সংস্কারের অভাবে অচল শতবছরের পুরানো দুই জাহাজ ‘বনরানী’ ও ‘বনকন্যা’

সংস্কারের অভাবে অচল পড়ে রয়েছে খুলনার শতবছরের পুরানো দুই জাহাজ ‘বনরানী’ ও ‘বনকন্যা’।

১১২ বছরের বনরানী এবং ১১৮ বছরের বনকন্যাকে সচল করতে শিপইয়ার্ডের কাছ থেকে ব্যয় প্রাক্কলন করে সংস্কারের প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হলেও, এর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে মূল কাঠামো ধরে জাহাজ দু’টি সংস্কার বা পুননির্মাণ করা গেলে নতুন প্রজন্ম একটি ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, বনরানীর চেয়েও করুণ অবস্থায় রয়েছে জাহাজ বনকন্যা। কলকাতার খিদিরপুর ডকইয়ার্ডে ১৯০২ সালে তৈরি হয়েছিল ‘বনকন্যা’ এবং ১৯০৮ সালে ‘বনরানী’।

বনরানীর ইঞ্জিন দু’টি সচল থাকলেও বনকন্যার সবকিছুই অচল। ২০১১ সাল থেকেই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে বনকন্যা।

বনরানী নামের জলযানটিতে ভ্রমণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, বৃটেনের প্রিন্স, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ অসংখ্য গুণীজন। কিন্তু ওই সময়কার সবচেয়ে বিলাসবহুল জলযানটিই এখন অবহেলায় পড়ে আছে খুলনা মহানগরীর ফরেস্টঘাটে।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, জলযান দু’টি সচল করতে খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে ব্যয় প্রাক্কলন চেয়েছিল বনবিভাগ। দু’টি জাহাজ সংস্কারের জন্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা করে ৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানায় শিপইয়ার্ড। ২০১৮ সালে এই প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হলেও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবহেলাতেই পড়ে আছে বহু ইতিহাসের এ দুই সাক্ষী।

ফরেস্টঘাটে থাকা বনরানীতে গিয়ে দেখা যায়, লোহার তৈরি পাটাতন মরচে ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ছাদের সিলিং খুলে পড়ছে। তবে শতবছর পর এখনও অক্ষত রয়েছে সেগুন কাঠের তৈরি জানালা, ফার্নিচার।

এর কেবিনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিছানা, তোষক ও লেপ ইঁদুরে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে। তবে পিতলের তৈরি লাইট, সুইচসহ বিভিন্ন ফিটিং এখনও আগের মতোই রয়েছে। বৃটিশ আমলে ব্যবহার করা তৈজসপত্রে লেগে আছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া।

বনরানীর লকবই ও পুরাতন কিছু কাগজ ঘেটে দেখা যায়, ১৯০৮ সালে তৈরির সময় এর নাম ছিল ‘হেরিয়ার’। এটি নির্মাণে সেসময় ব্যয় হয়েছিল ৫২ হাজার ৯৪৭ টাকা। স্টিম ইঞ্জিনচালিত জাহাজটির ক্ষমতা ছিল ৩৫৪ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট। ১৯৬২ সালে স্টিম ইঞ্জিনের পরিবর্তে দু’টি ডয়েটস ডিজেল ইঞ্জিন এবং ২০০৪ সালে পাল্টে দু’টি দাইও ইঞ্জিন স্থাপন করা হয়। এর প্রতিটি ইঞ্জিন ২০০ অশ্বশক্তি সম্পন্ন। স্বাধীনতার পর হেরিয়ারের পরিবর্তে লঞ্চটির নাম দেয়া হয় ‘এম এল বনরানী’।

বনরানীর লস্কর মো. হারুন মোল্লা ও মাস্টার আবু জাফর জানান, ২০১৬ সালে শেষ চালানো হয়েছিল। এরপর খারাপ হতে থাকলে আর মেরামত করা হয়নি। বর্তমানে ইঞ্জিন ছাড়া এর সবকিছুই অচল। তাই সম্পূর্ণ অবকাঠামো পরিবর্তনের বিকল্প নেই। এই লঞ্চে এমন অনেক কিছু আছে যা দেশের অন্য কোনো লঞ্চে নেই।

বনকন্যার মাস্টার সদর উদ্দিন জানান, ২০১১ সাল থেকে এটি ঘাটে পড়ে আছে। পরের কিছুদিন ইঞ্জিন ভালো ছিল। তবে এখন সবকিছুই নষ্ট।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশির আল মামুন বলেন, ‘শিপইয়ার্ডের কাছ থেকে ব্যয় প্রাক্কলন করে সংস্কারের প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। এরপর আর অগ্রগতি হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ১০০ বছরের পুরানো যেকোনো স্থাপনারই প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য আছে। বনরানীর বয়স ১১২ বছর, বনকন্যার ১১৮ বছর। মূল কাঠামো ধরে জাহাজ দু’টি সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা গেলে নতুন প্রজন্ম একটি ইতিহাসের সাক্ষী হবে।