ডেমোক্রেসি ও রিপাবলিক: বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে

জাতির জনকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। কেননা তিনিই সেই কুশীলব যিনি এই গাঙেয় অবহেলিত ব-দ্বীপটিতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে লক্ষ প্রাণের বিসর্জনে এ দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাই তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের যুদ্ধ জয়ের পর জাতির পিতা ক্ষমতাগ্রহণ করে ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন যার ইংরেজি নাম “People’s Republic of Bangladesh” অর্থাৎ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এ প্রবন্ধে আমি ডেমোক্রেসি ও রিপাবলিক এই দুটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কেননা এই দুটি শব্দ রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যবহৃত হয়। এবং এটা নিয়ে বাংলাদেশে নানা মতভেদ আছে।

ডেমোক্রেসি শব্দটা এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে একটি হল ‘Demos’ অর্থাৎ People বা লোকজন অপরটি হল ‘Kratos’ অর্থাৎ আইন/রুল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে ২৬০০ বছর পূর্বে সিটি এস্টেট অব এথেন্সে প্রথমবারের মতো সেলেসথেনেস নামক একজন লমেকার এই ডেমোক্রেসি সরকার তৈরি করেছিলেন। উৎপত্তি অনুসারে ডেমোক্রেসি বেশ কয়েকভাগে বিভক্ত: ১. ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি, ২. লিবারেল ডেমোক্রেসি, ৩. ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসি, ৪. অ্যারিসটোক্রেটিক ডেমোক্রেসি, ৫. ইগালিট্যারিয়ান ডেমোক্রেসি ইত্যাদি। ডেমোক্রেসি ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন দেশ, জাতি, সংস্থা, সংগঠন তাদের প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করে থাকে এবং এই সমস্ত ক্ষেত্রে ডেমোক্রেসি প্রয়োগের পদ্ধতিও কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি ইংল্যান্ডের কথা, সেখানে রাজা আছে আবার পার্লামেন্টারি সিস্টেমের প্রধানমন্ত্রীও আছে। অর্থাৎ Monarchism ও পার্লামেন্ট একইসাথে রাষ্ট্রে বিরাজমান আছে। সিসেরো একে Mixed government বলে আখ্যায়িত করেছেন। এভাবে ডেমোক্রেসি পন্থাটা দেশে দেশে একটি Aadjustable ব্যবস্থাপনা হিসাবে প্রয়োগ হচ্ছে। তবে মোটামুটিভাবে ডেমোক্রেসি পাঁচটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে দুটি অত্যন্ত আবশ্যকীয়। কেননা এই দুটি না থাকলে ডেমোক্রেসি প্র্যাকটিস করা যাবে না বা ডেমোক্রেসি টেকসই হবে না।

মূলনীতি:

১. কোন ইউনিট বা সংগঠনে ডেমোক্রেসি প্র্যাকটিস হবে যেমন – সিটি/টাউন? একটি দেশ? একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান? একটি ইউটিভার্সিটি? একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা? অথবা উপরের সবগুলিই।

২. উপরের বর্ণনা অনুসারে ধরুন একটি শহরে এই ব্যবস্থাপনা নেওয়া হবে। তখন প্রথম প্রশ্ন উঠবে, কতজন সঠিক নাগরিক এটা তৈরি করবে বা অংশগ্রহণ করবে? যদি কোনো কারণে এর সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতভেদ তৈরি হয় তখন সেখানে প্রথাগত ভাবে Aristocracy বা (Government by best, aristos) অথবা Oligarchy (Government by few, oligos) এই প্রথার ডেমোক্রেসি সেখানে প্র্যাকটিস হবে। যদিও ডেমোক্রেসির শাব্দিক অর্থ হল “Rule by People”। এক্ষেত্রে এই শাব্দিক অর্থের আর সঠিক প্রয়োগ হল না বা সঠিক ডেমোক্রেসি আরম্ভ করা গেল না। সুতরাং ডেমোক্রেসিতে ‘wise uniform opinion’ গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে ৪নং মূলনীতিটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল “যদি নাগরিকরা কোনো একটি বিষয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে তখন প্রশ্ন উঠবে কারা এই প্রথাটা শুরু করবে, মেজোরিটি না মাইনোরিটি?” এই প্রশ্নের সমাধান অত্যন্ত কঠিন তাই এখানেও ডেমোক্রেসি বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। আবার ৫নং নীতিটি হল, ধরুন মেজোরিটি জনগণের অংশটি ডেমোক্রেসি প্রথাটা চালুর বিষয়ে উপযুক্ত বিবেচিত হন তখনও কিন্তু অনেকগুলি প্রশ্ন উঠবে সেটার সমাধান করতে না পারলে মেজোরিটি হয়েও তারা কিন্তু এ প্রথাটি চালু করতে পারবেন না। যেমন কতজন মিলে এই মেজোরিটি তৈরি হয়েছে? সবাই কি legitimised বা যোগ্য নাগরিক? মেজোরিটি কি ভোটার? কতগুলি গ্রুপ বা কতগুলি সংস্থা/সংগঠন মিলে এই মেজোরিটি তৈরি হয়েছে? তারা কি বংশানুক্রমিক নাকি আঞ্চলিক? এই সবগুলি প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলে বা ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে মেজোরিটি হয়েও সেখানে ডেমোক্রেসি প্র্যাকটিস করা যাবে না বরং সেই সবক্ষেত্রে তখন মোনারকিজম বা রাজতন্ত্র তৈরি হবে।

ডেমোক্রেসির এই সব চড়াই-উৎরাই, প্রশ্ন-সমাধান ইত্যাদি বিবিধ জটিলতা দেখেই হয়ত দার্শনিক সম্রাট ‘প্লেটো’ রাষ্ট্র পরিচালনায় রিপাবলিক শব্দটা ব্যবহার করেছেন যার সংজ্ঞা হল: ’Republic- the best government would be led by a minority of the most highly qualified persons’ এই রিপাবলিক নীতিটিই আমাদের দেশে প্রয়োজন বিধায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনেশুনেই বাংলাদেশের সংবিধানকে দেশটির মূলনীতি হিসাবে ’Republic of Bangladesh’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এটা জানতেন বা বিশ্বাস করতেন যে, এ দেশের মানুষের চরিত্রের যে গতিধারা তাতে বহুসংখ্যক মানুষ এ দেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করেব না অথবা এটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে বা বিভক্ত হয়ে পড়বে, তাই তিনি দার্শনিক প্লেটোর রিপাবলিক নীতিটা গ্রহণ করেছেন। যেখানে কিছু সংখ্যক উপযুক্ত নাগরিক দেশটা চালাতে পারবেন। কেননা ডেমোক্রেসি ৪নং মূলনীতিটি এখানে চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, যেমন জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তাই এই অবস্থায় এ দেশে ডেমোক্রেসির পূর্ণরূপ বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়। এই সুযোগে অনেক বড় বড় দেশ আজকে বাংলাদেশেকে ডেমোক্রেসির সবক দেয়, কিন্তু তাদের দেশে কোন ধরনের ডেমোক্রেসি তারা প্র্যাকটিস করছে, তা কিন্তু এখনো সুস্পষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি আমেরিকা একটি আধিপত্যবাদী দেশ, যার পররাষ্ট্রনীতিই হচ্ছে আধিপত্যবাদ। কিন্তু সেখানে ৫-৬ ধরনের ডেমোক্রেসির। কোনটা তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োগ করছে এটা কিন্তু বিশ্বাবসীর কাছে স্পষ্ট নয়। কেননা ডেমোক্রেসি ও আধিপত্যবাদ এক নীতি নয়। তবে তারা কেন আধিপত্যবাদকে তাদের মূলনীতি বানাতে চায়?

সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও দার্শনিক প্লেটোর মতে সেখানে প্রকৃত কোনো ডেমোক্রেসি নেই। কেননা কয়েক বছর আগে সেখানে সাধারণ নির্বাচনে ব্যালট বক্স ড্রেনে পাওয়া গিয়েছিল। আবার কোর্টের রায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিল। সুতরাং ডেমোক্রেসি খোদ আমেরিকাতেই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে আমেরিকাকে বোঝাতে হবে বাংলাদেশ transhumanist transgressor দেশ নয় বরং মৌলবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমেরিকার নীতিই অবলম্বন করে মাত্র এবং এটাও বলা প্রয়োজন যে এলিট ফোর্স র‍্যাব নীতিগতভাবে মৌলবাদ ও সন্ত্রাস দমনে আমেরিকার নেভি সিল কমান্ডোকে অনুসরণ করে।

এখন আমি রিপাবলিক গর্ভমেন্ট নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই কেননা এটা জানাটাও জরুরি। Republic একটি ল্যাটিন শব্দ যেটা হল ‘রেস পাবলিকা’ অর্থাৎ পাবলিক ব্যাপার। কমনওয়েলথ এর ৬ষ্ঠ সংস্করণ (১৫৭৬) বইয়ে ফ্রেন্স পলিটিক্যাল ফিলোসফার ‘জিন বোডিন’ রিপাবলিক এর এক দুরূহ সংজ্ঞা দিয়েছেন “The rightly ordered government of a number of families and of those things which are their common concern, by a sovereign power ”. ‘অর্থাৎ কিছু ব্যক্তি পরিবার নিয়ে গঠিত একটি সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে’ যেটা প্লেটোর ‘Republic’ এর সংজ্ঞা পূর্ণরূপে সমর্থন করে। আমেরিকার রেভ্যুলেশন (১৭৭৫-৮৩), ফ্রেন্স রেভ্যুলেশন (১৭৭৮-৮৯) বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই আসলে ডেমোক্রেসি বলেন আর রিপাবলিকান বলেন এখানে absolutist বলে কিছু নেই এবং এইসব সিস্টেমগুলি ’always adjustable and those are designed for the welfare of the people or of the state’ পৃথিবীখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টোটল তার ‘Book III of his politics গ্রন্থে বলেছেন the latin term Republic can be used in a general way to refer to any regime, or in a specific way to refer to government which work for the public good.’ আবার এ পৃথিবীর ‘Classical Republic’ যেটা হল Republic of Athens এবং Roman Republic নিয়ে দার্শনিক অ্যারিস্টোটল, সেসেরো, পলিবাস, ম্যাকিয়াভেলি, মন্টেসকিউই, অ্যাডামস ও ম্যাডিসন রিপাবলিক সিস্টেম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং এক পর্যায়ে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় মিক্সড গর্ভনমেন্ট এর কথাও উল্লেখ করেছেন।

এখানে কিন্তু রিপাবলিক এর absolutist প্রয়োগ হয়নি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২০৬টি দেশের মধ্যে ১৫৯টি দেশ রিপাবলিক হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এর মধ্যে অনেক দেশেই কোনোটিতে ইলেকটেড গর্ভমেন্ট এবং কোনোটিতে নন ইলেকটেড গর্ভমেন্ট রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ একটি রিপাবলিক দেশ। সেজন্য এর সরকারকে রিপাবলিক রাষ্ট্রের সাধারণ নর্মসগুলি যতদূর সম্ভব পূরন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে, কেননা এ দেশটি এখন সেলুকাসের দেশের মতো হয়ে গিয়েছে। কারণ এ দেশের অনেক মানুষের কাছে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনটা ‘ভিক্ষার চাল কাড়া আর আকাড়ার’ মতো। কারণ হিসাবে বলা যায়, অনেক সংগঠন বা দল বা ব্যক্তি, শুধু নিজ হীনস্বার্থে মৌলবাদের পদতলে চুম্বন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। যাই হোক আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বর্গীয় পিতার ‘Republic of Bangladesh’ এই মূলনীতিই অবলম্বন করে আগামীতে উপযুক্ত কিছু সংখ্যক যোগ্য মানুষ নিয়ে ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে, Most legitimized নাগরিকদের নিয়ে একটি ভোট অনুষ্ঠান করলে সংবিধানের কোনো ব্যত্যয় হবে না। বরং জাতি বহুবিধ জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি দেশটা জঙ্গিবাদের নির্মম হিংস্র থাবা থেকেও মুক্তি পাবে এবং এক্ষেত্রে দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের ‘রিপাবলিক’ সংজ্ঞা দুটো মানলেই চলবে এবং most adjustable theory – Democracy নিয়ে একটু পরে চিন্তা করলেই দেশ বেশি উপকৃত হবে।

পরিশেষে একটি প্রশ্ন রেখে লেখাটা শেষ করতে চাই যে, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা যিনি মনে প্রাণে ডেমোক্রেটিক, সেক্যুলার ও সোস্যালিস্ট ছিলেন, তাকে ডেমোক্রেসি বা রিপাবলিক এর কোন সংজ্ঞা প্রয়োগ করে হত্যা করে হয়েছিলো? সুতরাং এদেশে আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “চীনের প্রধানমন্ত্রী দেং জিয়াত্তপিং” এর সেই মহান উক্তিটি স্মরণ করে ‘Nothing goes with the color of the cat, the thing is whether it can catches the rat.’ “অর্থাৎ বিড়ালটা সাদা কি কালো সেটা জানার দরকার নেই, দরকার হলো বিড়ালটা ইঁদুর ধরতে পারে কিনা?” এইটা মাথায় রেখেই স্বাধীনতার স্বপক্ষশক্তি রাষ্ট্রের হাল ধরবেন শুধুমাত্র রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য এবং সেই পথেই হাঁটতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ।

 

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ
সাবেক প্রক্টর
এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস, এমএসিপি
অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

——————————————————————————————————————————————————————

মতামত বিভাগে লেখার বিষয়বস্তুর সম্পূর্ন লেখকের নিজস্ব। এই বিষয়ে আজকের বাজারের কোন দায়বদ্ধতা নেই।  

—————————————————————————————————————————————————————–