সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ায় বীমা

স্বাধিনতার পর থেকেই বাংলাদেশের ইন্স্যুরেন্স খাত একটা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে চলছে। কখনোই এটা স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারেনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্সু পলিসিকে জাতীয়করণ করেন। তখন জাতীয় বীমা কর্পোরেশনের অধিনে চারটি বীমা কোম্পানি সেট করা হয়। দুটো লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য এবং দুটো সাধারণ ইন্স্যুরেন্সের জন্য। পরবর্তীতে ১ বছর পরে ১৯৭৩ সালে জাতীয় বীমা কর্পোরেশনকে ভেঙে দুটো বীমা কর্পোরেশন করা হয়। একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, আরেকটা নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স। পরে ১৯৮৬ সালে এসে সরকার প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে দেশে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১৬টি নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। একসময় লাইফ ও নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় যে কমিশন প্রথা ছিলো তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলে, পরবর্তীতে তা আবার চালু করা হয়েছে।

সরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একসময় শতভাগ সাধারণ বীমা পলিসি করতো। ১৯৯০ সালে আইন করা হলো যে, ৫০ ভাগ সাধারণ বীমা করবে আর ৫০ ভাগ প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি করবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যখন রি ইন্স্যুরেন্স করার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন বলা হয় যে সাধারণ বীমার সঙ্গে শতভাগ রি ইন্স্যুরেন্স করতে হবে। আবার ১৯৯০ সালের আইনে বলা হলো যে, ৫০ ভাগ স্বাধারণ বীমার সঙ্গে করতে হবে আর ৫০ ভাগ চাইলে সাধারণ বীমার বাহিরেও করা যাবে।

আমার মনে হয়, ইন্স্যুরেন্স খাত নিয়ে যত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে, অন্য কোন খাত নিয়ে এত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়নি। ফলে কখনোই কোন বিশেষ অবস্থার আলোকে চলতে না পারায় এই খাতটায় খুব একটা সাফল্য পায়নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন কানুন প্রয়োগ আর সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় এই সেক্টরটা খুব একটা এগোতে পারেনি। যদিও সরকারের উদ্দ্যোগ সব সময়ই ছিলো, কিন্তু অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় খুবই সামান্য। আমাদের দেশের জিডিপির মাত্র ০.৭ শতাংশ অবদান হচ্ছে ইন্স্যুরেন্স খাতের। এটা কম করে হলেও চার পাচ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল।

এখন বাংলাদেশের নন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কমিশন প্রথা আছে বলে আমি মনে করি না। আইন অনুযায়ী, যদি কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানি এজেন্টের মাধ্যমে ব্যবসা করে, তাহলে সেই এজেন্সিকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেওয়া যাবে। কিন্তু আমার জানা মতে, বাংলাদেশের নন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোন এজেন্ট নাই, যা আছে সেটা পেপার চিজ। বাস্তবে দেশে এজেন্টের মাধ্যমে কোন ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা করে বলে আমি জানিনা। আমাদের দেশে মূলত ব্যবসা প্রকিউর করে ডেভলপমেন্ট অফিসাররা। সুতরাং যেখানে এজেন্টই নাই, সেখানে এজেন্সি কমিশনের ব্যপারটা বড় করে দেখার কিছু নেই।

তবে কমিশন প্রথা নিয়ে আমাদের যে ধারণাটা রয়েছে সেটা হলো মূলত ফিডব্যাক মানি, কিকব্যাক মানি। অর্থাৎ ইস্যুয়ারের কাছ থেকে যে প্রিমিয়াম নেওয়া হয়ে থাকে তার একটা অংশ তাকে ফেরত দেওয়া হয়, যেটা একাউন্টে কোথাও উল্লেখ করা হয় না। এটাকেই মার্কেটে বড় করে কমিশন প্রথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা তা না। বিষয়টা হচ্ছে, ইস্যুয়ারের কাছ থেকে শতভাগ প্রিমিয়াম নিয়ে তাকে একটা অংশ ফেরত দেওয়া হচ্ছে, যেটা সরকারি আইন অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এটাকে কমিশন বলা যাবে না। কারণ, কমিশন দিতে হবে এজেন্সিকে, ইস্যুয়ারকে দেওয়া যাবে না।

বাজেটের সাথে ইন্স্যুরেন্সের একটা সম্পর্ক আছে। কারণ ইন্সুরেন্সও ব্যাংকের মত একটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ব্যাংকগুলো সরাসরি অর্থ লগ্নির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে। আর আমরা ইন্সুরেন্স কোম্পানিরা নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখার কাজ করি। সুতরাং বাজেটের সাথে আমাদের একটা সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে। যদি দেশের উন্নয়ন কর্মকা- বাড়ে, তাহলে আমরা যারা নন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে জড়িত আছি তাদের সরাসরি ব্যাবসা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, দেশে যদি আমদানি-রপ্তানি বাড়ে, মিল-ফ্যাক্টরি বাড়ে, শিল্প কারখান হয়, বিমান কিংবা জাহাজ ক্রয়-বিক্রয় হয় অথবা পদ্মাসেতু কিংবা কর্ণফুলী টার্নেলের মত কার্মকা- বাড়ে, তাহলে ইন্স্যুরেন্সের কর্মপরিধি বৃদ্ধি পাবে এবং আয় বাড়বে।

উন্নত দেশগুলোতে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো ব্যাংকের খুব কাছাকাছি কাজ করে থাকে। কোন কোন দেশে ইন্স্যুরেন্সের গুরুত্ব ব্যাংকের চেয়েও বেশী। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের (ননলাইফ ইন্সুরেন্স) ক্ষেত্রে কতগুলো সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের টার্গেট গ্রুপ নির্ধারিত করা থাকে। আমরা কেবলমাত্র প্রপার্টি, লাইবিলিটিস, পারসন্সের ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স করি। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো আইনের বাধ্যবাধকতা, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে যেখানে ইন্স্যুরেন্স না করলেই নয়, সেটুকুই শুধুমাত্র ইন্স্যুরেন্স করানো হয়। এখানে সতস্ফুর্তভাবে কেউ ইন্স্যুরেন্স করে না।

আমাদের রাজধানী ঢাকায় যে হাজার হাজার মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং রয়েছে তার অধিকাংশতেই ইন্সুরেন্স করা নাই। আজকে যদি এখানে একটা মেসিভ ভুমিকম্প হয় এবং ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয় তাহলে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর সম্পদের ক্ষতিপূরণ সরকার ব্যতিত অন্য কোথাও থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই ধরণের সম্পদের মালিকরা কিন্তু সবাই ইন্সুরেন্স করে রাখে। এই পরিধিটা বাড়ানোর জন্য সরকার অনেক চিন্তা ভাবনা রয়েছে। এই ধরণের মাল্টিস্টোরেড অবকাঠামো কিভাবে ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা যায় সে চেষ্টাই সরকার করছে। পর্যায়ক্রমে যদি এগুলোকে ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা যায় তাহলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হবে।

কোন সম্পদের যদি একটা লস হয়ে যায় তবে এটা জাতির জন্যও ক্ষতি। এই ক্ষতিকে ঠেকানোর কোনো পথ নাই। কিন্তু ওই সম্পদের যিনি মালিক রয়েছেন, তিনি যদি ইন্স্যুরেন্স করে থাকেন, তাহলে আমরা ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে তাকে আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় পুনর্বাসিত করতে পারি। আবার আজকে যদি আপনার চিকিৎসা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত থাকতো তাহলে চিকিৎসার জন্য অপনাকে লক্ষ লক্ষ টাকা জমানোর চিন্তা করতে হতো না। তখন আপনি চিন্তা করতেন যে, কোনো সমস্যা হলে এটা ইন্স্যুরেন্স দেখবে বা আমি এটা ফ্রি পাব। যেমন- আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ জন লোকের হেলথ ইন্স্যুরেন্স আছে। তারা কিন্তু চিকিৎসা নিয়ে এতটা মাথা ঘামায় না।

ইন্স্যুরেন্সের আওতায় যদি মানুষকে যথাযথভাবে নিয়ে আসা যায় তাহলে সোশ্যাল ক্রাইমও কমে যাবে। মানুষ কিন্তু তখন অনৈতিক কাজ করতে চাইবে না। আমাদের দেশে সর্বস্তরের যে দুর্নীতি বিরাজমান তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সোশ্যাল সিকিউরিটির অভাব। আমাদের কারও কোনো সোশ্যাল সিকিউরিটি নাই। সুতরাং ইন্স্যুরেন্স শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয় সোশ্যাল সিকিউরিটির ক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রাখতে পারে।

ইন্স্যুরেন্স নিয়ে আমাদের দেশের মানুষকে যতটা সচেতন করা দরকার ছিল, তা আমরা এখনও করতে পারিনি। এখানে আমাদের একটা ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো মানুষের সিকিউরিটির জন্য যে কাজগেুলো করছি তা মানুষ এখনও জানে না। কারণ, ইন্সুরেন্স সেক্টরে যে ধরনের যোগ্য, সৎ ও দায়িত্বশীল লোকজন দরকার ছিল, তা আমাদের পর্যাপ্ত নাই। এখানে ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীরা আসতে আগ্রহ দেখায় না। এটা এখনও লো-প্রফাইল প্রফেশন হিসাবে চলছে। তবে ক্রমান্বয়ে এটা পজেটিভ দিকেই যাচ্ছে, হতাশ হবার কিছু নাই। আমি মনে করি, এই অবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারবো, তবে কিছু সময় লাগবে।

কাজী সিরাজুল ইসলাম
কনসালটেন্ট, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড