আজমেরী হক বাঁধন : আমি সব সময় কাজ নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকি তা কিন্তু নয়। যতটুকু কাজ করি কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকে-ই করি।
কাজটা আমার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। কাজের আগে আমি আমার, তারপর আমার মেয়ে, আমার পরিবার এরপর আমার কাজ।
কাজের আগে আমার সন্তান সায়রা আমার কাছে প্রধান। আগে ও আমার সাথে শুটিং সেটে যেত। ওর দুই বছর বয়স পর্যন্ত সাথে নিয়ে শুটিং করতাম। সায়রাকে বাসায় রেখে কাজে যেতাম না। আড়াই বছর হওয়া পর্যন্ত ও আমার বুকের দুধ খেয়েছে। যে বাচ্চারা বুকের দুধ পান করে তারা মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। মা হিসেবে যে দায়িত্ব তা ঠিকঠাক মতো পালনের চেষ্টা করেছি। যখন যেভাবে পেরেছি, আমি আমার সন্তানের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তার জন্য কেউ কেউ আমাকে বিশাল সাপোর্ট দিয়েছেন।
আমি আমার বাবার বাড়ি থাকি। যদিও সন্তানকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকি। এখন আমার সন্তান স্কুলে যায়। সকালে মা-মেয়ে এক সাথে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করি। স্কুলে যাওয়ার জন্য ওকে তৈরী করে দিই। আমার যেদিন বাইরে কাজ থাকে সেদিন আমার মা ওকে স্কুলে নিয়ে যায়। এছাড়া অন্যদিন আমিই আমার সন্তানকে স্কুলে দিয়ে আসি।
দিনে দিনে ওর চাহিদা বদলে যাচ্ছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। আর আমিও ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি। একটি সন্তান জন্মের সাথে সাথে একজন মায়েরও তো জন্ম হয়, সময় অনুযায়ী ওকে বুঝে চলার চেষ্টা করি। ওর যা পছন্দ তা আমার সাধ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, আমি আসলে মা হতেই চেয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য একজন মেয়ের কিন্তু একটা প্রস্তুতির দরকার হয়। আর সেটা আমার ছিল।
ভয়ংকর কষ্টের সময় ও আমার একমাত্র অবলম্বন। ও আমার জন্য আল্লাহ তা’লার প্রদত্ত এমন এক উপহার যার মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ব্যথা, বেদনা, না পাওয়া, ক্লান্তি সব ভুলে যাই। ওর একটু হাসিতে আমার পুরো পৃথিবীটা আনন্দে ভরে যায়।
আমার পুরো জীবনটা আসলে ও কেন্দ্রীক। এটা আস্তে আস্তে হয়তো পরিবর্তন হবে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হবে। এক সময় ওর অনেক বন্ধু হবে, নিজস্ব একটা গণ্ডি তৈরী হবে। এখন পর্যন্ত ওর আর আমার একটা আলাদা পৃথিবী আছে।
আর একটু বড় হলে ওর ভিন্ন মত তৈরী হবে, চাহিদা তৈরী হবে সেটা আলাদা ঘটনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব থেকে নির্ভরতার জায়গাটা আমি আমার সন্তানের কাছে খুঁজে পাই। অনেস্টলি বলি, যেটা এখন আমি আমার বাবা মায়ের কাছেও খুঁজে পাই না। এর পেছনের কারণ হতে পারে, আমি আমার মাতৃত্বকে উপভোগ করি। যা অনেক মায়ের কাছে বোঝাও মনে হতে পারে! আমি আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক স্ট্রাগল করেছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি আমার ছোট বাচ্চাকে সাথে রেখে শুটিং করেছি। সঙ্গে থাকত আমার গৃহপরিচারিকা আর আমার একজন ফুফাতো বোন (মায়ের বয়সি)। উনি সব সময় আমার মেয়ের সাথে সাথে থাকতেন।
আমি খুবই সৌভাগ্যবান কারণ আমার বাবা-মা যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িতে থাকতে পারছি। এই সুযোগটা থাকার ফলে আমার মেয়েকে কখনো শুধু গৃহপরিচারিকার হাতে ছেড়ে আসি না।
আমি যতক্ষণ থাকি না, ততক্ষণ গৃহপরিচারিকা আমার মেয়েকে নিয়ে আমার মায়ের সাথে থাকে।
যখন আমার মেয়ের বয়স আট মাস তখন আমি আবার কাজ শুরু করি। এর আগে চিন্তাও করতে পারিনি এত তাড়াতড়ি কাজে ফিরতে পারব। এজন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়, নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে। তিনিই আমাকে ডেকে বলেছিলেন, তার নাটকে কাজ করতে। উনি বলেছিলেন, ‘বাচ্চা নিয়েই শুটিংয়ে আসবা কোনো সমস্যা হবে না, আমি তোমাকে আলাদা রুমের ব্যবস্থা করে দেব।’
সিঙ্গেল ওই নাটকের শুটিং দুইদিন হয়েছিল। সত্যিই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে শুটিং করলাম, ভীষণরকম সহযোগিতা পেলাম। এর মাধ্যমে আমি আসলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই, সাহস বেড়ে যায়।
এরপর নাট্য নির্মাতা জুয়েল মাহমুদ, একটা ধারাবাহিকে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। যে নাটকের গল্পের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ছিলাম আমি। চিন্তা করতে পারছিলাম না, ওই নাটকে কাজ কিভাবে করব। আমি যা যা শর্ত দিলাম তাতেই মাহমুদ ভাইয়া রাজী হয়ে গেলেন। ওই সময় কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে সমস্যা হত। দেখা যেত, আমি শর্ট দিচ্ছি আমার মেয়ে কেঁদে উঠছে। আমি নিজেই তখন ‘কাট’ বলে শুটিং থেকে বের হয়ে চলে এসেছি। পরে নিজের কাছে অপরাধবোধ হতো যে, আল্লাহ আমি শটের মাঝখানে এই কাণ্ড করলাম!
ওই সময় আমার সহ শিল্পী যারা ছিলেন, তারা দেখেছেন। সিরিয়ালটা করতে এক বছরের বেশি সময় লেগেছিল, একদিনও আমি আমার মেয়েকে বাসায় রেখে যাইনি। মাহমুদ ভাইয়া বলেছেন, ‘বাঁধন অনেকে বলে সন্তানকে নিয়ে শুটিংয়ে আসবে, পরে আর আনে না। কিন্তু তুমি পেরেছো।’ ওই সময় আমার সহ শিল্পী ছিলেন, আমজাদ হোসেন, চিত্রলেখা গুহ, দিলারা জামান। উনারা বিষয়টা অনেক বুঝতেন।
আরেকজন আছেন মাঈনুল হাসান খোকন। উনার কথা না বললেই নয়। মাঈনুল ভাইয়ার একটা সিরিয়ালেও কাজ করেছিলাম। সেখানেও একই অবস্থা ঘটত। তারপর আস্তে আস্তে ব্যস্ততা বেড়েছে। সেই সাথে সাথে কাজও বেড়েছে।
আমার দায়িত্ব সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করা। সেটা করতে চাই। এখন আমার মেয়ে বড় হচ্ছে। এখন ও অনেক কিছু বোঝে, অনেক কিছু বলতে পারে। ওর চার বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ওকে রেখে এক রাতও আমি কোথাও থাকি নাই। চার বছর পর নিজের জন্য এবং ওর জন্য একটু একটু ছাড় দিতে শুরু করেছি। যাতে একটা পর্যায় গিয়ে মানতে কষ্ট না হয়। ওরও ফ্রেন্ড হবে, ওর একটা আলাদা জগত হবে আমারও তো তখন এটা মানতে হবে।
এই জন্য এখন একটু আউটডোরে যাই। তখন ওকে খুব মিস করি, মেয়েও আমাকে মিস করে। কারণ আমি আর ও একসাথে ঘুমাই। দেখা যায় যে, ঘুমের সময় মেয়েও আমাকে খোঁজে আমিও মেয়েকে খুঁজি। আমার মেয়ে কখনো বালিশে ঘুমায় না, ও সবসময় আমার একহাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমায়। আমি আমার মেয়েকে যদি বলি, ‘মা, আমি তো আর পারছি না, তোমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়।’ সে বলে যে, ‘মা, টেনশন করো না, আস্তে আস্তে প্র্যাকটিস হয়ে যাবে।’ সায়রার বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছর। সে আবার খুব ম্যাচিউর!
আমি বলি যে, ‘কীভাবে ঠিক হবে?’|
আবার বুঝি, এই সময়ও পার হয়ে যাবে।
সূত্র: এইবেলা
আজকের বাজার: আরআর/ ১৪ মে ২০১৭