শাহী খাবারকে আন্তর্জাতিক পরিচয়ে নিতে চান সামীমা

সামীমা খাতুনের স্বপ্নের রঙ। ইভেন্ট, ওয়েডিং প্ল্যানার অ্যান্ড ক্যাটারিং। একসঙ্গে ৪০ হাজার মানুষের খাবার আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সব দায়িত্ব নিতে পারে। তার বাবার ব্যবসাও এটাই। বিবিএ শেষ করে নিজেও বেছে নিয়েছেন বাবার গোছানো ব্যবসা। তবে একেবারেই অন্যরকমভাবে। নিজের সৃষ্টিশীলতার ছাপে ছাপে ছাপিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে। আমাদের একান্ত নিজস্ব শাহী খাবারকে আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান । এ দেশে কি ক্যাটারিং ব্যবসায় আর কোনও নারী ব্যবসায়ী আছেন কেউ? আমাদের অন্তত জানা নেই। সামীমা খাতুন তার শাহী খাবারের গল্প বলেছেন আজকের বাজার ও এবি টেলিভিশনের কাছে। শোনা যাক সেই গল্প–

ক্যাটারিং শিল্পের সার্বিক অবস্থা নিয়ে যদি বলি। সবার আগে বলতে হবে আমাদের এখানে খাবারের মান ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার বিলিন হয়ে যাচ্ছে। তবে আমার প্রতিষ্ঠান এখনো মান ধরে রেখেছে। আমাদের এটা পারিবারিক ব্যবসা। ১৯২৬ সাল থেকে এই ব্যবসার সঙ্গে আমাদের পরিবার জড়িত। এই ব্যবসার নাম প্রথম দিকে ছিল বাবুর্চি, এরপর শেফ আর এখন ক্যাটারিং হিসেবেই এর পরিচয়। আমার বাবার সময় থেকে যে সব ঐতিহ্যবাহী খাবার ছিল আমি শামিমা’স ক্যাটারিং সেগুলো ধরে রেখেছি। বাজারে ক্যাটারিংয়ের নামে অনেকেই হয়তো মানের ব্যাপারে কিছুটা আপোষ করছে। আর এখানেই আমরা ভীষণ প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে যাচ্ছি কারণ মানের ব্যাপারে আমরা কোনোমতেই আপোস করতে পারছি না। সার্বিকভাবে এটাই এখনকার ক্যাটারিং ব্যবসার চিত্র বলতে পারি।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এই ব্যবসা
আমার বাবার ব্যবসা ইব্রাহিম ক্যাটারিং। আমি একজন নারী হিসেবে এই ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে শুরুতে হতে চেয়েছিলাম ফ্যাশন ডিজাইনার। এ দেশে নারীরা আসলে এ ধরনের খাবার কিংবা সরাসরি বললে ক্যাটারিং ব্যবসার সঙ্গে খুব একটা জড়িত নেই। আমার ভাবনা ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো ধরে রেখে পাশাপাশি সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুড লাভারদের সেবাটা দেওয়া। এই লক্ষ্যে ক্যাটারিং ব্যবসার মান ঠিক রেখে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়াটাই আমার কাজ বলে মনে করছি। এই ক্যাটারিংটাও কিন্তু ভীষণ ক্রিয়েটিভ একটা জগত।

সামিমা’স ক্যাটারিংয়ের বিশেষত্ব
আমাদের স্পেশালিটি কোথায়? আমাদের নিশ্চয়ই আলাদা কিছু ব্যাপার আছে। যেমন ধরেন, আমার দাদা-বাবার আমল থেকে চলে আসছে, আমরা যে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করি সেটাতে ১৩ কেজি চালের সঙ্গে ২৬ কেজি খাসির মাংস দিই। এখানে কোনো আপোস নেই। শহরে অনেক নামকরা কিংবা নতুন অনেক ক্যাটারিংকে কিন্তু দেখবেন তারা ১৩ কেজি চালের সঙ্গে ১৫ কেজি মাংস দিচ্ছে। এখানেই তো মান আর দাম সাশ্রয়ের প্রসঙ্গটা চলে আসে। আর এতে করে কাস্টমারও খুব ভালো কিছু পাচ্ছে না, সন্তুষ্টও হতে পারছে না। এসব পার্টি কাস্টমারকে কম দামে দিতে পারছে এটা কিছুটা সত্য। তবে এর পরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কারণ একটা অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে খাবার। খাবারের মানে আপোষ করে তথাকথিত ক্যাটারিং ভালো খাবার দিতে পারছে না । ফলে কাস্টমার বিরক্ত হচ্ছেন, নিন্দিত হচ্ছেন অতিথিদের কাছ থেকে।

আমার দাদার আমলে শাহী খাবারে রাজ দরবারের খাবারে কি চিকেন রোস্টে টেস্টিং সল্ট, টোম্যাটো সস্ এসব দেওয়া সম্ভব ছিল? না তখন এসবের অস্তিত্ব ছিল? আমাদের কেউ যদি খাবার অর্ডার করে, আমাদের ক্যাটারিংয়ে আমরা কিচেনভিজিট অ্যালাউ করি। এটা আমাদের একটা স্পেশালিটি। বিশেষ করে খাসিতে অনেকেই ভেজাল করে। আমরা কাস্টমারের সামনেই খাসি জবাই করে প্রসেস করে দিই। এটাও আমাদের বিশেষত্ব বলতে পারেন।

মসলার ব্যাপারেও আমরা সচেতন। হলুদ, লাল মরিচের গুড়ো এসব আমরা নিজেরাই মিল থেকে ভাঙ্গাই আর দেশের বাজারে সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দিয়ে যারা মসলা বেচে তাদের মসলাই আমরা ব্যবহার করি। এসব কারণে অন্যদের তুলনায় আমাদের একটু বেশি চার্জ পরে। কাস্টমারও বলেন অমুক জায়গায় তো চার্জ কম আপনারটা কেশি কেন? তাদের তো আমরা আর এতটা বিস্তারিতভাবে বোঝাতেও পারি না, বলতেও পারি না।

ব্যবসায়ী হিসেবে আমার সমস্যা
আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ ভ্যাট। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, চেয়ার-পাতিল সব কিছুতেই আমাকে আলাদা আলাদা করে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আমার তো প্রফিট ওঠাতেই কষ্ট তার পর আবার ঘাটে ঘাটে ভ্যাট! এই ভ্যাটটাই আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমার স্থায়ী আর অস্থায়ী মিলিয়ে ৫০-৬০ জন স্টাফ আছে তাদের বেতন দিতে হয়। নিয়মিত ও অনিয়মিত সব মিলিয়ে স্টাফ বেতন কম নয়। এত কিছুর পর ১৫ ভাগ ভ্যাট আমার ব্যবসা প্রসারে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। আর একটা চ্যালেঞ্জ আছে—- নারী হিসেবে আমার তো ঘরের টান আছেই, দায়িত্ব পালন করতেই হয়। আবার বাইরে এসে দেখা যাচ্ছে এই ক্যাটারিং ব্যবসার প্রায় সবটাই পুরুষ সমাজ নিয়ন্ত্রিত। এখানে নারী হিসেবে কোনও ছাড় নেই। তাই আমার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমার মতো আরো নতুন নারীরা এসে পুরোনো শাহী খাবারকে একটুও মান নষ্ট না করে আধুনিক মানুষের সামনে পরিবেশন করুক। এই ব্যবসায় মেয়েদের অবস্থান আরো শক্ত হোক। তাহলে হবে কী,যারা মানহীন খাবারের ব্যবসা করছে তাদের ব্যবসা এমনিতেই হারিয়ে যাবে। কাস্টমাররা আমাদেরই খুঁজবে।

স্বপ্নের রঙ এখন আর কী করছে
স্বপ্নের রঙ ওয়েডিং প্ল্যান করছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করছে। এটা নিয়ে আমার একটু বলার আছে, দেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম হচ্ছে। তারা মনে করে খানিকটা ফুলের সাজ-সজ্জা আর মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ করলেই এই কাজ হয়ে যায়। আসলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট একটা অত্যন্ত দায়িত্বশীল কাজ। একটা অনুষ্ঠানের শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে দেওয়াটা হলো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব। আমরা শতভাগ এ কাজটাই করতে চাই। এ-টু জেড সব।

ক্যাটারিংয়ের মধ্যে আমরা বিয়ে আর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের খাবার তো দিচ্ছিই। এ ছাড়া এনগেজমেন্টের ৩০-৪০ জনের খাবার কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের অনুষ্ঠানের হোম ডেলিভারি খাবার আমরা দিই। একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের জন্য আমরা খাবার দিতে পারি।

আমাদের বড় ক্লায়েন্ট কারা
আমার বাবার ব্যবসাটাই প্রধান। এখান থেকে আমিও আলাদা করে একটু সুবিধা পাই। আমাদের বড় ক্লায়েন্টের মধ্যে আছে, সিটি গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ। তাদের সব বড় অনুষ্ঠানের খাবার আমরা সরবরাহ করি। নিয়মিতভাবে তাদের ডেকোরেটর, ক্যাটারিং সবই আমরা করে দিচ্ছি। আর শুধু তাদের অফিসিয়ালই নয়। উনাদের পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজকও আমরাই।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট, সেনাকুঞ্জ, সেনামালঞ্চ, অফিসার্স ক্লাব এসব জায়গায় আমাদের খাবার যাচ্ছে। এগুলোতে আমরা এনলিস্টেড। আরও আছে, বসুন্ধরা কনভেনশনের চারটিতেই আমাদের নিয়মিত খাবার সরবরাহ আছে। দেখা গেল এর দুটিতে একসঙ্গে অনুষ্ঠান চলছে, একটাতে ৮ হাজার মানুষের আরেকটিতে ২ হাজার মানুষের একদিনে একসঙ্গে আমাদের খাবার দিতে হচ্ছে।

আবার প্রতিবছর ভান্ডারি শরীফের ওরসে একসঙ্গে ৪০ হাজার মানুষের খাবার নিয়মিতভাবে আমরাই দিচ্ছি। পাকিজা গ্রুপের ৮ হাজার মানুষের দুই বেলা খাবার আমরা মাত্রই দুইদিন আগে দিলাম। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে একসঙ্গে- একসিটিংয়ে ১০ হাজার মানুষের খাবার এবং ডেকোরেশন আইটেম আমরা দিয়েছি।

আমাদের খাবারের দাম প্রসঙ্গে
অন্যদের সঙ্গে আমাদের খাবারের দামের পার্থক্য কেমন একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাই। ধরুন, কাচ্চি বিরিয়ানি। আমাদের কাচ্চির দাম পড়বে কমপক্ষে ৫০০-৫৫০। অন্যরা আমি শুনেছি ৪৫০ টাকাতেই দিচ্ছে। এটা আসলে কিভাবে সম্ভব? আমরা কিন্তু খুব বেশি লাভ করছি না। মান ঠিক রেখে মিনিমাম লাভেই আমরা কষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।

বাজেটে প্রত্যাশা
বাজেটে গ্রহণযোগ্য হারে ভ্যাট আরোপ হোক এটুকুই চাই। এটা হতে পারে শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ।

স্বপ্নের রঙ নিয়ে আমার স্বপ্ন
একজন বড় ক্যাটারার হিসেবে আমার বাবাকে যেমন সবাই জানেন এবং চেনেন তেমনি সব বড় বড় জায়গায় আমার নামও পরিচিত হোক। দেশের প্রথম নারী ক্যাটারার ব্যবসায়ী হিসেবে বিখ্যাত সব অনুষ্ঠানে ভালো ও মানসম্মত খাবারসহ যাবতীয় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে আমার নাম পরিচিতি পাবে এমন স্বপ্নই আমি দেখি।

নতুনদের জন্য পরামর্শ
নতুনদের জন্য পরামর্শ নয় একটা শর্তের কথা বলতে চাই। প্রথমত ট্রেড লাইসেন্স,এর পর ইনকাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট এবং ব্যাংক একাউন্ট। এই তিনটি জিনিস ব্যবসার শুরুতেই লাগবে। মাস্ট। আর আমার কথা বাদ দিলে আমার বাবা যেহেতু এই ব্যবসায় ছিলেন আমি ওখান থেকে শিখেছি, সুবিধা পেয়েছি। অন্য নতুনরা শুরু করতে চাইলে আস্তে আস্তে একটি করে শুরু করবেন। ইভেন্ট চাইলে ইভেন্ট আর ক্যাটারিং হলে ক্যাটারিং। ক্যাটারিংয়ের বেলায় শুরুতেই মানে আপোষ করেন না এমন একজন শেফের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভালো শেফ কোথায় পাওয়া যবে? এখন তো অনেক শিক্ষিত শেফ তৈরি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। পর্যটন কর্পোরেশন, টমি মিয়াস কিচেন, মাস্টার শেফ লিমিটেড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান আছে। দেশের বাইরে থেকেও আসছে। তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরেও গুরু- শিষ্য ব্যবস্থা থেকেও শেফ পাওয়া যেতে পারে। একজন অভিজ্ঞ শেফের সহকারী হয়ে কাজ শেখা যায়। বাস্তব অভিজ্ঞতা এই ব্যবসার প্রধান শক্তি।

নারীরা এ খাতে ব্যবসায়ীক চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসুক
ক্যাটারিং ব্যবসা মূলত পুরুষ সমাজ নিয়ন্ত্রিত। তবে দেখুন, সংসারের সব রান্না এবং খাবার আয়োজন কিন্তু নারীরাই করে থাকেন। তাহলে খাবারের ব্যবসাটা তারা করতে পারবেন না কেন? এখানে নিজের হাতে রান্না না করুন আয়োজন তো গুছিয়ে করতে পারবেন। আমি চাইবো আমি নিজে যেমন বিবিএ- এমবিএ পড়াশুনা শেষ করে এই ব্যবসায় এসেছি তেমনি অন্য শিক্ষিত নির্বিশেষে নারীরা এসে এই ব্যবসার নেতৃত্ব নিক। আমরা দেখিয়ে দিয়ে বলি, দেখুন এই দেশের নারীরা সব-ই পারে।

শেষ কথা
শাহী খাবার কিন্তু পুরোনো ঢাকার খাবার নয়। এটা সারা দেশের খাবার। এখন চাইনিজ খাবারটা শাহী খাবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেন এটা হবে? শাহীর সঙ্গে চাইনিজ সবজি কেন? কেন শাহী খাবারের সঙ্গে শাহী সবজি নয়? শাহী টুকরো বলে আলাদা ডেজার্টই তো আছে। আমি আসলে আমাদের একেবারে নিজস্ব শাহী খাবারটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করাতে চাই। চীনা খাবার, জাপানি খাবার পারলে আমাদেরটা নয় কেন?

সামীমা খাতুন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
স্বপ্নের রঙ ইভেন্ট অ্যান্ড
ওয়েডিং প্ল্যানার ও ক্যাটারিং সার্ভিস