রনি রেজা: জুন মাসের একেবারে প্রথম দিনই ঘোষিত হলো ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বিশাল বাজেট। চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বিশাল আকারের এ বাজেটটি দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ। প্রতি বছরই বাজেটের আকার ফুলে-ফেঁপে বড় হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী অর্থবছর এর ফিগার আরো বাড়বে। এটা অবশ্যই একটি জাতির জন্য সুখকর খবর। একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। আর অর্থনৈতিক অবস্থা অনুমান করা যায় সে দেশের বাজেটের দিকে তাকালে। এ বিবেচনায় বলাই যায়, আমাদের দেশ ক্রম উন্নতির দিকে এগোচ্ছে। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ নাম দিয়ে এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ দুঃখের সংবাদ হচ্ছে, এই দেশেরই মহাসড়কে কোনো নিরাপত্তা নেই। সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা, হার ও মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। এ মিছিলে নাম লিখিয়েছেন সব শ্রেণি-পেশা, বয়স ও লিঙ্গের মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, পথশিশু থেকে সচিব, চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম জগতের দিকপাল মানুষেরা। এদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান, চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির, মাটির ময়না খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব মিশুক মুনীর, সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক ইউসুফ আহমেদ খান, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সহধর্মিনী জাহানারা কাঞ্চন, সাবেক সচিব রাজিয়া বেগম, সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী, দীনেশ দাস, বেলাল হোসেন, ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব ও ভাষ্যকার আতাউল হক মল্লিক, জাতীয় দলের ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানাসহ অসংখ্য সম্ভাবনাময় প্রাণ ঝড়ে পড়েছে মহাসড়কে।
নিরাপদ সড়ক চাই-নিশচা’র তথ্যমতে, ২০১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৪৪ জন নিহত ও ৫২৫৫ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৫৬৬টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ১৩৪ জন। ২০০৯ সালের হিসাবে ৩ হাজার ৩৮১টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৫৮ জন নিহত ও ২ হাজার ৬৮৬ জন আহত হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর হিসাব অনুযায়ী ১৭ বছরে দুর্ঘটনা প্রায় ৭০ হাজার ৬’শ, নিহত ৫০ হাজার ৬ শতাধিক মানুষ। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছরে গড়ে ঘটেছে ৪ হাজার ১শ ৫২টি দুর্ঘটনা। প্রতিটি দুর্ঘটনায় গড়ে ২ লাখ টাকা ক্ষতি হলে প্রতি বছরে তি হয় ৮৪ কোটি টাকা। ১৭ বছরে তি হয়েছে ১৪২৮ কোটি টাকা। এখানে সংখ্যার পার্থক্য থাকলেও একথা স্পষ্ট যে, প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণ ঝড়ছে। যারা আহত হচ্ছেন তাদেরও একটি বিশাল অংশ পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে আছেন। একেকটি মানুষের মৃত্যুতে মৃত্যু ঘটছে একেকটি পরিবারের, একেকটি সমাজের আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেকটি জাতির। আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যে প্রধান হুমকি এখন সড়কে দুর্ঘটনা। মহাসড়কের এ মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বাস-ট্রাক চালকদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো। এর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চালকের দতার অভাব, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, জনসাধারণের ও চালকের ট্রাফিক আইন না মানা, রাস্তাঘাটের পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাব, চালকের গতিসীমা না মানা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, জনসাধারণের যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া এবং ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সময় অসময়ে রাস্তা খুঁড়ে ডেসা, ওয়াসা, টেলিফোন লাইন ইত্যাদি স্থাপন করা, অপর্যাপ্ত, অপরিকল্পিত ও নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে রাস্তা নির্মাণ এবং রাস্তায় ডিভাইডার ও স্পিডব্রেকারের অভাব অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত গতিতে ও বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর পেছনেও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চালকের প্রশিণের অভাব, চালকের স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর মজুরি নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালালে যানবাহনের মালিকও অনেক খুশি। কারণ, যত তাড়াতাড়ি একটি ট্রিপ শেষ করা যায় তত তাড়াতাড়ি আরেকটা ট্রিপ পাওয়া যাবে, তাতে ট্রিপও বাড়বে। ট্রিপ বাড়লে মালিক-চালক সবারই আয় বাড়বে। এ জন্যই চালকরা উৎসাহী হয়ে গাড়ির গতি বাড়ান এবং দুর্ঘটনা ঘটান।
এসব বাস ট্রাক চালকরা একটু সচেতন হলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু-পহাড় তৈরি হচ্ছে তা কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব দুর্ঘটনায় ঘাতক চালকদের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশও কম দায়ী নয়। সরকার গাড়ির গতিবেগ মেপে অতিরিক্ত গতির জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশকে স্পিডগান সরবরাহ করেছে। কিন্তু বিভিন্ন মহলের অভিযোগ হচ্ছে, পুলিশ সেটা ব্যবহার করে না। যদিও মাঝে মধ্যে অনুমানের উপর কিছু বেপরোয়া গতির গাড়ি আটক করে, তার পর চালকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ল্েয মোটরযান চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়ায় কিছুটা শক্ত প্রক্রিয়া আরোপ করা হয়েছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়। বাস, ট্রাক ইত্যাদি ভারী মোটরযানের চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়ায় আরও কঠোর করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিণ ছাড়াই গাড়ি চালানোর বিষয়েও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারিভাবে চালকদের প্রশিণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের বেশ কিছু পদপে গ্রহণ করা উচিত। এর মধ্যে অন্যতম পদপেগুলো হলো- জাতীয় সড়ক নিাপত্তা কমিটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি, মেট্রোপলিটন সড়ক নিরাপত্তা কমিটি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, হাইওয়েতে ইজিবাইক, থ্রি-হুইলার, নছিমন, করিমন, ভটভটি, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত টেম্পো, মাহিন্দ্রা, ব্যাটারি চালিত গাড়ি ইত্যাদি যানবাহন নিষিদ্ধ, গণমাধ্যমে নিরাপত্তামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার, হেলমেট ও সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন ইত্যাদি। পাশাপাশি চালক, যাত্রী সকলকেই সচেতন হতে হবে। নইলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা প্রতিদিন বাড়বে বৈকি কমবে না।
বাংলাদেশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিকার নিয়ে গবেষণা এ যাবৎ অনেক হয়েছে। অনেক তদন্ত প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, অনেক সুপারিশ লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর সারাদেশে এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে, কর্তৃপও নড়েচড়ে বসেন। কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সবকিছু যেই-কে-সেই হয়ে যায়।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে নিমূর্ল করা সম্ভব না হলেও তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখাটা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে যে মহামারী আকারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, এর কারণগুলো বহুলাংশেই চিহ্নিত, কী করতে হবে তা ও সংশ্লিষ্টদের জানা। শুধু দরকার সদিচ্ছা।
গত ১৪ মে রোটারী কাব অফ বারিধারা’র আয়োজনে ‘সেমিনার অন রোড সেফটি’ নামক অনুষ্ঠানে নিরাপদ সড়ক চাই এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ ড্রাইভার অশিতি। যার কারনে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রশিতি ড্রাইভারের অভাব। ড্রাইভারদেরকে প্রশিতি এবং সচেতন করতে হবে। আমরা শুধু একে অপরকে দোষ দেই। আমাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার কারণ যেমন একাধিক, তার সমাধানের জন্যও তাই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম প্রয়োজন।সারাবিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রোপটে, জাতিসংঘের সাধারণ সভা ২০১১-২০২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক (উবপধফব ড়ভ অপঃরড়হ) ঘোষণা করেছে। ২০১১ সালের ১১ মে ১০০টিরও বেশি দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়, যার ল্য ২০২০ সাল নাগাদ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মুত্যু রোধ করা। দশকওয়ারি বৈশ্বিক পরিকল্পনা থেকে জাতীয় কর্মোদ্যোগে এসে অনেক দেশ সড়ক নিরাপত্তা উন্নীত করার ল্েয বিভিন্ন পদপে গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ দশকের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি (যেমন- অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফিলিপাইন), নতুন আইন প্রণয়ন (যেমন- চিলি, চীন, ফ্রান্স, হন্ডুরাস) এবং বিদ্যমান আইনসমূহের বাস্তবায়ন জোরদার (যেমন- ব্রাজিল, কম্বোডিয়া, রাশিয়ান ফেডারেশন)। আশার কথা হচ্ছে, সড়ক নিরাপত্তা দশকের সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটিজিক অ্যাকশন প্লান ২০১১-২০১৩’-র দিকে তাকালে বোঝা যায়, সড়ক নিরাপত্তা আমাদের কম প্রাধান্য নয়। এই পরিকল্পনার ভিশন স্থির করা হয়েছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ ৫০ শতাংশ হ্রাস করা এবং সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা। আর ল্য হচ্ছে, ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হ্রাস করা। আমরা চাই সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় পদপে নিশ্চিত করুক।
আজকের বাজার: আরআর/ ডিএইচ/ ০৬ জুন ২০১৭