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তিন মাসেই চলেছে এই পালাবদল। বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রফতানি বেড়েছে ২৭ শতাংশ। পরের মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে রফতানি অনেক কমে যায়। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ আয় আসে। আশার খবর হলো, সর্বশেষ অক্টোবরে আবার বেড়েছে ৬ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে রফতানি হয়েছে ২৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এই আয় ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। এদিকে ২০২১ সাল নাগাদ শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে রফতানি আয়ে গতি আনতে ১৬টি বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সরকারী ও বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মস পরিদফতরে সংস্কার, বন্দর সমন্বয়ে ডিজিটাল সেল প্রতিষ্ঠা, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো পুনর্গঠন এবং জাতীয় রফতানি হাউস স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং তা বাস্তবায়নে নানামুখী পদক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব পরিবর্তন ও যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বাণিজ্যে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা পর্যালোচনা করেছে সরকার। কিন্তু এর কোন প্রভাব দেশের রফতানি আয়ে পড়েনি।

বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি : বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৩১ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের ঘাটতির ১২৪ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের (জুলাই-অক্টোবর) তুলনায় ৭৪২৫ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যে ৪ কোটি ৪ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। আর অর্থবছর শেষ হয়েছিল ১৪৮ কোটি ডলারের ঘাটতি নিয়ে। আমদানি বাড়তে থাকায় এ অর্থবছরের বাকি সময়েও ঘাটতির এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে পর্যাপ্ত প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকায় উদ্বিগ্ন হওয়ার খুব বেশি কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ২৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। তাছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল সহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতেও ব্যয় বেড়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে যথাক্রমে ২৮ শতাংশ এবং ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি ব্যয় যেখানে ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে রফতানি আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি অর্থ হল দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে। আমদানি ব্যয় বাড়ায় জুলাই-অক্টোবর সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭৯ কোটি ১০ লাখ (৫.৮ বিলিয়ন) ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এই চার মাসে ১ হাজার ৭১৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আর বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে এক হাজার ১৩৫ কোটি ডলার।

বিদায়ী অর্থবছরে আলোচিত ঘটনার মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নামে-বেনামে অর্থ তুলে নেওয়ার প্রতিযোগীতা ছিল আলোচনার তুঙ্গে। এজন্য ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বিদায়ী বছরের শুরু দিকে রেমিটেন্স প্রবাহে মন্দাভাব থাকলেও সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে অক্টোবরে রেমিটেন্স এসেছে ১১৬ কোটি ডলার। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ৩০ কোটি ডলার।

আজকের বাজার : এসএস /ওএফ/ ডিএস/এলকে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭