আবুল খায়েরের ক্যামেরায় ধারণ হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ

৭ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ইতিহাস রচিত হয়েছিল। বিশাল ওই জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৮ মিনিটের এ ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন আপামর বাঙালি জাতি। এ ভাষণের জন্যেই বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ খেতাবে আখ্যায়িত করা হয়। গত ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ ইউনেস্কো কর্তৃক এ ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

তবে স¤প্রতি আরেকটি ভিন্ন কারণে আলোচনায় এসেছে ঐতিহাসিক এই ভাষণটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে একটি তথ্য, আর এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা, কৌতূহল জাগছে মানুষের মনে। ফেসবুকে ‘সিনেমাখোরদের আড্ডা’ নামক একটি পেইজের এক পোস্টে দেখা যায় ঐতিহাসিক সাতই মার্চের যে ভাষণটি আমরা দেখতে পাই, সেটি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন আশি-নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আবুল খায়ের। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায় বেশ কিছু তথ্য, যা হয়তো অভিনেতা আবুল খায়েরের অনেক ভক্ত-অনুরাগীরাই জানেন না।
ঐতিহাসিক এই ভাষণ নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও, পরিকল্পনামাফিক ভাষণটির অডিও-ভিডিও ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বেতার থেকে এ ভাষণ প্রচার করার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের কারণে সেদিন তা প্রচার করা যায়নি।
তবে সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এম আবুল খায়ের এমএনএ ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনের (বর্তমান গোপালগঞ্জ ১ আসন) নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি তখন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের ডিএফপি কর্মকর্তার পাশাপাশি একজন অভিজ্ঞ সচল ক্যামেরা বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তাদের সঙ্গে আরো যুক্ত হলেন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান এনএইচ খন্দকার।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময় এমএনএ আবুল খায়েরের তত্ত্বাবধানে টেকনিশিয়ান এনএইচ খন্দকার মঞ্চের নিচ থেকে ভাষণটির অডিও ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে অভিনেতা আবুল খায়ের মঞ্চের এক পাশ থেকে সচল ক্যামেরা নিয়ে ঐ ভাষণের চিত্রধারণ করেন। কিন্তু ঐ সময়ের ক্যামেরাগুলো বেশ বড় আকার হওয়ার কারণে আবুল খায়েরের একার পক্ষে সেটা নাড়াচাড়া করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল, ফলে এক জায়গায় স্থির থেকে তিনি যতটুকু পেরেছেন, ধারণ করেছিলেন। আর এ কারণেই ৭ মার্চের একটি ভিডিও চিত্র আমরা দেখে থাকি।

এম আবুল খায়ের এমএনএ এর পুত্র বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী খাইরুল আনাম শাকিল এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘আমার বাবা ও অভিনেতা আবুল খায়ের ছিলেন দুই বন্ধু। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা মঞ্চের নিচে লুকিয়ে ঐ ভাষণের অডিও-ভিডিও ধারণ করেছিলেন। আমার বাবার একটি রেকর্ড কোম্পানি ছিল ‘ঢাকা রেকর্ড’ নামে, ফলে তিনি অডিও রেকর্ডের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, অন্যদিকে অভিনেতা আবুল খায়েরের যেহেতু ক্যামেরা জ্ঞান ভালো ছিল, তাই তিনি ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এ ধারণকৃত অডিও-ভিডিও তাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় এর কয়েকটি রেকর্ডে কপি ভারতে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বিশ্বখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির উদ্যোগে এ ভাষণের তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়’।

উল্লেখ্য নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মাধ্যমেই অভিনয় জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন আবুল খায়ের। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতিক কুমার ঘটকের পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এছাড়া, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

আজকের বাজার: সালি / ৩০ নভেম্বর ২০১৭