অগ্নি দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি কমায় বীমা পলিসি

সম্প্রতি বড় বড় বিল্ডিংয়ে বা মার্কেটে আগুন লাগার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এসব অগ্নিকান্ডে প্রাণহানীর ঘটনা যেমন ঘটছে, আবার প্রচুর সম্পদেরও ক্ষতি হচ্ছে। অনেকেই সব হারিয়ে নিশ্ব হয়ে পথে বসছেন। অথচ বীমা জগতে এর সমাধান না থাকলেও ক্ষতি বিশেষ করে আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা রয়েছে। যেটাকে আমরা ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ বলি। যদি কোন ব্যক্তির সম্পত্তি আগুনে পুড়ে যায়, তাহলে সেটার কভারেজ করার দায়িত্ব ইন্সুরেন্স কোম্পানির, এমন আইন বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে। আমাদের বাংলাদেশেও এই আইন রয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলোর সম্পত্তি আগুনে পুড়ে যাওয়ার কভারেজের জন্য ইন্সুরেন্স খুবই জরুরী। এখন আমাদের দেশে যাদের সম্পত্তি আগুনে পুড়ে গেছে বা যাচ্ছে, তাদের অনেকেরই কোন ইন্সুরেন্স কভারেজ দেওয়া নাই। তারা যদি ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ পলিসি কি, কেন করতে হয়, আর এতে কতটুকু বাৎসরিক প্রিমিয়াম হয়, এসমস্ত বিষয়গুলো জেনে কভারেজ দিত, তাহলে তাদের সম্পত্তি যখন আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তখন ইন্সুরেন্স তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিতে দিত।

একটা বিল্ডিংয়ের পুরোটা অংশের রিস্ক কভারেজ ইন্সুরেন্সে দেয়া যায়। বিল্ডিংয়ের লিফট, জেনারেটর এবং স্ট্রাকচারের পুরোটা অংশের রিস্ক, ইন্সুরেন্স কভারেজ করতে পারে। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের ভিতরের আসবাবপত্র, ইকুইপমেন্ট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফার্নিচার এবং বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতির রিক্স কভারেজ দেওয়া যায়। এগুলো পৃথক পৃথক ভাবেও কভারেজ দেয়া যায়। আবার পুরো বিল্ডিংয়ের একত্রে কভারেজ দেয়া যায়। এমনকি একেকটা ফ্লোরেরও পৃথকভাবে দেয়া যায়। যেকোনো ক্ষুদ্র মালিকপক্ষও পৃথকভাবে ইন্সুরেন্সের এই পলিসি নিতে পারেন। সুতরাং আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সব ধরণের স্ট্রাকচার আগুনে পুড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ রিস্ক বহন করতে পারে।

যদি কোন বিল্ডিংয়ের শুধুমাত্র স্টাকচারের ইন্সুরেন্স রিস্ক কভারেজ করা থাকে তবে বিল্ডিংয়ের যেসব ক্ষতি হবে সেগুলোর কভারেজ দেয়া হবে। এক্ষেত্রে ভিতরের আসবাবপত্র বা অন্যান্য ইকুইপমেন্টের কভারেজ তাকে দেয়া হবে না। পলিসিতে সিডিউল করা থাকে যে, এই পলিসিতে যে অংশটুকু ইনক্লুডিং করা থাকবে, কেবলমাত্র সেই অংশটুকুর কভারেজ ইন্সুরেন্স দিবে। যদি বিল্ডিংয়ের সাথে অন্য কোন অংশের কভারেজ দিতে চায় সেটার জন্যও আলাদা সিডিউল থাকবে। এমনকি কোন গোডাউন বা স্টককেও পলিসিতে নেয়া যায়।
একটা বিল্ডিংয়ের যেকোনো ইকুইপমেন্টের যখন কভারেজ দেয়া হয়, তখন আমাদের সাম ইন শিওরড্ কাউন্ট করা থাকে। মনে করেন, পুরো বিল্ডিংয়ের সাম ইন শিওরড-এ দশ কোটি (লিফটের জন্য ৫ কোটি, জেনারেটরের জন্য ২ কোটি এবং অন্যান্য ইকুইপমেন্টের জন্য ৩ কোটি) টাকা কভারেজ দিলেন। এখন এই সাম ইন শিওরড-এর মধ্যেই কিন্তু আপনার লসের লিমিটেশন থাকবে। এখন পাঁচ কোটি টাকার লিফট নষ্ট হলে, আমরা আপনাকে পাঁচ কোটি টাকা দামের লিফট দেব। কিন্তু আপনি যদি দশ কোটি টাকা দামের উন্নত মানের লিফট ব্যবহার করতে চান, তবে আপনাকে অতিরিক্ত টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ যতটুকু আপনার পলিসিতে থাকবে, আপনি ঠিক ততটুকুই পাবেন। আরেকটা ভালো দিক হলো, আপনার বিল্ডিংয়ের যে রেন্টাল ইনকাম হয়, তাতে একটা ট্যাক্স আছে, কিন্তু ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’র জন্য আপনি যতটুকু প্রিমিয়াম দিবেন তাতে আপনার ইনকাম ট্যাক্সের রিবেট সুবিধা পেয়ে যাবেন।

প্রিমিয়ামের হিসাবকে আমরা আন্ডার রাইট ক্যালকুলেশন বলি। ভ্যালু, ম্যাটেরিয়াল, সাম ইন শিওরড’র উপর নির্ভর করে এটার ক্যালকুলেশন হয়ে থাকে। ম্যাটেরিয়ালটা কোন ধরণের, বিল্ডিংটা কোন শ্রেণীর, এসব বিষয়গুলোর উপর আন্ডার রাইট ক্যালকুলেশন করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়। মনে করেন, একটা বিল্ডিংয়ের দাম হচ্ছে দু’শ কোটি টাকা। এখানে বাৎসরিক প্রিমিয়াম হয় প্রায় ষাট লক্ষ টাকা। এখন এই ষাট লক্ষ টাকা দিয়ে কিন্তু আপনি পুরো বিল্ডিংয়ের, অর্থাৎ দু’শ কোটি টাকার রিস্ক কভারেজ করতে পারছেন ইন্সুরেন্স পলিসিতে।

প্রিমিয়ামের মাত্রা যে খুব বেশি, বিষয়টা ঠিক এমন না। এটা আন্ডার রাইটের উপর নির্ভর করে। যত বেশি দামি জিনিস হবে, প্রিমিয়ামের মাত্রা তত বেশি হবে। আবার কম হলে প্রিমিয়ামের মাত্রাও কম হবে। সুতরাং প্রিমিয়ামকে আন্ডার রাইট ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

আসলে আমাদের ইন্সুরেন্স পোর্টফোলিও খুবই ছোট। যত বেশি ইন্সুরেন্স করানো যাবে আমাদের ইন্সুরেন্স পোর্টফোলিওটাও তত বড় হবে। ইন্সুরেন্স প্রিমিয়ামের মাত্রাটাও তখন ছোট হয়ে আসবে। কিন্তু আমাদের ইন্সুরেন্স বাজারটা অনেক ছোট হওয়ার কারণে প্রিমিয়াম রেটটা একটু বেশি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সাধারণ জনগনের মধ্যে যদি সচেতনা বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের ইন্সুরেন্স মার্কেটা বড় করা সম্ভব। আর মার্কেট যত বেশি বড় হবে, প্রিমিয়ামের মাত্রাটা তত কমে আসবে।

বাহিরের দেশগুলোতেও দেখা যায়, যাদের যত বেশি ইন্সুরেন্স রয়েছে, তাদের প্রিমিয়ামের মাত্রাটা তত কমে যাচ্ছে। এজন্য প্রথমে আমাদের ইন্সুরেন্সের পোর্টফোলিওটা বড় করতে হবে, যেন সবাই এই ইন্সুরেন্সের আওতার মধ্যে আসতে পারে। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়তে হবে। আমাদের জনগণ ভাবে যে, কেন তার ইন্সুরেন্স করে অতিরিক্ত টাকা এখানে দিবে? কিন্তু আমরা যে তাদের টাকার রিস্কটা নিচ্ছি, সেটা তারা বুঝতে চায় না।

উদাহরনস্বরুপ- একজন স্বল্প মুলধনি ব্যবসায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে কোন ব্যবসা শুরু করলো। এখন যদি তার পুরো মুলধনই আগুন লেগে পুড়ে যায়, সেটার রিস্ক ইন্সুরেন্স নিবে। যদি সে তার পাঁচ লাখ টাকার ব্যবসার উপর একটা প্রিমিয়াম দেয়। এক্ষেত্রে তার বাৎসরিক ৮-১০ হাজার টাকার মত প্রিমিয়াম আসতে পারে। সেটা কিন্তু তার ব্যবসার জন্য সামান্য একটা অংশ হবে। হয়তো তার লাভের দুই-এক শতাংশ হবে। এখন সে যদি এই প্রিমিয়ামের টাকাটা দিয়ে রাখতো তাহলে তার মুলধন হারাতে হত না। সে পুনরায় তার মুলধন ইন্সুরেন্স থেকে পেয়ে যেত।

সুতরাং এদেরকে যদি আমরা ইন্সুরেন্স কভারেজের মধ্যে নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে আমাদের নিঃস্ব হওয়ার ভয়টা থাকতো না। তারা রিস্ক ফ্রি থাকতে পারতো। আকেরটা বিষয় হচ্ছে ইন্সুরেন্স কভারেজের বিষয়টা আমাদের দেশে এখনও সতস্ফুর্ত হয়নি। আমি মনে করি, গাড়ির ইন্সুরেন্সটা আমাদের দেশে যেমন বাধ্যতামুলক রয়েছে, তেমনিভাবে আমরা যদি আরও কয়েকটা বিষয়ের উপর ইন্সুরেন্স বাধ্যতামূলক করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের মানুষের সচেতনতা এবং ইন্সুরেন্সের উপর আস্থা বাড়বে। যেমন- বিল্ডিং কোডের মধ্যে যদি বলা হয় যে, ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। আবার রাস্তার পাশের ক্ষুদ্র (দোকানদার) ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইনসেন্স দেয়ার সময় প্রতি বছরের ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ নেয়ার বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে ‘ফায়ার ইন্সুরেন্স’ কভারেজ দেয়ার কিছুটা নিয়ম বিজিএমইএ’র মাধ্যামে করা হয়েছে। আমার মনে হয়, এটাকে আরও একটু প্রসারিত করা উচিত। এটারই পুরোটাই যেন কভারেজ দেয়া থাকে, সেটা নিশ্চিত করা উচিত। ফ্যাক্টরি, শ্রমিক এবং ভিতরে আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতিসহ সবটাই যেন কভারেজ দেয়া থাকে সেটার উপর জোর দেয়া দরকার। এই ধরণের কিছু পরিবর্তন আনতে পারলে আমার মনে হয় আমাদের ইন্সুরেন্সের উপর জনগনের সচেতনতা বাড়বে। এজন্য ইন্সুরেন্স কোম্পানিরও বেশি বেশি প্রচার করা এবং জনগনকে সচেতন করার দায়িত্ব রয়েছে।

সর্বশেষে আগুনে পুড়ে যাদের সম্পদ নষ্ট হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো, আসুন আমরা ইন্সুরেন্সের ছায়াতলে এসে নিজের সম্পদকে রিস্কমুক্ত করি এবং নিশ্চিন্তে ব্যবসার সম্প্রসারন করি।

মো. শফিকুল ইসলাম
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিএফও, প্রগতি ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড