অপরিকল্পিত উন্নয়নে হারিয়ে যাওয়ার পথে বেরুলা খাল

বেরুলা খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ফতেপুর গ্রাম থেকে শুরু হয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী গিয়ে মিশেছে খালটি। তবে অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে শত বছরের প্রাচীন এ খালটি।

এরই মধ্যে কোথাও কোথাও আংশিক ভরাট করা হয়েছে। খালের ওপর দোকান ও বাড়ি বানানো হয়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে চার লেন নির্মাণ কাজের জন্য খালটির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সড়ক বড় করতে গিয়ে খালটির অধিকাংশ অংশ ভরাট করে ফেলায় খালটি এখন কোথাও কোথাও ড্রেনে পরিণত হয়েছে। লাকসাম পৌরসভার দক্ষিণের বাতাবাড়িয়া ও ভাটিয়াভিটায় পুরো খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এতে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। সেচ সংকটে পড়েছে কৃষি জমি। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক মাছের উৎস। খালটি পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেলে কুমিল্লা জেলার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি ও বেগমগঞ্জ উপজেলার তিন সহস্রাধিক একর কৃষি জমির উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হবে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, অতীতে এ খাল দিয়ে নৌকা করে নোয়াখালী থেকে লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারে মালামাল আনা-নেয়া করা হতো। পালতোলা নৌকা করে পার হয়ে যাওয়া মাঝির কণ্ঠের সুর ভেসে আসতো। খাল থেকে পানি নিতে আসা ঘোমটা দেয়া গাঁয়ের বধূরা কান পেতে শুনতেন সে গান। খালের পানিতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন স্থানীয় জেলেরা। তবে দখলে ও অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণের কারণে খালের নৌপথ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে খননের অভাবে খাল এখন ড্রেনে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করা হয়েছে চার লেনের রাস্তার কাজ করতে গিয়ে। রাস্তার উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে খালটি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। ফলে সামনের বছরগুলোতে ফসল ফলানো নিয়ে চিন্তিত ওই এলাকার কৃষকরা।

এদিকে, সড়কের অন্যপাশে জায়গা থাকলেও প্রভাবশালীদের কারণে খাল ভরাট করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।

বেরুলা খালের সাথে কুমিল্লার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি ও বেগমগঞ্জের বিভিন্ন শাখা খালের সংযোগ রয়েছে। এ খাল ভরাট হয়ে গেলে জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে লাকসাম উপজেলার উত্তরদা, আজগরা, মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা, নাথেরপেটুয়া, বিপুলাসার ও নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি ও বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন।

মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৭৮ সালের দিকে খালটি স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সংস্কার করা হয়। খালটি দিয়ে নোয়াখালী থেকে নৌকা করে লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারে মালামাল আনা-নেয়া করা হতো। খালটি ভরাট হয়ে গেলে এ অঞ্চলের মানুষ জলাদ্ধতার কবলে পড়বে। সেচ সংকটে পড়বে ওই এলাকার কৃষি জমি।

লাকসামের প্রবীণ সাংবাদিক মজিবুর রহমান দুলাল বলেন, ‘খালের জমির মালিকানা কার সেটি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তবে খালের জমি যারই হোক না কেন তা ভরাট করা যাবে না। এতে এ এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।’

লাকসাম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম সাইফুল আলম বলেন, ‘খালের মালিকানা সড়ক ও জনপদ বিভাগের। সেখানে খাল ভরাট করে তারা চার লেন সড়ক উন্নয়নের কাজ করছেন। এ নিয়ে আমাদের কিছু বলার সুযোগ নেই।’

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি সেচ) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কৃষিকে বাঁচাতে প্রবাহমান খালের বিকল্প নেই। বিষয়টি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখবো।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খাল ভরাট করা বেআইনি। সেটা যে সংস্থাই করুক। পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষিকে বাঁচাতে নদী-খাল রক্ষা করতে হবে।’

তবে খাল ভরাটের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মো. আহাদ উল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো। প্রয়োজনে খাল ভরাট করেই কাজ করতে হবে।’