আইসিটি খাতের বিকাশে দেশীয় কনটেন্ট দরকার

রায়ানস আর্কাইভ। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম ডিজিটাল ডেটা সংগ্রহশালা। এ ধরনের সংগ্রহশালা বিদেশেও খুব একটা দেখা যায় না। আর্কাইভটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ হাসান তথ্যপ্রযুক্তির পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি, কনটেন্ট অ্যানালাইসিস, ডেটা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তাঁর এই আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর ভাষায় পাঠকদের জন্য ছাপা হলো।

প্রথমেই যদি আইসিটি সেক্টর নিয়ে বলতে চাই, বলতে হবে আমদের আইসিটি এগিয়ে যাচ্ছে। আইসিটি খাতে বেশ পজিটিভ পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো না কোনোভাবে বেশি মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির এক্সেস আছে। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন কিংবা পুশ বাটন ফোনের মাধ্যমেও মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্কের ভেতরের অংশ হয়ে আছে। এটা কিন্তু বড় একটা ত্রে, আর এই ত্রেটা কিন্তু হয়ে গেছে। এখন এটা কতটুকু সফল, কতটুকু নিরবচ্ছিন্ন আছে, কতটুকু ভালো আছে, কতটুকু গতি আছে, এটা নিয়ে আলোচনা থাকতে পারে; আরও কতটা ভালো করা যেতে পারে, এটা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
ব্রডব্যান্ড না মোবাইল
সাধারণ মানুষ হিসেবে রাস্তায় চলতে গেলে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের চেয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক বেশি প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা যখন রাস্তায় চলি, তখন আমার একটা দিনের তথ্যপ্রযুক্তি যেটুকু দরকার, সেটুকু আমি পাচ্ছি কি না, সেটাই বিবেচ্য। আমি যখন কোথাও যাচ্ছি, তখন ইন্টারনেট থেকে কোনো একটা খাবারের দোকানের মেন্যুর খোঁজ নিতে পারছি। কোনো একটা জিনিস কিনতে যাব, তখন আমি মোবাইল থেকে হেল্প নিতে পারি, হাসপাতালের বিভিন্ন ডাক্তারের তথ্য আমি ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছি। আমি মোবাইল থেকেই বিমানের ফাইটের টাইম শিডিউল জেনে নিতে পারি, যাত্রা কতটুকু বিলম্ব হবে তা জানতে পারি। তথ্যপ্রযুক্তির এক্সেস বলতে এগুলোই বুঝি। এর জন্য বিশাল ব্যান্ডউইটথ প্রয়োজন হয় না। তবে হ্যাঁ, আরেকটু ফাস্ট হলে তো ভালোই। কিন্তু যারা এসে ডেটা জোগান দেবে, তাদের জন্য বিশাল ব্যান্ডউইটথ দরকার। এখানে নানা সমস্যা আছে। সে কারণেই আন্তর্জাতিক কন্টেট চাইলেই আমি পেতে পারি, অথচ আমার প্রয়োজনীয় দেশীয় কনটেন্ট পাই না। অর্থাৎ আমাদের দেশীয় কনটেন্টের ঘাটতি আছে। এটার উন্নতি করতে নেটওয়ার্ক গতিশীল করতে হবে। তবে পাশাপাশি বিজনেস মডেলও থাকতে হবে। চাইলে রাজশাহীর সব ফল ব্যবসায়ী তাদের সব তথ্য দিতে প্রস্তুত। কিন্তু যারা কিনা এটা নিয়ে কাজ করবে, তাদের প্রথমে আগ্রহী হতে হবে। এখানেও তাদের বিজনেস থাকতে হবে। যেখানে বিজনেস হবে না, সেখানে তো সে ইনভেস্ট করবে না। এ কারণে এই সেক্টরে নতুন নতুন বুদ্ধি, পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।
কনটেন্ট প্রসঙ্গে আরও একটু
কনটেন্ট সম্পর্কে যদি আরেকটু বলি, তাহলে বলতে হয় যে প্রতিটি দেশই তাদের নিজস্ব কনটেন্ট দিয়ে উন্নতি করেছে। যেমন সাউথ কোরিয়া, চায়নাÑ এরা সবাই নিজস্ব কনটেন্ট দিয়ে উন্নতি করছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, ধরেন, আপনার সকাল ১১টায় বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে হবে, কিন্তু সে সময় আপনার একটা অফিশিয়াল জরুরি মিটিং পড়ে গেল। তখন আপনি মোবাইল অ্যাপসে (পিক অ্যান্ড ড্রপ) ঠিক সকাল ১০টায় জানিয়ে দিলেন। তারা আপনার বাচ্চাকে ঠিকঠাক বাসায় দিয়ে যাবে। আপনি মাস শেষে তাকে একটা পেমেন্ট করবেন। তাই বলা যায়, শুধু বিদেশি কনটেন্ট দিয়ে এগোনো যায় না। আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়াও এ ব্যাপারে বেশ এগিয়ে গেছে। আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। এখন অবশ্য অনেকে এগিয়ে আসছে কাজ করার জন্য। তবে আরেকটু ফাস্ট হতে হবে।
আইসিটি খাতে উন্নতি
আইসিটি খাতে আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি। এই খাতের সব যন্ত্রপাতি সহজেই পাওয়া যায়, দামও আয়ত্তের মধ্যে। খোলাবাজারে কম দামেই আমরা কিনতে পারি বাইরের দেশের তুলনায়। এখানে ব্যবসায়ীরাও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা করছেন। তবে সমস্যা হয়ে যায় সার্ভিসেসের েেত্র। সরকারি নিয়মের কারণে সমস্যাটা হয়। বিশেষ করে ইমপোর্ট রুলসের সমস্যার কারণে। একটা নোটবুকের কোনো একটা যন্ত্রাংশ যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাইরের সেই কোম্পানি পার্টসটা ফ্রি লাগিয়ে দেবে। কিন্তু সেই পার্টসটা আনতে গেলে আবার সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়। এসব জটিল ব্যাপারের কারণেও সরাসরি সার্ভিস সেন্টার করতে পারছে না অনেক কোম্পানি। ফলে সার্ভিস করতে সময় লেগে যায়, যেটা সমাধান করতে এক ঘণ্টা বা এক দিনের বেশি লাগত না। শুধু সরকারি নিয়মের কারণে জটিলতা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এ বিষয়টি সরকারের উদ্যোগী হয়ে সমাধান করা উচিত। কেননা, সরকার আইসিটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে চাচ্ছে। আমরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারাও আশ্বাস দিয়েছে। হয়তো এর একটা সমাধান হলেও হতে পারে। এখন দেখা যাক কতটুকু কী হয়।
প্রসঙ্গ রায়ানস আর্কাইভ
২০০০ সাল থেকে রায়ানস আর্কাইভের কাজ শুরু করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির এটা একটা ইনোভেটিভ সাবজেক্ট। এ রকম উদ্যোগ অন্য দেশেও খুব একটা প্রচলিত না। টেলিভিশন, রেডিও, নিউজপেপারের ডেটা এখানে সংরক্ষণ করা। তবে নিউজপেপারের অংশ হিসেবে অনলাইনকে আমরা এখানে রাখছি না। এখান থেকে ডেটা অ্যানালাইসিস করে জনমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে। এ রকম করে রেডিও, টেলিভিশনের প্রায় সব তথ্য আমার কাছে আছে। যেমন ধরেন, কোন টেলিভিশন খেলা সম্পর্কে বেশি অনুষ্ঠান দেখায়, কত সময় এবং কখন দেখায়, তার এক মাসের তথ্য আমি দিতে পারব। এভাবে কোন চ্যানেল ব্যবসাসংক্রান্ত খবর বেশি দেখায়, কোন চ্যানেল বিজ্ঞাপন বেশি দেখায়, কখন দেখায়, কোন বিজ্ঞাপনটা বেশি দেখায়Ñ এমন করে যাবতীয় তথ্য আমরা রেডি করে দিতে পারব। প্রতিপক্ষ কোনো চ্যানেল যদি আমাদের হেল্প নিতে চায়, আমরা ডেটা রেডি করে দিতে পারব। বিনিময়ে আমাদের তারা পে করবে। এটা একটা কমার্শিয়াল ইস্যু। যদি কেউ বাংলাদেশে চায়ের বিজনেস শুরু করতে চায়, তাহলে তাদেরকে আমরা সমস্ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারব। গত এক বছরে কত টাকার চায়ের বিজনেস হয়েছে, কোন চ্যানেল চা-এর বিজ্ঞাপন বেশি দিয়েছে, কখন দিয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য দিয়ে আমরা তাদের হেল্প করতে পারব।
আমার প্রতিষ্ঠানে ১২০ জনের মতো লোক ফুলটাইম কাজ করছে।  আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি তথ্য নেয়, গণহারে কেউ নেয় না। যেমন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি মাঝে মাঝে ডেটা নেয় আমাদের কাছ থেকে। যেমন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি নেয়। তারা বিভিন্ন স্টাডি করার জন্য আমাদের কাছে আসে, আমরা তাদেরকে আমাদের সার্ভারের এক্সেস দিই। এ কাজের জন্য তাদের খুব একটা পে করতে হয় না। এগ্রিকালচার বা ব্যাংকিং ইস্যুতে যদি কেউ পাঁচ বছরের জন্য ডেটা নিতে চায়, তাহলে ২৫ হাজার টাকার মতো খরচ হতে পারে তাদের। এ ক্ষেত্রে আমরাদের লোকবল ব্যবহার হলে এক রকম খরচ, আবার যদি তারা শুধু আমাদের সার্ভারের এক্সেস নেয়, তাহলে খরচ কমে আসে।
পুরোনো পত্রিকার বেশি মাত্রায় চাহিদা থাকে না। খুবই কম লোকজনই পুরোনো পত্রিকার ব্যাপারে আসে। আমাদের সংগ্রহে ১৫ থেকে ২০ বছরের পত্রিকা আছে। উচিত ছিল ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরোনো পত্রিকা সংগ্রহে থাকা, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এটা অবশ্য আমাদের মূল বিজনেস না। মাঝে মাঝে যদি একটি-দুটি পত্রিকার জন্য আসে, তাহলে খুব বেশি টাকা আমরা নিইও না। অনেক সময় আমরা এমনিতেই দিয়ে তাদের হেল্প করি। তবে কেউ যদি ছয় মাস বা এক বছরের জন্য আসে, সে ক্ষেত্রে আমরা একটা পেমেন্ট নিয়ে থাকি।
এ ক্ষেত্রে যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, তারা আমাদের রায়ানস মিডিয়া সাইটে ঢুকলে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবে এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রায়ানস আর্কাইভ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার কথা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। আমরা টোটাল ইনফরমেশনটাকে পাবলিকলি নিয়ে আসতে চাই। যদি পারি তাহলে অ্যাপসের মাধ্যমে আনব। আর যদি না পারি তাহলেই সমস্যা। কারণ আমাদের কাছে প্রচুর কনটেন্ট আছে। এখন এটা নিয়ে অ্যানালাইসিস করতে হবে। আমাদের কাছে ‘র’ ডেটা আছে। যেমন ওয়ান ইলেভেন নিয়ে পুরো ডেটা আমাদের কাছে আছে। তাই বলতে পারি, সবচেয়ে জীবন্ত ডেটা আমাদের কাছে আছে। হয়তো একসময় আমাদের কাছ থেকে অনেকের এই সমস্ত ডেটা প্রয়োজন পড়তে পারে। এখন কীভাবে এসব ডেটা মানুষের কাছে কোন কোন মাধ্যমে পৌঁছালে ভালো হবে, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।
রায়ানস আর্কাইভ ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। তবে দেশে একটি ‘জাতীয় ডেটা সংগ্রহশালা’ থাকা উচিত। কিন্তু আমি মনে করি ব্যক্তিগতভাবে যত সহজে এটা করতে পেরেছি, সরকারিভাবে এটা এত সহজে করতে পারবে না। যেমন গুগুল পারলেও সরকারিভাবে আমেরিকা গুগল প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এটা বিজনেসের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাজেটে কী আশা
আগামী বাজেটে আইসিটি খাতের ব্যাপারে আমার চাওয়াটা হলোÑ নেটওয়ার্ক রিলেটেড প্রোডাক্টের কিছু অ্যানামলি আছে, যেগুলোর সমাধান করা উচিত। ইমপোর্টের সমস্যাগুলো সমাধান করা উচিত। সার্ভিসের ব্যাপারে যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো দূর করা জরুরি। তাহলে কাস্টমারকে সহজে, দ্রুত, ভালোভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।