বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাব: কোভিডের কারণে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় প্রতিটি জায়গায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আপনারা জানেন, ২০২০ সালে প্রথম যখন বিশ্বে কোভিড শনাক্ত হয়, তখন আমাদের দেশে মার্চ -এপ্রিল সময়টায় লকডাউন দেয়া হলো। পরবর্তী বছর ২০২১ সালের জুলাই -আগস্টও লকডাউন ছিল। ২০২২ সালে জানুয়ারির শেষ এবং ফেব্রুয়ারিতে কোভিডের কারণে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা আসলে সনাক্ত করতে পারছি না যে, কখন বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাব আসবে। এর কারণে আমাদের পুরো ইন্ডাস্ট্রি বিশেষ করে বীমা শিল্পেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
আপনারা দেখেছেন, বাংলাদেশের বীমা শিল্প একটা নির্দিষ্ট চ্যানেল দিয়ে বিক্রয় প্রতিনিধিরা কর্মসূচি করে। যেটাকে আমরা ক্যাপটিভ এজেন্সি বা এজেন্সি মডেল বলে থাকি। সারাবিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মডেল থাকে। কিন্তু আমরা আমাদের গ্রুপ ইনস্যুরেন্স যেটা ডাইরেক্ট মার্কেটিং করি এবং ক্যাপটিভ এজেন্সি মডেলে একক বীমা বিক্রি করি। আমাদের এই একক বীমার বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রতি মুহূর্তেই মানুষের কাছে গিয়ে তার প্রয়োজন বিবেচনা করে বীমা বিক্রি করে আসে। বাংলাদেশে বীমা কিন্তু এখনো একটা ভলান্টারি প্রোডাক্ট, এটা ম্যান্ডেটরি হয়নি। যে কারণেই সামাজিকভাবে সরাসরি গ্রাহকের কাছে যাওয়াটা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড মহামারীর বাধাটা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। এই সামাজিক দূরত্বের কারণে গ্রাহকের কাছে সরাসরি যাওয়াটা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এতে করে সার্বিকভাবে বীমা শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আপনারা নিশ্চয়ই এটাও জেনে থাকবেন যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৮১টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আছে। এর ৪৬টি সাধারণ বীমা এবং ৩৫টি জীবন বীমা। জীবন বীমায় কিছু ফুলটাইম কর্মী,কিছু বেতনভোগী কর্মী,আর বাকিরা আমাদের কমিশন রিপ্রেজেন্টেটিভ কর্মী হিসেবে কাজ করছে। আমাদের প্রায় ছয় লক্ষ কর্মী আছে। সেই ছয় লাখের মধ্যে হয়তোবা দশ শতাংশ পাবেন এইচআর ভুক্ত হিসেবে আছে। আর বাকি ৯০ ভাগ কর্মী যারা সম্পূর্ণরূপে তাদের কমিশন ইনকামের উপর নির্ভরশীল। জীবন বীমার কর্মীরা তাদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা দেখেছি বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা এসেছে। আমাদের বীমা খাতে কোনো ধরনের প্রণোদনা আসেনি। এমনিতেই বীমা খাত অনেক রুগ্ন খাত। তার ওপর এই বৈশ্বিক মহামারী আমাদের আরো অনেক বেশী পিছিয়ে দিয়েছে। এখানে আবার আশার কথাও আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোম্পানিগুলো নিজেদেরকে খুব দ্রুত ডিজিটাল টেকনোলজির সাথে যুক্ত করে নিয়েছে। সে কোম্পানিগুলো অত্যন্ত ভালো করছে। আবার এই মহামারী যেমন আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। তেমনি আবার অপার সম্ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে। সেই অপার সম্ভাবনার জায়গাটা হচ্ছে সেবা। কারণ, এখন মানুষ বিপদে আছে। সেই বিপদে আমি যদি দ্রুত সেবা দিতে পারি, তাহলে মানুষের কাছে আমরা আস্থাভাজন হবো। আর আস্থাভাজন হতে পারলেই কিন্তু আমাদের এই বীমা শিল্পের ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে। সেই কাজটাই আমাদের মত কিছু কোম্পানি, যারা সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালে নিজেদেরকে কনভার্ট করতে পেরেছে, তারাই সফলতা পেয়েছে।
চার্টার্ড লাইফ ইন্সুরেন্সের অর্জন: চার্টার্ড লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি পরপর দু’বছর ৭০ ভাগ এর উপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এটা বাংলাদেশে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আমার পলিসি গ্রাহক,আমার পরিচালকগণ, আমার প্রতিনিধি, এজেন্ট এবং আমার সকল সহকর্মীদের ঐকান্তিক পরিশ্রম রয়েছে। এ জন্য তাদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আর আমাদের নিষ্ঠা ও কাজের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের মানুষের কাছে বীমা সেবার ক্ষেত্রে এই আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।
বীমা শিল্পের অগ্রগতি: আমরা সব সময় একটা মৌলিক প্রশ্নটা করে থকি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বা উন্নত দেশে কি হচ্ছে, আর আমরা কি পাচ্ছি? আমরা জানি, বীমা একটি উন্নত বিশ্বের সেবা। আমরা তা বিশ্বাস করি। আসলে বীমা প্রতিটা দেশেই এক ধরনের সামাজিক সেবা। আমরা হয়তো অজান্তেই অতীতে এই কাজ করে এসেছি। আমরা যখন উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা মূলকভাবে দেখতে চাই, তখন আমরা প্রায়শই বলি, বাংলাদেশের বীমা শিল্প কেন এগোচ্ছে না। বাংলাদেশের বীমা শিল্পের সবদিকেই কিন্তু নেতিবাচক জিনিস খুঁজে পাই। আসলেই কি তাই ? উন্নত বিশ্বে কি হচ্ছে, তা কি আমরা কেউ অনুধাবন করেছি? উন্নত বিশ্বে প্রাইমারি বীমা বাধ্যতামূলক। আপনি যদি ইউরোপ আমেরিকা যেতে চান, আপনি ইন্সুরেন্স না করে ওখানে যেতে পারবেন না। কারণ ইউরোপের সকল মানুষ বীমা সেবার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে কি বীমা বাধ্যতামূলক? না । যদি আমাদের দেশে বীমা বাধ্যতামূলক না হয়, তাহলে বীমার কিভাবে পেনিট্রেশন হবে। আমাদের বর্তমানে পেনিট্রেশন রেট শুন্য দশমিক ৫ নিচে। আমরা চাই এটা ৪ এর উপরে যাক। এর অর্থ এটা দশগুণ হওয়ার সুযোগ আছে। আমার নিজস্ব বিশ্লেষন হলো, বাংলাদেশের এখন মার্কেট প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার। এটা দেড় লাখ কোটি টাকার মার্কেট হওয়া খুব সহজ ব্যাপার। এটাকে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। আমাদের দেশে সুন্দর সুন্দর নীতি আছে কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই।
নীতি বাস্তবায়ন: আপনারা জানেন আমাদের শ্রম আইনে আছে,যে কোনো প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৫০ জনেরও অধিক কর্মী হলেই তাদের গ্রুপ ইন্সুরেন্স বাধ্যতামূলক। এখন আমাদের ৬৮টা ব্যাংক। আপনি খুঁজে দেখেন,কয়টা ব্যাংকে জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের আরএমজি সেক্টরে ৪২ লক্ষ কর্মী কাজ করে। আপনারা দেখবেন, তাদের ফায়ার সেফটির মাধ্যমে কমপ্লায়েন্স করা হয়েছে। এখানে যদি ৫০ জনেরও অধিক কর্মী থাকে তাদের বীমা সেবা বাধ্যতামূলক নীতিটা কি করা হচ্ছে, তা দেখার কেউ নেই। আমাদের দেশে আইন আছে, সেটা প্রয়োগের ব্যবস্থা নেই। তাহলে কিভাবে আমরা সামনের দিকে এগোবো। উন্নত বিশ্বের দেশে এই জিনিসগুলো সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে। আমরা বীমা সেবা যদি বাধ্যতামূলক করতে চাই,তাহলে সরকারের একটি মাত্র নির্দেশনাই যথেষ্ট। গার্মেন্টস কর্মীদের বীমার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তো ৪২ লক্ষ লোক এক সিদ্ধান্তেই বীমা সেবার আওতায় চলে আসবে। সরকারের ১৪ লক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এরা বীমা সেবার বাইরে। সরকারের একটি নির্দেশনায় ১৪ লক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী বীমা সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আমাদের ১০ লক্ষ স্টুডেন্ট আছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারের একটি নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী বীমা সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আমাদের ছয় কোটি লোক মাইক্রোফাইন্যান্স,এনজিওদের থেকে লোন নিচ্ছে। তারাও বীমা সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আমাদের ব্যাংকিং সেবায় কোলেটারাল বা মর্টগেজ প্রয়োজন। এখানে বীমা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আমাদের ব্যাংকিং সেবায় দুই কোটি গ্রাহক যদি থাকে, একটি সিদ্ধান্তেই এই দুই কোটি গ্রাহক বীমা সেবার আওতায় চলে আসবে। আমাদের বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোক ১৮ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহার করে। এই ১৮ কোটি লোককে যদি আমরা বীমা সেবার আওতায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমাদের পেনিট্রেশন রেট শতভাগের উপর চলে যাবে। এটা কেউ ভাবছে না।
আমরা উন্নত দেশের কথা বলি, উন্নত দেশগুলো এভাবেই বাস্তবায়ন করছে। এই জায়গাটায় আমাদের নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে, বীমা সেবার পরিধি বাড়বে। এখন আমরা যারা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে আছি,আমরা কি করছি ? আমাদেরও কিছু দায়ভার আছে। আমরা একটি কোম্পানি, আরেকটি কোম্পানিকে কপি-পেস্ট করছি। যখনই বীমা বাধ্যতামূলক হবে, মানুষ তখন সচেতন হবে। মানুষ তার সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে কি সেবা নিচ্ছে, তার দায়ভার নিতে হবে কোম্পানিগুলোকে। কোম্পানিগুলো তখন ভালো সেবা দিতে বাধ্য হবে। একজন আরেকজনকে একাউন্টেবল করবে। মানুষ বীমা সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে যখন বাধ্য হবে, তখন ভালো সেবাটা নেয়ার জন্য সব জায়গায় খোঁজ খবর নিবে। তখন বীমা গ্রাহকেরও সচেতনতা বাড়বে। এইভাবে আমরা সামাজিক ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারি। যেখানে নীতি,উদ্যোক্তা, দক্ষ বীমা কর্মী,সচেতন বীমা গ্রাহকের মাধ্যমে দেশের পেনিট্রেশন অনেক বেড়ে যাবে।
জাপান, ইউরোপ ,ভারত, তারা এভাবেই বীমা সেবাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা অনেক কিছু করতে চাই, কিন্তু মূল জায়গাতে নজর দেই না। আমরা মূল জায়গায় নজর দিলেই আমাদের এই বীমা শিল্প আরো সমৃদ্ধ হবে।
অধিক ইন্সুরেন্স কোম্পানি: বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ৮১টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১৪০ কোটি মানুষ। তাদের মাত্র ৫২ টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। আমাদের দেশে বীমা কোম্পানি অধিক সংখ্যায় আছে। এই অধিক সংখ্যায় থাকাটাও আমি অপ্রতুল বলবো না। কারণ আমরা মাত্র এক পার্সেন্ট এর নিচে পেনিট্রেশন নিয়েছি। তারমানে এখনো যদি আমি ১০ শতাংশ পেনিট্রেশন নিতে চাই,আরো দশগুণ ব্যবসা করার সুযোগ আছে। তাহলে ৮১টা কোম্পানিরও ভালো সুযোগ আছে। অপরিকল্পিতভাবে এতগুলো বীমা কোম্পানি,দক্ষ বীমাকর্মী, সঠিক নীতি,ডিমান্ড সেন্ট্রিক প্রোডাক্টের অভাবের কারণে এবং বিভিন্ন সার্ভিস এর ক্ষেত্রে অপ্রতুল সার্ভিস পাওয়ার কারণে, বীমার প্রতি মানুষের নেগেটিভ অ্যাটিচিউড এসে গেছে। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, অধিকসংখ্যক বীমা কোম্পানিগুলো আমরা একটি জায়গায় প্রতিযোগিতা করছি। সেটা নেক্কারজনক। যেটা সঠিকভাবে হওয়া উচিত, সেটা হয়নি। এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে কর্মীদের টেনে নিয়ে আসছি। যার ফলে অদক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে। কর্মীদের আইন-কানুন মানার কথা বললেই তারা আরেক কোম্পানিতে চলে যাচ্ছে। কারন, তার অন্য কোম্পানিতে ডিমান্ড আছে। এর মানে হচ্ছে, অদক্ষ লোক উপরের পদ-পজিশনে চলে আসছে। যার ফলে তারা সঠিক সেবা দিতে পারে না।
কমিটমেন্ট সেল: আমরা কমিটমেন্ট বা কনট্রাক সেল করি। এই কন্ট্রাক্টের এগেইনেস্টে আমরা যে কথাগুলো বলি, সে কথাগুলো আসলেই দলিলে আছে কিনা, সেটা আমরা পলিসি গ্রহীতাদের সঠিক ভাবে বলি না। যার ফলে, এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে কর্মীরা চলে গেলে, পলিসিগুলো ল্যাপস হয়ে যায়। তখনই আমাদের প্রতি পলিসি গ্রহীতাদের নেগেটিভ অ্যাটিচিউড তৈরি হয়ে যায় ।
আমরা এখন টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে দিচ্ছি। আগে হাতে হাতে দিতাম তখন হারিয়ে যেতো। সে কারণে, এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে আসাতে টাকা কম হারায়। এক কিস্তি,দুই কিস্তি দেয়ার পর আমরা মনে করি,ব্যাংকে যেভাবে টাকা রেখেছি, বীমাতেও তেমনি ভাবে রাখা হয়েছে। আসলে তেমনটি না। কারণ, বীমা প্রতি সেকেন্ডে প্রটেকশন দিচ্ছে। এক ধরনের রিস্ক নিচ্ছে। প্রতিটি সমযরে বিপরীতে তার একটা ভ্যালু আছে। এর অর্থ আপনার টাকাটাই আপনি মেয়াদান্তে ফেরত পাবেন,তার আগে পাবেন না। ব্যাংকে যেমন যখন তখন আমার নিজের টাকা তুলতে পারি,বীমাতে তা নয়। এই জিনিসটা মানুষ জানে না । যার ফলে সঠিক সময়ে সঠিক প্রিমিয়াম না জমা দিলে পলিসিগুলো তামাদি হয়ে যায়। তখন মুল টাকাটাও ফেরত পাওয়া য়ায় না। এই নিয়ে আমাদের প্রতি মানুষের আক্ষেপ, নেগেটিভ অ্যাটিচিউড আছে। সেই জায়গা থেকে আমাদের পরিবর্তন আসা প্রয়োজন। আমরা আবার পলিসি বিক্রি করতে গিয়ে প্রতিযোগিতার কারণে দুই গুন,তিন গুণ এমনকি ব্যাংকের চেয়েও অধিক মুনাফা দিব বলে থাকি। সেটা কিভাবে সম্ভব? আমরা তো আমাদের টাকা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ফাইনান্সিয়াল পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সেই রিটার্ন এনে ডিভিডেন্ড আকারে গ্রাহককে দেই। ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট ৬ -৯ পার্সেন্ট। আমি কোনোভাবেই তার থেকে বেশি দিতে পারি না। অথচ আমি কমিটমেন্ট করে সেল করে চলে আসছি। কোম্পানিগুলোকে এর দায়ভার নিতে হচ্ছে। এটা পুরো ইকোসিস্টেমেই ডায়লুটেড হয়ে গেছে।
আমি কিন্তু এখানে আশার আলো দেখছি। কারন, এক সময় বীমা শিল্প ছিল কমার্স মিনিস্ট্রির অধীনে। যেটা থাকা উচিৎ ছিল ফাইন্যান্স মিনিস্ট্রি (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ)-এর অধীনে। ১৯৭৩ থেকে ২০১০ এই সময়টা আমরা ছিলাম কমার্স মিনিস্ট্রির অধীনে। আমাদের তৈরি হয়েছে ভুল জায়গায়। এখন ২০১১এর পর থেকে আমাদের মূল জায়গায় এসেছি। এখন সরকারও আমাদের দিকে নজর দিচ্ছে। সরকার এখন উন্নত বিশ্বের দেশ হতে চায়। ২০৩০-২০৪১ এ আমরা উন্নত দেশ হবো। আমাদের জিডিপি আড়াই হাজার কোটি টাকার উপরে চলে গেছে । উন্নত দেশ হওয়ার আরেকটা অসুবিধা আছে। আমাদের সকল ধরনের রিস্ককে প্রটেকশনে আনতে হবে। সরকার এটা সঠিকভাবে অনুধাবন করেছে। সেই অনুধাবন থেকেই পহেলা মার্চ কে জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা করা করেছে ।
জাতীয় বীমা দিবস: পহেলা মার্চ আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করেন। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পহেলা মার্চ জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। আর্থিক বিভাগের শিল্পের মধ্যে বীমা শিল্পই একমাত্র তাদের জাতীয় দিবস পেয়েছে। প্রতিবছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পহেলা মার্চ আমাদের এই অনুষ্ঠানে আসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেকেও বীমা পরিবারের একজন সদস্য মনে করেন। সরকারের নজরে আসার কারণে বীমা শিল্প আস্তে আস্তে উন্নত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের প্রথম পরিকল্পনায় আমাদের প্রবাসে যারা কাজ করতে যায়,তাদের বীমা বাধ্যতামূলক করেছে। গত বছর সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা বীমা পাইলট প্রসেসে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছে। চলতি বছরে অটিস্টিক – ডিজেবল মানুষদের কিভাবে ইন্স্যুরেন্সের প্রটেকশনে আনা যায,সরকার এই নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকার ও বীমা শিল্প এইসব নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
নতুন বনাম পুরাতন: মেটলাইফ ৭০ বছরের পুরনো কোম্পানি। মেটলাইফের সাথে তো আমি পেরে উঠব না । মেটলাইফের মত আমি ডিভিডেন্ড দিতে পারব না। কারণ মেটলাইফের মত আমার প্রফিট আসে না। এটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ । আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, তারা অতীতে তাদের তাদের লাইফ ফান্ড বাড়িয়ে নিয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন দিয়ে বড় রিটার্ন বের করতে পেরেছে। তখন ব্যাংকিং ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেশি ছিল। ফলে নতুন কোম্পানিগুলো এই জায়গাটায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মেটলাইফ,প্রগতি লাইফ,জীবন বীমা এরা অনেক ভালো পারফরম্যান্স করেছে। এর জন্য আমরা অনুপ্রাণিত হই। আবার ফারইস্ট,ডেল্টার মতো কোম্পানিদের ব্যাবসায়িক অসঙ্গতির কারণে, আমাদের উপর এক ধরনের প্রতিকূলতা পরিবেশ তৈরি করেছে।
আমরা একটা জায়গায় এগিয়ে আছি। নতুন কোম্পানি হিসেবে শুরু থেকেই আমরা ডিজিটাল পথকে অনুসরণ করেছি। আমাদের চ্যানেল ডিজিটালি হয়েছে। ফলে আমাদের খরচ কম হয়েছে। ডিজিটালি আমরা গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করতে পারছি। বীমা শুধুমাত্র গ্রাহকদের বড় বড় রিটার্নই দেয় না, এটা তাদের জন্য একটি রিস্ক প্রটেকশন ও ফোর্সড সেভিংস। যখনই গ্রাহকের বীমা সেবা পাওয়ার প্রয়োজন হয়, আমাদেরকে অ্যাপস-এর মাধ্যমে পোর্টালে জানালে, আমরা দ্রুত গ্রাহকদের সেবা দেয়।
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স অষ্টম বছর শেষ করে নবম বছরে পদার্পণ করেছে। আমি এখানে তৃতীয় বছরের মত কাজ করছি। এই তিন বছরের মধ্যে আমরা শেষ ১০ থেকে প্রায় প্রথম ১০ এর কাছাকাছি চলে এসেছি। এটা আমাদের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। এ জন্য আমি চার্টার্ড লাইফের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি: এটা আইনে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবেই বলা হয়েছে, নতুন কোম্পানি তার তিন বছর কর্মসূচির মধ্যেই পুঁজিবাজারে আসা উচিৎ। কিন্ত বাস্তবতা হলো, মার্কেট ইন্টারেস্ট রেট পড়ে গেছে, কম্পেটিটীভ সিচুয়েশন তৈরি হয়েছে। আমি যদি ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিস করি, তাহলে দেখা যায়, প্রথম সাত বছরের মধ্যে কোনো বীমা কোম্পানির পক্ষে পুঁজিবাজারে আসার সুযোগ নেই। যদিও আইনে তিন বছর আছে। নতুন ১৭টি ইন্সুরেন্স কোম্পানির মধ্যে শুধু একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে আমরা কার্যক্রম গত বছর সাবমিট করেছি। কিছু কিছু পেপার আপডেট করার জন্য আমাদেরকে বিএসইসি থেকে নির্দেশনা দেয়। বিএসইসি আমাদের চেক লিস্ট আপডেট করে সাবমিট করার জন্য বলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী এপ্রিলের মধ্যে বিএসইসি আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছে সেই নির্দেশনাগুলো আমরা অর্জন করতে পারব।
প্রণোদনা: আমি প্রণোদনার পক্ষে না। আমি অনুদানে বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশ তার ইনক্লুসিভ বিজনেস করবে। নিজেরাই নিজেদের সক্ষমতা তৈরি করবে। তবে প্রণোদনা সাময়িকভাবে প্রয়োজন। যেমন, যে দুটো মাস আমার সকল কর্মী বসে গিয়েছিল, তখন তাদের আয় নেই। তখন যদি আমি তাকে মিনিমাম একটা আয়ের ব্যবস্থা না করে দেই,তাহলে সে পরিবারগুলো চলবে কিভাবে? তারা তখন আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। আমরা চার্টার্ড লাইফ একমাত্র কোম্পানি,২০২০ সালে যখন বলা হয়েছিল দু মাস পুরোপুরি লকডাউন। আমরা আমাদের কর্মীদের সুদবিহীন লোন দিয়েছি প্রায় ৫৫ লাখ টাকা। কর্মীদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা ব্যবসা করে এ টাকা কোম্পানিকে ফেরত দেবে। এই টাকা আমরা জুন -জুলাই মাসে দিয়েছিলাম। কর্মীরা ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যবসা করে সকলে এই টাকা ফেরত দিয়েছে। এই ধরনের অনুদানটা আমার প্রয়োজন।
এই ধরনের অনুদান যদি আমরা সব বীমা কোম্পানিতে দিতে পারতাম, তাহলে অনেক কর্মী বীমা শিল্প থেকে চলে যেত না। যারা এসেছে তারা যদি হতাশ হয়ে চলে যায়,তাহলে তো আমি নতুন কর্মী তৈরি করতে পারছি না। বীমা শিল্পে যদি তিন মাস পর পর নতুন কর্মী না আসে, তাহলে কোম্পানি আগাবে না। বীমা শিল্পে প্রতিমুহূর্তে নতুন কর্মী লাগবে। আমরা পুরনো কর্মীদেরও ধরে রাখতে পারছি না। নতুন কর্মীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না । যেমন গার্মেন্টস সেক্টরে তিন শতাংশ ইন্টারেস্ট রেটে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল, আমরা যদি এই ধরনের সুবিধা পেতাম, আরো সফল ভাবে আমাদের কর্মীদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারতাম। আমি আমাদের পরিচালকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, তারাই আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমার কর্মীরাও এই জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছে।
চাটার্ড লাইফ এর পরিকল্পনা: চার্টার্ড লাইফ ইন্সুরেন্স-এর একটি বড় পরিকল্পনা আছে। আমরা শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরে আমাদের অবস্থান তৈরি করতে চাই। আপনারা জানেন আমাদের যিনি পরিচালনা পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান, ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদ এমপি, যিনি বাংলাদেশের সফল চিফ হুইপ ছিলেন। আমাদের ভাইস চেয়ারম্যান মাটি ও মানুষের ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। আমাদের যারা উদ্যোক্তা বিশেষ করে ওয়েস্টিন হোটেলের নুর আলী। জিপিএইচ ইস্পাতের জাহাঙ্গীর আলম। এনার্জিপ্যাক-এর নুরুল আক্তার। কোহিনুর কেমিক্যাল-এর রেজাউল করিম আমাদের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে আছেন। চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেট গভর্নেন্স ফলো করে, কোনো ধরনের ইন্টারাপশন ছাড়া। শুধুমাত্র পলিসি,গাইডলাইন,ট্রান্সপারেন্সি একাউন্টিবিলিটির মাধ্যমে এমন একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আমি যখন চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স-এ যোগ দেই, তখন কোম্পানির অবস্থান ছিল ২৬ তম। ৩ বছরের কম সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের অবস্থান ১৪তম তে নিয়ে আসতে পেরেছি। এতেই আমাদের পরিচালনা পরিষদ অনেক খুশি হয়েছেন। আগামী ২০২৫ -২০৩০ ভিশন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের পরিকল্পনা চার্টার্ড লাইফ ইন্সুরেন্স বাংলাদেশে মাল্টিনেশনাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পাবে। আমরা আমাদের বীমা ব্যবসাটাকে, আমাদের সেবাকে, ভবিষ্যতে বিদেশে প্রসারিত করতে চাই।
এস এম জিয়াউল হক
প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড