শেরীফ এম এ রহমান : আমাদের দেশের অর্থনীতির বয়স অনেক কম এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। সব সময় উন্নত দেশের সাথে তুলনা করলে হবেনা। আমরা যদি দেখি আমাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন জিডিপিতে যে জায়গায় আছে ভারতে তা অনেকগুন বেশি প্রায় ৮০ শতাংশ, মালয়েশিয়াতে একশত ৫০ শতাংশ, আমেরিকায় তিনশত থেকে সাড়ে তিনশত শতাংশ। নিঃস্বন্দেহে এই দেশগুলোর অর্থনিতির সাইজ অনেক বড়। এইসব দেশের মানুষ শিল্পায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাজারে যায়। দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজার উত্তম।
আমাদের দেশের সরকার এবারেরে মুদ্রানীতিতে ব্যাংকগুলোকে বলেছে যারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ চাইবে তাদের জন্য পুঁজিবাজারে যাওয়া ভালো। যেহেতু আমাদের দেশের অর্থনীতির ইতিহাসটা বেশি দিনের না, তাই আমাদের দেশে মুখে মুখে কিছু উদ্যোক্তা তৈরী হয়েছে। আমাদের দেশে ফার্স্ট জেনারেশন এন্টারপ্রেনারশীপ গ্রো করেছে, তারপর সেকেন্ড জেনারেশন আসবে। একটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে অনেক সময় লাগে।
আমরা ইউরোপে দেখি একটা ইন্ডাস্ট্রির বয়স একশত থেকে দেড়শ বছর। ভারতের টাটা কোম্পানি প্রজম্মের পর প্রজন্ম চলছে কিভাবে? একটা শিল্প বা এন্টারপ্রেনারশীপ স্কিল গ্রো করতে সময় লাগে। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রাখতে হবে, শুধু তুলনা করলে হবে না। যদি এই বিষয়গুলোকে মাথায় রাখি, তবে দেখতে পাই আমাদের দেশেও কিছু ব্র্যান্ডেড কোম্পানী দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন বিকাশের মত ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে কিছু কোম্পানী ব্যাংকের লোন ছাড়াই দাঁড়িয়ে গেছে। আশানুরুপ জায়গায় যেতে হয়তো একটু সময় লাগবে।
আমরা যদি এখন পুঁজিবাজারের কথা বলি তবে প্রথমেই বলতে হয় পুঁজিবাজারে যাওয়ার বেনিফিট সম্পর্কে আমাদের দেশের কোম্পানির মালিকরা এখনও সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। মালিকরা তার নিয়ন্ত্রনের কথা চিন্তা করছে, ব্যাংক থেকে সহজে টাকা পাওয়া যাচ্ছে, বা সহজে টাকা পেলেও এই যে কস্ট বেনিফিট এনালাইসিস আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এখনও কালচারে ডেভেলপ করেনি। আজকে আমাদের ধর্মে বলে সুদ হারাম। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই তাদের কোথাও কিন্তু লোন নাই। তাদের কোথাও লোন থাকলে কোন প্রজেক্টে যাওয়ার আগে লোন পরিশোধ করে। আমরা লাফার্জের রাইট ইস্যুটার প্রথমটার দিকে তাকালে দেখতে পাই ইন্ডিয়ার সাথে একটা বিষয়ে কনফ্লিক্ট থাকায় চার-পাঁচ বছর প্রজেক্ট বন্ধ ছিল। কারণ তাদের লোকাল কিছু লোন ছিল, তারা প্রথমেই রাইটের টাকা দিয়ে লোন পরিশোধ করেছে। চাইলেই পারতো লোনের টাকা পরিশোধ না করে আরেকটা প্রজেক্টে যেতে কিন্তু তারা খরচ কমানোর জন্য আগে লোন পরিশোধ করেছে।
যেকোন ব্যাবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কস্ট আর কস্ট এর কথা চিন্তা করলে অবশ্যই পুঁজিবাজারে আসতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য। পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করে তাদেরকে সুদ দিতে হয়না। ফলে চিন্তামুক্তভাবে ব্যাবসা পরিচালনা করা যায় যেমন একটা ৫ শত কোটি টাকার প্রজেক্টে যদি ৪ শত কোটি টাকা ব্যাংকের লোন থাকে তবে প্রজেক্টটি দাঁড়াতে অন্তত ৪ বা ৫ বছর সময় লাগলে ব্যাংকের সুদ দিতে দিতেই কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায়। তাই মূলধন সংগ্রহে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসবে এবং এখন অনেকেই আসছে।
পুঁজিবাজারে আসার ভেল্যুয়েশনটা যারা বুঝে তারা ঠিকই আসবে। গুডউইলের ভেল্যুয়েশনটা কোথায়? এটা আসলে দেখা যায়না। পুঁজিবাজারে আসলে কোম্পানির গুডউইল বাড়ে, ব্র্যান্ডের ভেল্যু বাড়ে, জবাবদিহি বাড়ে, কর্পোরেট গভর্নেন্স থাকে, পুঁজিবাজারে আসলে কোন কোম্পানি দেউলিয়া হয়না, বেঁচে থাকে অনন্তকাল, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকলে মূল মালিক না থাকলেও কোম্পানি চলে নিজস্ব গতিতেই। আমাদের দেশেও এমন অনেক কোম্পানি আছে যাদের মূল মালিক মৃত্যুর পরও কোম্পানি শুধু মাত্র কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকার কারনে এখনও সুনামের সাথেই চলছে।
আমরা জাপানের টয়োটা কোম্পানির দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাই মূল মালিকদের শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশ। তারপরও তারা কোম্পানি পরিচালনা করছে, শুধু মাত্র কোম্পানির সব শেয়ার থাকলেই তাদের নিয়ন্ত্রন থাকবে বিষয়টা এমন নয়। এই বিষয়গুলো আমাদের দেশের কোম্পানির মালিকরা বুঝতে আরো সময় লাগবে। শুধু বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলেই হবেনা। যারা পুঁজিবাজারে আসবে তাদেরও এই মানসিকতা থাকতে হবে বা এই মানসিকতার লোকজন আসতে হবে পুঁজিবাজারে।
অনেকেরই ধারনা পুঁজিবাজারে আসলে কোম্পানির লভ্যাংশের ভাগ অন্যকে দিতে হবে। আসলে এটা হয়তো জানেনা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিটি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। তালিকাভুক্ত হলে আন্তর্জাতিক বাজারেও বিচরণ করতে পারে খুব সহজেই। বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রশ্নের মাধ্যমে অনেক ভুল উঠে আসবে, ফলে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে সুবিধা হবে। তাই এখন কিছু কিছু ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে।
পুঁজিবাজারে আমাদের দেশের মানুষের কিছু ভুল রয়েছে। যেমন আমরা ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনতে চাইনা, কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে নিচ্ছে, তারা অনেক কোম্পানির শেয়ার কিনা শুরু করেছে সাত শত টাকা থেকে এবং এখনও সেই শেয়ার কিনছে তিন হাজার টাকায়।
তবে সব কিছু সময়ের ব্যাপার, কারণ আমাদের স্ট্র্যটেজিক পার্টনার হচ্ছে সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে চায়না এবং ভারতের আগ্রহ দেখে বুঝা যাচ্ছে আমাদের মার্কেটের গুরুত্ব বা ভবিষ্যত কতটা সম্ভাবনাময়। আমাদের দেশের প্রতি বিদেশিদের অনেক আগ্রহ, তারা জানে আমাদের শক্তি সম্পর্কে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে। আমাদের দেশের মানুষকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে বুঝাতে হবে।
আমাদের পুঁজিবাজার এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে, তবে এই সেক্টর অনেক অনেক দক্ষ লোকবলের দরকার রয়েছে। কারণ আমাদের অনেক দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে এই সেক্টরে। পৃথিবীতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে ক্যারিয়ারের চাহিদা এবং গুরুত্ব অনেক। আমাদের এই সেক্টরে মেধাবী জনশক্তির অভাব রয়েছে।
তবে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সততা, যেখানে আমরা ব্র্যাক ইপিএল অনেক এগিয়ে। যার কারনে ব্র্যাক আজকে একটা ভালো ব্রান্ডের মূল্য অর্জন করছে। এই সেক্টরটা চ্যালেঞ্জের তাই এটা ক্যারিয়ার হিসেবেও প্রথমে রয়েছে। আর চ্যাওলেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য দরকার তরুণদের এগিয়ে আসার। তবে সামনে আমাদের পুঁজিবাজার অনেক সম্ভাবনাময়।
শেরীফ এম এ রহমান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড