ইসলামী ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবদান
এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বাংলাদেশের সামগ্রিক ইসলামী অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরতে হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পথ চলা শুরু হয়েছিল মাত্র একটি ব্যাংকের মাধ্যমে। এর মধ্যে অনেক প্রতিকূল সময় মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেক শঙ্কাকে জয় করতে হয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন ইসলামি ব্যাংকিং এদেশে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। অথচ এর মাত্র আড়াই যুগ পর এসে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি?
ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দারুন অপ্রতিরোধ্যতায় এগিয়ে চলছে। এখন তো পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে ১০টি। ৯টি কনভেনশনাল ব্যাংকের রয়েছে ১৯টি ইসলামি ব্যাংকিং ব্রাঞ্চ। আর ৭টি কনভেনশনাল ব্যাংকের রয়েছে ২৫টি উইন্ডো। অপর দিকে বাংলাদেশের সকল ব্যাংকের সর্বোমোট শাখা রয়েছে ৯১৩১টি। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংক সমূহের সর্বোমোট শাখা ৯৬০টি। এর মধ্যে আমাদের আইএফআইএল-এর ৬টি ও হজ্জ ফাইন্যান্সের ৩টি মিলিয়ে আরো ৯টি শাখা যোগ করতে হবে। আরো অনেক কনভেশনাল ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বা ইসলামি শাখা ও উইন্ডো খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক-এ আবেদন করে রেখেছে। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এ সংখ্যা ক্রমেই আরো বাড়বে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সর্বমোট ব্যাংকের ডিপোজিট হলো ৬লাখ ৯৯হাজার ১৮৩.৭০কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকসমূহের সর্বমোট ডিপোজিট ১লাখ ৫২হাজার ৪৪৮.৪৭কোটি টাকা। মোট ডিপোজিট সংগ্রহে ইসলামি ব্যাংকিং-এর অংশগ্রহণ ২১.৮০শতাংশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সকল ব্যাংকের বিনিয়োগ হলো ৭লাখ ৪৩হাজার ৫৬৫,৭০কোটি টাকা। মোট বিনিয়োগে ইসলামি ব্যাংকিং এর অংশগ্রহণ ১৭.৬৩শতাংশ, এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকসমূহের সর্বমোট বিনিয়োগ ১লাখ ৩১হাজার ৯০.৯১কোটি টাকা।
শরীয়াহ্ ভিত্তিক ব্যাংকিং কতটা শরীয়াহ্ কমপ্লায়েন্ট?
শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের মূল দর্শনটি হলো, পূর্বনির্ধারিত সুদে ঋণ দেয়ার বদলে গ্রাহকের প্রচেষ্টায় বিনিয়োগ করা। এখানে খুঁটিনাটি কমপ্লায়েন্সের অনেক ইস্যু থাকে। কিছু কমন চর্চা রয়েছে যেমন, ঋণের টাকা গ্রাহকের হাতে নগদ হিসেবে না দেয়া। এর বদলে তিনি যে পণ্য বা সেবাটি কেনার জন্য ব্যাংকের সাপোর্ট নিচ্ছেন, সরাসরি বিক্রেতার অনুকূলে এর দামটি পরিশোধ করে দেয়া।
এরপর পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা না দেয়াও একটি বেসিক চর্চা। আমরা হিসাব-নিকাশ করে একটি সম্ভাব্য মুনাফার হার ঘোষণা করি। বছর শেষে সেখান থেকে বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। আমাদের গ্রাহকদের প্রায় সবাই এ হ্রাস বৃদ্ধিকে স্বাগত জানান। হিসাব নিকাশ যত ভালো হবে, পূর্বপরিকল্পণার সঙ্গে বছর শেষে মুনাফার হারের ব্যবধান তত কম হবে।
গ্রহীতার বিনিয়োগ চাহিদা অনুযায়ী আমরা অর্থায়ন করে থাকি। যেমন আপনার গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, স্থাপনা, বিভিন্ন মেশিনারিজ বা বিভিন্ন ধরনের কনজুমার আইটেমের মালামাল দরকার। আপনার যা দরকার সেটা হালাল জিনিস হলে আমরা তা কিনে দেবো। তারপর আসল দামের সঙ্গে ন্যায্য মুনাফা যোগ করে সেটা এককালিন বা কিস্তিতে আদায়যোগ্য। মুশারাকা, মুদারাবা বা এজাতীয় পদ্ধতি ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে আমরা গ্রাহককে সরাসরি টাকা দিতে পারি না। কোন কিছু কেনার জন্যই অর্থায়ন বা বিনিয়োগ করতে পারি। এই বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা অর্জিত হয় তার বড় একটা অংশ চুক্তি অনুযায়ী সঞ্চয়কারী ও শেয়ারহোল্ডারগণের মধ্যে বন্টন করে থাকি।
শরীয়াহ্ বিধি নিষেধ সর্ব ক্ষেত্রে পরিপালন করে থাকি, তাই এই দাবি আমরা সঙ্গতভাবেই করতে পারি যে, আলহামদুলিল্লাহ আমরা শতভাগ শরীয়াহ্ সম্মত পন্থায় ব্যবসা করে যাচ্ছি। কখনও যদি কোন কর্মকর্তা বা গ্রাহকের ভুল ভ্রান্তির কারণে কোন আয় সন্দেহজনক বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটা কখনোই মূল আয়ে নেয়া হয় না। সেটা আইএফআইএল ফাউন্ডেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যার অর্থ দেশের দুস্থ জন মানুষের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
কোন প্রতিষ্ঠান কতটা শরীয়াহ্ কমপ্লায়েন্ট হবে, সেটি নির্ভর করে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকৌশলের উপর। ইসলামিক ফাইন্যান্সের শরীয়াহ্ বোর্ড কয়েকজন জ্ঞানীগুণী ইসলামী স্কলারদের সমন্বয়ে গঠিত এবং সম্পূর্ণ শরীয়াহ্ কমপ্লায়েন্ট। আমাদের প্রধান কার্যালয়সহ প্রতিটি শাখায় শরীয়াহ্র সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে বছরে কমপক্ষে একবার প্রশিক্ষন কর্মসূচীর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বার্ষিক প্রতিবেদনে (এসিআর) শরীয়াহ্ পরিপালনের উপর নাম্বারিং এর জন্য আলাদা অনুচ্ছেদ রয়েছে।
সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত এবং আর্থিক খাত
বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গভর্ণর মহোদয়ের সাথে মিটিং করে লিজিং প্রতিষ্ঠানের সংগঠন বিএলএফসিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কিছু কিছু ঋণ খাতে মুনাফা বা সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনবে। সরকারের ভিশন-২০২১ কার্যকর করতে গেলে কয়েকটি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানি, নারী উদ্যোক্তা, উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত এসএমই খাতের বিনিয়োগে মুনাফার হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমরাও একমত হয়েছি।
ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ চলতি ও স্থায়ী হিসাব খুলতে পারে না। ফলে নির্ভরশীল থাকতে হয় ব্যাংকগুলোর উপর। গ্রাহক ছাড়াও আমানতের একটি মূল উৎস হলো ব্যাংক ডিপোজিট এবং ব্যাংক ঋণ। সুতরাং ব্যাংকে যদি সুদহার কমে যায়, স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক খাতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংকের সুদহার কমলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আর্থিকখাতেও এই হার কমে আসবে।
সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসীত এবং কর্পোরেট সংস্থা থেকে বর্তমানে মোট ১৪ টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত নিতে পারে। ইসলামিক ফাইন্যান্স এগুলোর মধ্যে একটি। এ তহবিলের প্রবাহটা নিশ্চিত করতে পারলে চলমান সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো বলে মনে করছি।
এনবিএফআইয়ের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ:
আইনি কাঠামোতেই দেখবেন, এনবিএফআইয়ের তহবিলের উৎস ব্যাংকের চেয়ে কম। এর ওপর বড় আমানতকারীদের একটি বড় অংশই আবার তালিকাভুক্ত ব্যাংক ছাড়া আমানত রাখার ব্যাপারে অনীহা দেখান, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা। অর্থ মন্ত্রণালয় ইসলামিক ফিন্যান্সসহ এক ডজনের বেশি এনবিএফআইকে সরকারি আমানত গ্রহণের যোগ্য হিসেবে একটি তালিকা করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, সব মানদণ্ডে যোগ্য হওয়ার পরও এনবিএফআইগুলো সরকারি তহবিল পাচ্ছে না।
অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টিও এনবিএফআইয়ের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ। আমানতের জন্য এনবিএফআইকে ব্যাংকের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। আবার তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই ব্যবসা করতে হয়। নীতিনির্ধারকরা এক্ষেত্রে কিছু ব্যবসা শুধু এনবিএফআইগুলোর জন্যই নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন। কারণ এগুলোই তাদের স্পেশালাইজেশন। ব্যাংকের অনেক অনেক ব্যবসার মধ্যে এমন ছোটখাটো কয়েকটি হাতছাড়া হলে কিছুই হবে না। যেমন, লিজিং।
ব্যাংকারদের কাছে প্রত্যাশা:
ব্যাংকারদের কাছ থেকে আশা করতে পারেন, সম্ভাবনাময় উদ্যোগে তাদের আর্থিক সমর্থন। উন্নয়নের রূপরেখার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়ে সময়ে আমাদের বিভিন্ন গাইডলাইন ও নির্দেশনা দিয়ে আসছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও অগ্রাধিকারমূলক খাতে অর্থসংস্থানে এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকার হিসেবে আমাদেরও উচিত সম্ভাবনাময়, সৎ, পরিশ্রমী উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেয়া। এগুলোর ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ অনেক। তার পরও ক্রিয়েটিভ উপায় খুঁজে বের করে কাজটি করতে হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রত্যাশা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা নারী উদ্যোক্তা, কৃষি ও উৎপাদনশীল খাতে স্বল্প মুনাফায় বিনিয়োগ করছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে আমানত ও ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন আমাদেরকে সহযোগীতা করে। সরকারী আমানত পাওয়াটা যেন সহজসাধ্য হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং আইন এখনও বলবৎ হয়নি। আমরা কল মানি মার্কেট থেকে টাকা নিতে পারি না। দেশে শরীয়াহ্ ভিত্তিক ৮ টি ব্যাংক ও ২ টি এনবিএফআই আছে। শরীয়াহ্ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃবাজার সম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। এতে আমরা কলমানি বাজারের মতো স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজনে পরস্পরের কাছ থেকে আন্তঃপ্রতিষ্ঠান লেনদেন করতে পারব।
তৃতীয়ত: বন্ড বাজারটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। ইসলামী বন্ড (সুকুক) যদি আমরা বাজারে আনতে পারি, সেটাও আমাদের পুঁজি গঠনে এবং দৈনন্দিন কাজের সমাধানের জন্য অনেক উপকারে আসবে।
আইএফআইএল’র সার্বিক অবস্থা ও পরিকল্পনা:
ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড (আইএফআইএল) দেশের প্রথম ও শীর্ষ শরীয়াহ্ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ’এ’ ক্যাটাগরির একটি কোম্পানি। পোর্টফোলিও সাইজ, প্রবৃদ্ধি, আয় ও মুনাফায় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান মাঝামাঝি সারিতে। তবে স্থিতিশীলতায় ও ধারাবাহিকতায় বেশ এগিয়ে।
আরেকটি বিষয়, ইসলামিক ফাইন্যান্স এর কিছু ইউনিক অফার রয়েছে, যেগুলো এর গ্রাহকরা বেশ অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। উদাহরন হিসেবে ধরতে পারেন, আপনি আমাদের এখানে ১ লাখ টাকা আমানত রাখলেন। এর বিপরীতে আমাদের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা আবার ঋণ হিসেবে নিলেন। অন্য জায়গায় আমানত ও ঋণের সুদহারে একটি ব্যবধান থাকে, যার ভিত্তিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আপনাকে একদিকে সুদ বা মুনাফা দেয়, অন্যদিকে তা চার্জ করে। আমরা ১ লাখ থেকে ৮০ হাজার বাদ দিয়ে শুধু ২০ হাজার টাকার ওপর আপনাকে মুনাফা দেব। হিসাব করে দেখবেন, আমাদের এখানে আপনি বেশি মুনাফা পাচ্ছেন।
ম্যানুফ্যাকচারিং বা সেবায় আমাদের অর্থায়নের কৌশলটিও পরিশ্রমী ব্যবসায়ীরা পছন্দ করেন। ধর্মীয় কারণে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছে শরীয়াহ্ভিত্তিক ফাইন্যান্সের আবেদন রয়েছে। এছাড়া আমাদের পণ্য ও সেবাগুলোয় কিছু সুবিধা রয়েছে, যেটি অন্য ধর্মের গ্রাহকরাও পছন্দ করেন। আমাদের অমুসলিম গ্রাহকও রয়েছেন।
আইএফআইএল শরীয়াহ্ নির্দেশিত মুদারাবা পদ্ধতিতে সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করে এবং ব্যবসায়ের ধরণ বুঝে শরীয়াহ্ অনুমোদিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে থাকে।
ব্যবসার আকার ও কলেবর বাড়ানোর সুযোগ আছে। বর্তমান পোর্টফোলিওকে আমরা দু-তিন বছরের মধ্যে ৩ গুন উন্নীত করতে চাই। এ বছরে একটি নতুন শাখাসহ বর্তমানে শাখা রয়েছে সাতটি, তিনটি ঢাকায়, চারটি ঢাকার বইরে। প্রতি বছর আমরা তিন-চরটি শাখা স্থাপন করব। বিগত বছরগুলোয় ইসলামিক ফাইন্যান্স একটি গড়পড়তা প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়েছে। আগামীতে আমরা সম্প্রসারণ ও প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্ব বাড়াব। পণ্য ও সেবাগুলো সম্পর্কে আরো বেশি মানুষকে জানাতে পারলে ইসলামিক ফাইন্যান্সের ব্যবসা অনেক বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য আমরা ব্রান্ডিং এর উপর গুরূত্ব দিচ্ছি। পাশাপাশি আরো নতুন কি কি পণ্য ও সেবা চালু করা যায়, এ নিয়েও কাজ করছি আমরা। প্রতিটিই হবে শরীয়াহ্ কমপ্লায়েন্ট। মানবসম্পদ উন্নয়নেও আমরা জোর দিচ্ছি। বিভিন্ন স্থানে নতুন দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হচ্ছে, যারা টিমে যোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবেন। দেখুন, সম্ভাবনাময় ও ভালো উদ্যোগে আর্থিক সমর্থন দেয়া যেমন ব্যাংকারের কাজ, আবার সে ঋণ বা বিনিয়োগের রিটার্নটি নিশ্চিত করে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষা করাও তার দায়িত্ব।
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলাতে আমরা কিছু নতুন আমানত পণ্য নিয়ে ভাবছি। ইতিমধ্যে নতুন কিছু আমানত পণ্যের ডিজাইন করা হয়েছে। সেগুলো প্রথমে প্রতিষ্ঠানের শরিয়াহ কাউন্সিলের কাছে উপস্থাপন করা হবে। শরিয়াহ কাউন্সিল অনুমোদন করলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে বাজারে ছাড়া হবে। বর্তমানে অধিকাংশ আমানত স্বল্পমেয়াদি। তিন মাস, ছয় মাস বা এক বছর মেয়াদি আমানতই বেশি। কিন্তু বিনিয়োগ হয় দীর্ঘ মেয়াদে। এ জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি আমানতের জন্য কিছু বিশেষ প্রকল্প নিচ্ছি। মাসিক সঞ্চয়ের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের দোড়গোড়ায় শরীয়াহ্ভিত্তিক আর্থিক সেবা পৌঁছে দিতে চাই। এজন্য ঢাকার বাইরের যেসব জেলায় আমাদের শাখা নেই, সেখানে আমাদের শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চাই।
আইএফআইএল’র আর্থিক বিশ্লেষণ:
ইসলামিক ফাইন্যান্স ঢাকা ও চট্রগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেই ‘এ’ ক্যাটাগরিতে আছে। ক্রেডিট রেটিংয়ে আমরা স্বল্প মেয়াদে এসটি-২, দীর্ঘ মেয়াদে ‘পজিটিভ’ এবং ক্যারেন্ট রেটিংয়ে ‘এ’ অবস্থানে। ২০১৫ তে ১৩শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, ২০১৬ তে ১১শতাংশ স্টক ও ৩শতাংশ নগদ লভ্যাংশ এবং গত বছর সাড়ে ১৪শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে। অতএব বলা যায় প্রবৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারনসহ সকল ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। ব্যবসার আকার ও কলেবর দুটোই বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, শরীয়াহ্ ভিত্তিক নতুন পণ্য ও সেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আগামীতে আরও ভাল করবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেজন্য নতুন করে কর্মকৌশল ঠিক করা হচ্ছে যাতে করে আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রথম দুই বা তিনটি এনবিএফআই’র মধ্যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ‘এশিয়ান ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের’ বিবেচনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সেরা এনবিএফআই নির্বাচিত হয়েছিল ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড। ব্যাংক ক্যাটাগরিতে ব্যাংক এশিয়া। বিশ্বের সেরা চারটি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং কনসালট্যান্ট ফার্ম তথা ইঅ্যান্ডওয়াই, ডিলয়েটে, পিডব্লিউসি এবং কেপিএমজি বাছাই, মনোনয়ন ও মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। তারা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসলামিক ফাইন্যান্সের আর্থিক খুটিনাটি, পণ্য, সেবা, গ্রাহক ভিত্তি, স্থিতিশীলতা ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনা করেছে।
সবশেষে বলতে চাই
সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমাদের অনুরোধ সরকারি, আধা-সরকররি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন ও সরকারি ব্যাংকের আমানত রাখার বিষয়ে সুষম বন্টন নিশ্চিত করার জন্য অর্থ্যাৎ আমরা যারা সকল যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর মত সরকারি ফান্ড (৫০% পর্যন্ত) পাওয়ার যোগ্য তারা যেন তা পেতে পারি। বাংলাদেশ একটা অমিত সম্ভাবনার দেশ। আমাদের নির্মাণাধীন বৃহৎ প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করতে পারলে, অল্প সময়ের মধ্যেই একটা উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবো। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই ইতিবাচক। একটা স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়ন আমরা বজায় রেখেছি। এ অবস্থায় আর্থিক খাতের জন্য সুশাসন খুব জরুরি। দক্ষতার সঙ্গে সততা ও নৈতিকতা না থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। এ বিষয়ে আপসহীন মনোভাব থাকা জরুরি। আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে আগামী দিনগুলোতে আরো অনেক ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আইএফআইএল আগামী দিনে আরও অনেক সমৃদ্ধ হবে এবং সর্বক্ষেত্রে বিকাশ লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।
এ জেড এম সালেহ্
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড