পূবালী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের পরিচালক জয় কুমার সাহা, বাবার সঙ্গে লবণ ব্যবসা শুরু করেন। তরুণ প্রজন্মের এই লবণ ব্যবসায়ী এ দেশের লবণ শিল্পের সম্ভাবনা, রপ্তানি সম্ভব কি না, লবণ চাষীদের সার্বিক অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয়ে আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন, এবিটিভি’র সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।
কয়েক দশক আগে আমার বাবা লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা শুরু করেন। বাবার সঙ্গে আমিও এ ব্যবসায় জড়িয়ে যাই। আমরা যখন শুরু করি,তখন বাংলাদেশে লবণ খুব একটা প্যাকেজিং বা প্রক্রিয়াজাত হতো না। তারপর ধীরে ধীরে আমরা মার্কেটিং শুরু করি। তখন আমরা নিজেরাই প্রাইভেট সেক্টরে প্রথম আয়োডিনযুক্ত লবণ প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেজিং শুরু করি। এরপর সরকারের তরফ থেকে এটা নিয়ে প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং উদ্যোক্তদের উৎসাহ দেয়া শুরু হয়। পাশাপাশি চলে অনুমোদন। এক পর্যায়ে এসে এখন যেটা দেখা যাচ্ছে যে,বর্তমানে আমাদের অবকাঠামো যা দরকার তা আমাদের দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনও আমরা রপ্তানিতে যেতে পারিনি। আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো আয়োডিনযুক্ত প্যাকেট করা লবণ রপ্তানি করা। এজন্য সরকারে পক্ষ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা দরকার তা আমরা এখনো পাচ্ছি না। এটা মাথায় রাখতে হবে পোশাক শিল্প রপ্তানিতে বা জাহাজ নির্মাণ শিল্প যেমন রপ্তানিতে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি এরপরের অবস্থানে যদি কোন শিল্প খাত যায়, তবে তা হবে অবশ্যই লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোই বা লবণ শিল্প। তাই সরকার যদি এ দিকে একটু বেশি মনোযোগ দেয়,তাহলে আমার বিশ্বাস আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যেই আমরা লবণ রপ্তানি করতে সম হবো।
কিভাবে লবণ রপ্তানি সম্ভব
আমাদের কাঁচাপণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়। কিন্তু দেশে যেটুকু কাঁচামাল উৎপাদন হয়,তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আমরা তখনই রপ্তানিতে যেতে পারবো যখন কাঁচামাল চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি হবে। এ েেত্র সরকারকে আরো উদ্যোগ নিতে হবে,যাতে করে বেশি বেশি লবণচাষী সৃষ্টি হয়। তাদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত: আমাদের যেসব ইন্ড্রাষ্ট্রি আছে,তা যদি পুরোপুরি দক্ষতার সঙ্গে উন্নত করে উৎপাদনে যাওয়া না যায়,তাহলে আর্ন্তজাতিক বাজার কেন,দেশীয় চাহিদাও মেটানো সম্ভব হবে না। বর্তমানে গ্যাস,তেল ও বিদ্যুত স্বল্পতার কারণে আমরা পুরো সামর্থ্য খাটিয়েও পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছি না। সুতরাং সরকারকে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। এছাড়া কম মূল্যে কাঁচামাল যেন আমরা পেতে পারি, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আর তখনই লনণ রপ্তানি সহজ হবে।
লবণের বাজারদর
বাজার দরের কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হয়,পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে লবণ চাষীরা অনেক অল্প খরচে জমি লিজ নিতে পারে,আর আমাদের চাষীদের তার চেয়ে অনেক বেশি দামে জমি লিজ নিতে হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের চাষীরা লবণ চাষ করতে গিয়ে প্রথমেই ভাবে জমি লিজের টাকা তো অনেক। তার উপর বেশিরভাগ চাষী ঋণের টাকায় চাষ করে,যে কারণে সেটাও মাথায় থাকে। আবার লবণ প্রায় ৬/৭ মাস মাঠে রাখতে হয়,এতে খরচ এবং ঋণের বোঝা বাড়ে। এসব কারণে আমাদের কাঁচামালের দাম অনেক বেশি থাকে। আর তাই অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের প্রোডাক্টের দাম খানিকটা বেশি হয়। দাম কম রাখতে হলে,এটা ধাপে ধাপে করতে হবে। জমির মূল্য কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তা এখনো সম্ভব হয়নি। আর সে কারণে কৃষকেরা খরচ পোষাতে সময় হবার আগেই মাঠ থেকে লবণ উঠিয়ে আনছে। এতে করে গুণগত মান ঠিক থাকছে না। আর নিম্নমানের কাঁচামাল যখন আমরা মেশিনে দিচ্ছি তখন আমাদের প্রোডাকশন ঘাটতি বাড়ছে। কিন্তু দেখুন পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা লবণে ঘাটতি অনেক কম। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ঘাটতি যখন বেশি থাকবে, তখন উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। আরেকটি বিষয় হলো, মেশিন স্কিল,যত বেশি উৎপাদন হবে তত বেশি খরচ কমে আসবে। তাই যতদিন না পযর্ন্ত আমরা শতভাগ স্কিল মেশিন অপারেটিং করতে পারছি,ততদিন পযর্ন্ত উৎপাদন খরচ বেশি থাকবে। সে ক্ষেত্রে যেগুলো আমরা রিসোর্স বলি অর্থ্যাৎ তেল,গ্যাস,বিদ্যুত-এগুলোর সরবরাহ নিয়মিত থাকতে হবে। যতটুক গ্যাসের প্রেসার দরকার, তার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে ডিজেলের মূল্যও একটা বিষয়, যেহেতু জেনারেটরও চালানো হয়। এসব বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা দর কম রাখার স্বার্থেই।
প্রবীণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তরুণ প্রজম্মের চিন্তার পার্থক্য
আসলে পার্থক্যের জায়গাটা হলো আমরা এখন অনেক বেশি সময়-সচেতন । নতুন প্রজন্ম প্রতিটি মুহূতর্, প্রতিটি সেকেন্ড কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। যেমন একটা সময় চিঠি আদান-প্রদান হতো,কিন্তু এখন আমরা মুহূর্তেই ই-মেইলে তা সেরে ফেলি। আমরা বিব্রত হই তখনই যখন পাঁচ মিনিটের একটি কাজ করতে দু’থেকে তিন দিন লেগে যায়। নতুন প্রজন্ম যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আসে,তা কমে যায় এ ধরনের প্রতিবন্ধকতায়। এেেত্র প্রশ্ন আসতে পারে কেন? দেখুন ব্যবসা করতে গেলে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের যেতে হয়,সেখানে প্রক্রিয়াগুলো যদি সরকারের পক্ষ থেকে সহজ করা হয় বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস করে দেওয়া হয়,তখন দেখবেন, পাঁচ বছরে একজন উদ্যোক্তা এখন যেখানে হয়তো মাত্র দুটো ইন্ড্রাস্ট্রি করছে,সুবিধা পেলে পাঁচ বছরে চারটি ইন্ড্রাষ্ট্রি করা সম্ভব হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস না হওয়ায় এখন একটি ইন্ড্রাষ্ট্রি করতে প্রায় দু’বছর গেলে যায়। কী ট্রেড লাইসেন্স,কী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র,কী অনুমোদন অর্থ্যাৎ শুরু থেকে একেবারে উৎপাদনে যেতে প্রায় দুই থেকে তিন বছর লাগছে। মার্কেটে প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে আসতেই এই সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তাহলে দেখুন আমি যে আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাড়াবো সেই সুযোগ বা সময় কোনোটিই পাচ্ছি না। এতে করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে উৎসাহ বা আগ্রহ থাকে তা এক পর্যায়ে দমে যায়।
ওয়ান স্টপ সার্ভিস
ধরুন, আমি একটি নতুন ব্যবসা বা ইন্ড্রাষ্ট্রি চালু করতে চাই,তখন এ সম্পর্কে ভালো আইডিয়া দরকার, যে তা কিভাবে শুরু করবো। আর তা করতে গেলে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় হচ্ছে। দ্বিতীয়ত এর জন্য কি কি লাগবে-যেমন কাগজপত্র,অনুমোদন বা ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদী সংগ্রহ করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।এইসব তথ্যগুলো যদি আমি একটি জায়গা থেকে পেতাম,তাহলে উদ্যোক্তা হিসেবে আমার সময় বেঁচে যেতো এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হতো। আর তাতে বাণিজ্যিক সুবিধা নিশ্চিত হতো। শুধু তাই নয়,রপ্তানি নির্ভরতা বাড়াতে হলে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ছাড়া কোনভাবেই এগুনো সম্ভব নয়।
সফলতার জন্য কী প্রয়োজন
সবার আগে দরকার উদ্যোক্তার সততা ও নিষ্ঠা। এটা ছাড়া কোন উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখে না। আপনি যদি দেখেন,এদেশে এখন পযর্ন্ত যারা বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন,তাদের সবারই কঠোর পরিশ্রম,সততা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠার ফলেই সাফল্য ধরা দিয়েছে। এ েেত্র সরকারসহ অন্যান্য সেক্টরে শিল্পের সঠিক মূল্যায়নও হতে হবে। কারণ সঠিক মূল্যায়নের অভাবে উদ্যোক্তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থ হন। তাই সব েেত্রই পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে। কী সরকার, কী উদ্যোক্তা এমন কী ভোক্তাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিটি েেত্রই তা নিশ্চিত করা গেলেই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে ওঠবে।
জয় কুমার সাহা
পরিচালক, পূবালী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ