আর্থিক ব্যবস্থাপনায় রক্ষণশীল নীতি নেওয়ার পরামর্শ সিপিডির

২০১৮ সালের অধিকাংশ কর্মকান্ড নির্বাচনমুখী হবে । তাই চলতি বছরে অর্থনীতি বাড়তি ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ‘রক্ষণশীল’ নীতি নেওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি-২০১৭-১৮ অর্থবছর : প্রথম অন্তবর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছে সংস্থাটির গবেষকরা। একইসঙ্গে ২০১৭ সালের আর্থিক দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যাংক দখল, অর্থপাচার, দারিদ্র্য ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া এবং জিডিপির গুণগত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেয় সিপিডি।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৭ সাল শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল ব্যাক্তি খাতে বিগত কয়েক বছর ধরে যে স্থবিরতা চলছে,সেটা কাটিয়ে উঠার জন্য বছরের শুরুতে কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও বছরের শেষে দিকে সেটা ইতিবাচক হয়নি। ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ কার্ংখিত মাত্রায় বাড়েনি।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ‘শোভন’ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও সেই তুলনায় দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে না। দারিদ্র বিমোচনের হার শ্লথ হয়ে এসেছে। সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থানও হয়নি। আবার এই সময়ে সম্পদের বৈষম্যও বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাংকে ঋণের টাকা ফেরত না যাওয়া, বড় বড় প্রকল্পগুলো ভেতর থেকে বিভিন্ন ধরনের ঠিকাদারী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ ভিন্ন দিকে পরিচালন করা এবং দেশের ভেতরে যে ধরনের প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়া হচ্ছে, তার ভেতর থেকেও ওই বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহেও শ্লথ গতি লক্ষ্য করা গেছে। খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যক্ষ করের ভূমিকা কম হচ্ছে। ফলে ২০১৭ সালে সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সব কর্মকান্ডই প্রায় নির্বাচনমুখী হবে। ২০১৭ সাল ছিল ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির বছর। এই খাতে সংস্কার হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। চলতি বছর এমন ম্যাজিক্যাল কিছু ঘটবে না যাতে বড় ধরনের সংস্কার হবে। সংস্কার করার মতো রাজনৈতিক পুঁজিও নাই। গত বছরের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সঙ্গে চলতি বছরের নির্বাচন বাড়তি ঝুঁকি যোগ করবে। এজন্য রক্ষণশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে হবে। ঋণ কমাতে হবে, টাকার মূল্যমান ঠিক রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে চালের দাম কমাতে হবে। নির্বাচনি বছরে বহুমুখী চাপ সামলাতে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রয়োজন।
ব্যাংক খাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১৭ সাল ব্যাংক কেলেংকারির বছর হয়ে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ব্যাংকের সামগ্রিক সূচক আরও খারাপ হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ঋণের টাকা কয়েক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে বেশ কিছু ব্যাংকের মালিকানা বদল হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা কারণে এসব বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ বা সংস্কার করতে পারেনি। সংস্কারের পরিবর্তে আরও উল্টো দিকে গেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হল।
তিনি বলেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংস্কারের উদ্যোগের অভাব ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল ছিল না।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে তুলা আমদানি ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও উৎপাদনে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০ ভাগই আমদানি-রফতানিতে মূল্য কারসাজির মাধ্যমে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের খতিয়ে দেখা উচিত।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বক্তব্য রাখেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে রফতানি আয় সেই হারে বাড়েনি। ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি হচ্ছে। টাকার মান কমেছে। সার্বিকভাবে সুদ হার কমলেও দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এই সুবিধা পাননি। সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ জনগণের করের টাকা থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন যোগান দিচ্ছে। এখন বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে।
মূল প্রবন্ধে রোহিঙ্গা সম্পর্কে বলা হয়, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এটি ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা চলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, প্রতিদিন যদি ৩০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়, তাহলেও সময় লাগবে কমপক্ষে ৭ বছর এবং এতদিনে খরচ হবে কমপক্ষে ৪৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর যদি প্রতিদিন ২০০ জন ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে সময় লাগবে কমপক্ষে ১২ বছর এবং এতদিনে খরচ হবে কমপক্ষে ১ হাজার ৪৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
আজকের বাজার: সালি / ৩১ জানুয়ারি ২০১৮