হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিকিৎসা নিতে ভয়ের কারণ কী?

হাসপাতালকে এমন এক জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেখানে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে আরামদায়ক পরিবেশে, যেমনটি বিশ্বের ধনী বা দরিদ্র অনেক দেশেই করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশের জন্য রোগীরা হাসপাতালে প্রবেশের সময় আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলোর ত্রুটিপূর্ণ নকশা, অব্যবস্থাপনা, জনবল ও জায়গার ঘাটতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, কর্মীদের উদাসীনতা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শিথিল নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ দেশের প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর ও রোগী-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।

দেশে অনেক বিশ্বমানের এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলোর দুর্বল অবস্থা এবং পরিষেবার পাশাপাশি স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অবিশ্বাসের কারণে অনেক ধনী ও মধ্যবিত্ত মানুষ প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

যোগাযোগ করা হলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সেনাল বলেন, হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ মূলত এর স্থাপত্য নকশা, পরিচালনা ও পরিষেবা সরবরাহের ওপর নির্ভর করে।

তিনি বলেন, ‘কারিগরি এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের হাসপাতালের ভবনগুলোর নকশার দিকে কোনো মনোযোগ দেয়া হয় না। আমাদের দেশে হাসপাতালের ভবন নকশা করার জন্য স্থপতি নেই। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে, আমাদের হাসপাতালের ভবনগুলো অন্যান্য সাধারণ অফিস, বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানের মতো করে নকশা করা হয়। এ জন্যই রোগীরা হাসপাতালে খুব অস্বস্তি বোধ করেন।’

ডা. ইকবাল বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) একটি নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে যা দেখতে অনেকটা গুদাম ঘরের মতো।’

‘এমন একটি হাসপাতাল ভবন তৈরি করে কী লাভ যেখানে রোগীরা স্বস্তি বোধ করেন না?,’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

হাসপাতালের সঠিক নকশা এবং পরিবেশ রোগীদের সুস্থতার গতি বাড়িয়ে দিতে পারে উল্লেখ করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা হাসপাতালগুলোর নকশা করেন তারা চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে রোগী-বান্ধব পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করেন না। পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে একটি হাসপাতালের স্যানিটেশন, ভেন্টিলেশন এবং কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা থাকা দরকার, আমাদের হাসপাতালগুলোতে যার অভাব রয়েছে।’

বিশিষ্ট এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আপনি বিএসএমএমইউতে গেলে এক ব্লকে নেফ্রোলজি এবং ইউরোলজি বিভাগ খুঁজে পাবেন অন্য ব্লকে। প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় অন্যান্য পরিষেবাও সুবিন্যস্ত করা হয় না, ফলে রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

তিনি বলেন, অব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত জনবলের অভাবও স্বাস্থ্য পরিষেবার মান উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

‘এটি সত্য যে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের নেই। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার কারণে আমরা হাসপাতালের কর্মীদের কাছ থেকেও কাঙ্ক্ষিত এবং দায়িত্বশীল পরিষেবাগুলো পাই না। ঘুষ দিয়ে চাকরি করছেন এমন অযোগ্য কোনো কর্মীর কাছ থেকে আপনি কীভাবে উপযুক্ত পরিষেবা প্রত্যাশা করবেন? যে ব্যক্তি নিজের ঘর বা বাথরুম পরিষ্কার করেন না, তিনি কীভাবে হাসপাতাল বা সেখানকার বাথরুমগুলো পরিষ্কার রাখবেন?’ বলেন ডা. ইকবাল।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির জন্য সরকার অনেক অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে, কিন্তু বিভিন্ন সিন্ডিকেট এবং অসাধু ব্যক্তিরা লুণ্ঠনে লিপ্ত। তারা ৩৫ লাখেরও বেশি টাকা দিয়ে একটি পর্দা ক্রয় করেন। দুর্নীতি ও লুণ্ঠন বন্ধ হওয়া উচিত। সব অব্যবস্থাপনা দূর করা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘কিছু বেসরকারি হাসপাতালে মানসম্মত সেবা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেয়া হয়। এ হাসপাতালগুলো স্থপতিদের দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে নকশা করা এবং দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে পরিচালিত হয়।’

তবে বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ভালো নকশা, পর্যাপ্ত জায়গা এবং উপযুক্ত স্থান ছাড়াই যেমনভাবে ইচ্ছা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক আবাসিক ভবন ক্লিনিকে পরিণত হয়েছে। আমাদের একটি কার্যকর নীতি থাকতে হবে এবং হাসপাতাল স্থাপনের জন্য মান নির্ধারণ করা দরকার। অনেক হাসপাতাল এমনকি মেডিকেল কলেজগুলোরও কার্যকর কোনো পরিষেবা বিধি নেই।’

ডা. ইকবাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আধুনিকায়ন করতে বলেছেন। কর্তৃপক্ষের উচিত একজন দক্ষ স্থপতি দিয়ে এটির নতুন নকশা করা।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, রোগী-বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতালের নকশা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ভবন থেকে হাসপাতালের নকশা ভিন্ন। শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ, পর্যাপ্ত জায়গা এবং একটি ভালো নকশা হাসপাতালের জন্য আবশ্যক।’

অধ্যাপক মুজাহের বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ নকশা ছাড়াও বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে সবসময় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রোগী ভর্তি করা হয়। এ জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং সঠিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে পারেন না। এমনকি অনেক রোগীকে মেঝে এবং করিডোরে থেকেই চিকিৎসা সেবা নিতে হয়।’

তিনি বলেন, সরকারি এবং বেসরকারি উভয় হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান জানান, সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ ও সেবার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে আমরা বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের দিয়ে আধুনিক নকশা অনুসরণ করে সরকারি হাসপাতালের কাঠামো তৈরির বিষয়ে ভাবছি। এটি সময়ের চাহিদা। এখন আমরা অবশ্যই হাসপাতালের ভবনগুলো রোগী-বান্ধব করতে সুপরিকল্পিত নকশার দিকে মনোনিবেশ করব।’

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে আধুনিকায়নের প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ‘সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মাফিক হলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপমহাদেশের সেরা এবং বাস্তবধর্মী কাঠামো থাকবে। সেখানে আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পেশাদার স্বাস্থ্য স্থপতিরা এ হাসপাতালের নকশা করবেন।’