কোন দেশের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি মূল্যায়ন করতে হলে, সে দেশের পুঁজিবাজার পর্যালোচনা করলে সাম্যক একটি ধারনা পাওয়া যায়। কারণ ব্যবসা পরিচালন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পুঁজির প্রয়োজন হয়। পুঁজিবাজার হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী পুঁজি উত্তোলনের জন্য উত্তম স্থান।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুব বেশী জৌলসপূর্ণ নাহলেও এদেশের পুঁজিবাজার পত্রিকার শিরোনাম হয় মাঝে মধ্যেই। শিরোনাম হওয়ার কারণও কিন্তু নেহায়েত কম নয়। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ পুঁজিবাজারকে এখনো প্রকৃত বিনিয়োগ বান্ধব বাজার হিসাবে মনে করে না।
১৯৯৬ ও ২০১০ সালে এদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুটি ধ্বসের পরে এর গুনগত পরিবর্তনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। যেমন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জর মালিকানা পর্ষদ ও পরিচালনা পর্ষদ পৃথকীকরণ বা ডিমিউচুয়ালাইজড এবং স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার নির্বাচন। শুধু তাই নয়, তাদেরকে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যামে স্ট্র্যাটেজিক অংশীদারের মনোনীত ব্যাক্তিকে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্তিও অন্যতম। এছাড়াও আইনগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যার সুফল পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেক হোল্ডার খুব সহসাই পাবেন।
পুঁজিবাজার উন্নয়ন কার্যক্রম সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জ সমূহ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কেন্দ্রিয় ব্যাংক ও অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় যেমন জরুরি, তেমন জরুরি এ খাতে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা। তবে ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীদের সচেতনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কর্য্যক্রম চালু করা অন্যতম।
গত কয়েক বছরে পুঁজিবাজারের গতিবিধি লক্ষ্য করে আমার মনে হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পনিগুলোকে আইনের মধ্যে থেকে তাদের নৈতিকতার প্রশ্নে এক্সচেঞ্জসমূহ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরো মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। আমি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ন দুটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।
পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বাধীন পরিচালক:
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেজন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন একটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। স্বাধীন পরিচালক হওয়ার জন্য তার যোগ্যতা, কারণীয় ও বারনীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয় মূল পরিচালনা পর্ষদের হাতে, আর এখানেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ স্বাধীন পরিচালক সবসময় মূল পরিচালনা পর্ষদের পছন্দের ব্যাক্তি হয়ে থাকেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে, স্বাধীন পরিচালকের মতামত গ্রহণ করা হয় না বললেই চলে। তার প্রমাণ হল, আজ পর্যন্ত কোন স্বাধীন পরিচালকের সঙ্গে মূল পরিচালনা পর্ষদের মতবিরোধের কারণে, কোন স্বাধীন পরিচালক পদ ত্যাগ করেছেন বা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এমন কোন ঘটনা জানা যায়নি।
ফলে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের উদ্দেশ্য কতটুকু সফলতার মুখ দেখেছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীন পরিচালকগন যাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে, তার জন্য স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের একটি গ্রহনযোগ্য নীতিমালা অত্যন্ত প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে অডিটর নিয়োগের মত একটি প্যানেল করা যেতে পারে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির ডিভিডেন্ড:
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কিছু কোম্পানি, গ্র“প অব কোম্পানির মধ্যে থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন জেড গ্র“পে লেনদেন হচ্ছে তা সত্বেও কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়, শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত কোম্পানির আয় থেকেই। যার ফলে কোম্পানি আরও লোকসানী হয়। ফলশ্র“তিতে বিনিয়োগকারীদের কোন প্রকার লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে না। আবার মাঝে মধ্যে এসব কোম্পানির শেয়ারর মূল্য কোন প্রকার কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে এবং শেয়ার লেনদেনের পরিমানও ভুতুড়ে হারে বৃদ্ধি পায়।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কিছু কোম্পানি আছে যার ব্যবসায়ীক অবস্থা কি, সে সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে। কারণ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কোন সভা পর্যন্ত হয় না বছরের পর বছর।
আবার তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে, কিছু কোম্পানির ব্যবসা ভাল, ইপি এস ভাল। কিন্তু হঠাৎ করেই নোডিভিডেন্ড, এমনকি নোডিভিডেন্ডের কোন প্রকার ব্যাখ্যা থাকে না। যে সমস্ত পরিচালনা পর্ষদ এ ধরনের কাজ করেন, তাদের কোম্পানির সু-শাষন ও নৈতিকতার প্রশ্নে স্টক এক্সচেঞ্জ সমূহ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ করার অনেক সুযোগ আছে বলে আমার মনেহয়।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কিছু কোম্পানির ব্যবসা ভাল, ইপিএস ও ভাল, কিন্তু ডিভিডেন্ড পর্যাপ্ত নয়। এমন অপর্যাপ্ত ডিভিডেন্ডের কোন প্রকার ব্যাখ্যাও থাকে না। আমার মনে হয়, এখানেই নৈতিকতার প্রশ্নে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ আপোষ করেন।
আমার মনে হয়, স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয় করে একটি নীতিমালা করা দরকার, যে ভালো কোম্পানি নোডিভিডেন্ড বা অপর্যাপ্ত ডিভিডেন্ড দিলে সঙ্গে একটি ব্যাখ্যা থাকার প্রয়োজন এবং পরবর্তীতে প্রদেয় ব্যাখ্যার সঙ্গে তার কার্যক্রমের মিল আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে বা ফলোআপ এ রাখতে হবে।
মোট কথা হলো, বাংলাদেশের পুজিবাজারকে একটি উন্নত পুজিবাজারে নিতে হলে, স্টক এক্সচেঞ্জ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কেন্দ্রিয় ব্যাংক, তালিকাভুক্ত কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংক, সিকিউরিটিজ হাউজ ও অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এখাতে সু-শাষন, নৈতিকতা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সকলের কাজ করার তাগিদ অনুভব করার সময় এখনই।
জোবায়ের হোসেন
ডিজিএম, স্টারলিং স্টকস এন্ড সিকিউরিটিজলিমিটেড