আর্থিক সাক্ষরতা: একবিংশ শতকের নতুন চ্যালেঞ্জ

আর্থিক সাক্ষরতা আজকের বিশ্বের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। পৃথিবীজুড়ে জাতীয় অর্থনীতিগুলো শক্তিশালী হচ্ছে এবং প্রতিদিন লাখো মানুষ মূলধারার অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই অভূতপূর্ব একীভূতকরণের ফলে দেশে দেশে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে এবং বাড়ছে জনগোষ্ঠীর জীবনমান। বাংলাদেশের মতো দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্রুতগতি ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে ব্যক্তি মানুষের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ জন্ম নিচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ কর্মসূচি পৌঁছে যাচ্ছে। ফলশ্রূতিতে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিনকে দিন প্রতিটি মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক একীভূতকরণের ফলশ্রূতিতে মানুষ তার লেনদেন, সম্পত্তি ও দায় পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করছে। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক চ্যানেলের অংশ হয়ে পড়ায় মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, বিনিময় হার প্রভৃতি অর্থনৈতিক চলক ব্যক্তির সম্পদ ও দায়ের মূল্যকে সরাসরি প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির ওঠানামার সরাসরি অংশীদার হয়ে পড়ায়, কেবল মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে এখন একজন নিজেকে যেকোনো বিপদের জন্য প্রস্তুত ভাবতে পারেন না। একই সাথে দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আমাদের সমাজে যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙে পড়ছে, যে কারণে ব্যক্তিকে এখন অবসর-পরবর্তী জীবনের জন্য ও আর্থিক পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে মানুষকে আজ তাদের সম্পদ সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এ জন্য যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে মানুষ জীবন যাপন করছে, তা সম্যকভাবে বুঝতে পারা প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার প্রথম ও অত্যাবশ্যকীয় ধাপ হচ্ছে আর্থিক সাক্ষরতা।

আর্থিক সাক্ষরতা বলতে আমরা বুঝি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ। মানুষ কীভাবে উপার্জন করে এবং কীভাবে খরচ করে, কীভাবে মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বদলে দেয়, সুদের হার কীভাবে ব্যক্তির সম্পদ ও দায়ের মূল্য প্রভাবিত করে, কী কারণে শেয়ারবাজারের ওঠানামা হয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা থাকা। আর্থিক সাক্ষরতার লক্ষ্য হচ্ছে যে মানুষ তার অর্থনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হবে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজের কাজে লাগিয়ে উপকৃত হবে।

আর্থিক সাক্ষরতা: দেশে-বিদেশে

সারণি ১: বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে আর্থিক সাক্ষরতার হার

দেশের নাম                    আর্থিক সাক্ষরতার হার

ভুটান                              ৫৪%

মিয়ানমার                       ৫২%

শ্রীলঙ্কা                            ৩৫%

পাকিস্তান                        ২৬%

ভারত                             ২৪%

বাংলাদেশ                       ১৯%

নেপাল                          ১৮%

সূত্র: S&P Global

বিশ্বে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে মাত্র একজন আর্থিকভাবে সাক্ষর। এই হার নারী, দরিদ্র ও অল্পশিক্ষিত লোকেদের মধ্যে আরও কম (Klapper, Lusardi & Van Oudheusden, 2015)। এই তথ্য থেকে সমস্যাটির ব্যাপকতা ও গভীরতা বুঝতে পারা যায়। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোই আর্থিক সাক্ষরতার দিক থেকে পিছিয়ে আছে, উন্নত দেশগুলোর অবস্থাও তত ভালো নয়। অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৫৭% মানুষ আর্থিকভাবে সাক্ষর। সাক্ষরতার হার হিসাবে চিন্তা করলে এটি খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। অন্যান্য উন্নত দেশ যেমন জাপান, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে আর্থিক সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৪৩%, ৬৬% ও ৬৭%।

দক্ষিণ এশিয়া আর্থিক সাক্ষরতার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অনগ্রসর অঞ্চলগুলোর একটি। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারতে আর্থিক সাক্ষরতার হার ২৪%, যেখানে বাংলাদেশে এই হার মাত্র ১৯%। সারণি-১-এ আমরা একটি তুলনামূলক চিত্র দেখতে পাই।

দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল নেপাল বাদে অন্য প্রতিবেশীদের থেকে আর্থিক সাক্ষরতার দিক থেকে পিছিয়ে আছে (Klapper, Lusardi, & Van Oudheusden, 2015)।

সারণি-২ : Mastercard Financial Literacy Index

দেশের নামসামগ্রিক অবস্থানপ্রাথমিক অর্থ ব্যবস্থাপনাঅর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিনিয়োগ
বাংলাদেশ১৫১৬১৪০৯
ভারত১২১৪০৯০৮
ভিয়েতনাম১১০৯০২১৩
মিয়ানমার০৯১৩০৩১৬

 

সূত্র : Mastercard

এদিকে, MASTERCARD FINANCIAL LITERACY INDEX-এ (সারণি-২) বাংলাদেশসহ নিকটবর্তী ১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। পার্শ্ববর্তী ভারতের অবস্থান ১২তম, এমনকি মিয়ানমার ৯ম স্থান দখল করে আছে। এই তালিকায় আর্থিক সাক্ষরতাকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছেÑ প্রাথমিক অর্থ ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাদে প্রতিটি ভাগেই বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। (MASTERCARD, ২০১৫)

জাতীয় সমীক্ষার অধীনে করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে মাত্র ৩৮.৫% অংশগ্রহণকারী আর্থিক সাক্ষরতা পরীক্ষায় পাস করেছে। পরীক্ষায় ব্যাংকিং জ্ঞান, মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে জ্ঞান এবং সাধারণ গণিত সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীদের যাচাই করা হয়। বিষয়গুলোর মধ্যে ব্যাংকিং জ্ঞানে পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন এবং এরপর ছিল মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে জ্ঞান। এই সমীক্ষায় এটাও জানা যায় যে বয়স্কদের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতার হার কম এবং শিক্ষা ও পেশা আর্থিক সাক্ষরতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এর পাশাপাশি এটাও জানা যায় যে নারীদের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতা পুরুষদের তুলনায় কম। (Khalily & Miah, 2015)

আর্থিক সাক্ষরতার অভাব ব্যক্তি তার জীবনে বহুভাবে অনুভব করে। স্বাভাবিকভাবেই আর্থিকভাবে সাক্ষর মানুষ তাদের সম্পদ ও দায় বিচক্ষণতার সাথে দেখাশোনা করে। এটা প্রমাণিত, যেসব ভোক্তা চক্রবৃদ্ধি সুদের হার ধারণাটি বোঝেন না, তাঁরা সুদ ও লেনদেন ব্যয়ে বেশি খরচ করেন এবং বেশি ঋণ গ্রহণ করেন। তাঁরা একই সাথে কম সঞ্চয় ও কম ধার নেওয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে পারেন না। অপর দিকে আর্থিকভাবে সাক্ষর মানুষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও অবসর পরিকল্পনা ভালোভাবে করেন। তাঁরা তাঁদের সঞ্চয় অনেকগুলো বিনিয়োগে ছড়িয়ে রাখেন, যাতে কম ঝুঁকি নিতে হয়।

এর পাশাপাশি জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সুবিধা পুরোপুরি পৌঁছাতে আর্থিক সাক্ষরতা  প্রয়োজন। বিশ্বে ৫৭% মানুষ সঞ্চয় করেন, কিন্তু মাত্র ২৭% মানুষ সঞ্চয় করেন ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক একাউন্টের মালিকদের মধ্যে মাত্র ৪২% তাঁদের একাউন্টের মাধ্যমে সঞ্চয় করেন। এটা একেবারেই কাকতালীয় নয় যে ব্যাংক একাউন্টের মালিকদের মধ্যে ৪৫% আর্থিকভাবে সাক্ষর। অন্যরা তাঁদের একাউন্টের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছে না, আর্থিক সাক্ষরতার অভাবে (Klapper, Lusardi, & Van Oudheusden, 2015)। বাংলাদেশে পরপর দুই দশকে দুটি শেয়ারবাজার ধস হয়েছে, যার পেছনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাব অন্যতম মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

বিশ্বজুড়ে আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি

আর্থিক সাক্ষরতা বিশ্বজুড়েই একটি উদ্বেগের বিষয়। সরকার, অ-মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান, মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান সবাই একযোগে আর্থিক সাক্ষরতা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে। তবে মূলত সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক শিক্ষা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এ কথা আমরা আগেই বলেছি যে আর্থিক সাক্ষরতা উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশের জন্যই একটি সমস্যা। তাই সব দেশই আর্থিক শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের অধীনে একটি নিবেদিত কমিশন রয়েছে, Financial Literacy and Education Commission । দেশটির অর্থনৈতিক সচিব এই কমিশনের চেয়ারম্যান। ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে এই কমিশন একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করে, যার লক্ষ্য ছিল জনসাধারণের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতা ছড়িয়ে দেওয়া। এই কমিশনের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু সংগঠন যেমন National Financial Educators Council এবং Jumpstart coalition আর্থিক সাক্ষরতা ছড়ানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

যুক্তরাজ্যেও সরকারের অধীনে একটি  আর্থিক সাক্ষরতা বিস্তারে নিবেদিত একটি সংগঠন রয়েছে, যার নাম The Money Advice Service, যা ইতোপূর্বে Consumer Financial Education Body নামে পরিচিত ছিল। অন্যান্য উন্নত দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায় একটি নিবেদিত আর্থিক সাক্ষরতা সংগঠন ও জাতীয় কৌশল রয়েছে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও একটি নিবেদিত আর্থিক সাক্ষরতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার নাম National Centre for Financial Education । এই সংগঠন বিভিন্ন আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত। এ ছাড়া ভারত আর্থিক শিক্ষার একটি জাতীয় কৌশলও প্রণয়ন করে। ভারতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আর্থিক শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আর্থিক বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বীমা নিয়ন্ত্রক একযোগে আর্থিক শিক্ষার বিস্তারে কাজ করে চলেছে। Reserve bank of India (RBI) তাদের আউটরিচ প্রোগ্রামে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠায়। যেখানে তাঁরা তৃণমূলের আর্থিক সাক্ষরতা যাচাই করতে পারেন এবং আর্থিক শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেন। RBI সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ওয়েবসাইট, প্যাম্পলেট, কমিকস, নাটক ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। এর পাশাপাশি RBI তার ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আর্থিক সাক্ষরতা কেন্দ্র ও টাউন হল পরিচালনা করে। Securities Exchange Board of India (SEBI) ও আর্থিক সাক্ষরতা প্রসারে দেশব্যাপী প্রচারণা চালায় এবং প্রশিক্ষণ প্যানেল পরিচালনা করে। এর পাশাপাশি SEBI আঞ্চলিক সেমিনার ও সচেতনতা কর্মসূচির আয়োজন করে। বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য ও তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বোর্ড নিবেদিত ওয়েবসাইট ও বিনা মূল্যে প্রবেশযোগ্য ফোনলাইন চালায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ জাগানোর জন্য SEBI পরিচালনা করে ‘Visit SEBI’ প্রোগ্রাম, যেখানে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অফিস ঘুরে যায়।

এ ছাড়া, Insurance Regulatory and Development Authority (IRDA)সচেতনতা কর্মসূচি ও বার্ষিক পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য সেমিনারের আয়োজন করে। Rural Self Employment Training Institute এই আর্থিক সাক্ষরতা অভিযানের সাথে সম্পৃক্ত।

আর্থিক সাক্ষরতার বিকাশ: বাংলাদেশ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও আর্থিক সাক্ষরতা অভিযান শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের নিরলস পরিশ্রমে ইতিমধ্যে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের জন্য সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যেটি বাংলাদেশের প্রথম দিকের আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির একটি। কমিশন সাম্প্রতিক কালে জাতীয়ভাবে একীভূত আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির সাথে নিজেকে একত্র করেছে। BSEC চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হচ্ছে কমিশনের আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া। একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার কাজ হচ্ছে কর্মসূচি তৈরি করা, কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করা, গবেষণা ও মাধ্যম নিয়ে কাজ করা, যাতে আর্থিক শিক্ষা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এ ছাড়া কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি করা হয়েছে, যাতে এসব কাজ সুচারুভাবে সম্পাদন করা যায়। BSEC ২০১৬ সালে জাতীয় আর্থিক শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য তা অবমুক্ত করেছে। কমিশনের পরিকল্পনা হচ্ছে একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা এবং আর্থিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে একটি আলাদা বিভাগ গঠন করা। একই সাথে সাফল্য অর্জনের জন্য কমিশন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণের পরিকল্পনাও উত্থাপন করেছে।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০১৩ সালে Financial Literacy Project -এর সূচনা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাতীয় পর্যায়ে আর্থিক সাক্ষরতাবিষয়ক সভা-সমিতি পরিচালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। MASTERCARD ও BURO সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি পরিচালন করে, যা ২০১৬-এর প্রথম দিক পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫০০ নারীকে আর্থিকভাবে সাক্ষর করে তোলে।

আর্থিক সাক্ষরতা অভিযানকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু সুপারিশ

সরকারের চলমান কর্মসূচির পাশাপাশি আর্থিক সাক্ষরতা অভিযান শক্তিশালী করার জন্য আমরা নিম্নোক্ত সুপারিশ পেশ করছি।

১. নিবেদিত জনশক্তি: আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি বাংলাদেশে কেবল যাত্রা শুরু করেছে। এই কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনের জন্য নিবেদিত জনশক্তির প্রয়োজন। এ কারণে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নতুন জনশক্তি নিয়োগের কথা ভেবে দেখতে পারে।

২. পাঠ্যক্রমে আর্থিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ: আর্থিক সাক্ষরতা জীবনের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা এবং একজন সুনাগরিকের প্রয়োজনীয় গুণাবলীর একটি। এ কারণে জাতীয় পাঠ্যক্রমে আর্থিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

৩. আর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ উৎযাপন: জনগণের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতে এবং আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে আর্থিক সাক্ষরতা সপ্তাহ উৎযাপন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা জাতীয়ভাবে আর্থিক সাক্ষরতা মাস উৎযাপন করে থাকে।

৪. হেল্পলাইন: আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পথ অনুসরণ করে, BSEC-ও হেল্পলাইন বা অভিযোগ লাইন চালু করতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের সুরাহা করবে এবং একই সাথে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক শিক্ষার প্রসারে কাজ করবে।

৫. মার্কেটিং ক্যাম্পেইন: আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচির অধীনে সরকারের পক্ষ থেকে মার্কেটিং ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা যেতে পারে, যেখানে তারকা, ক্রিকেটার ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আর্থিক সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা যেতে পারে।

আর্থিক সাক্ষরতা নিশ্চিতকরণ একবিংশ শতকে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এ দেশ বারবার প্রমাণ করেছে যে আমরা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঘুরে দাঁড়াতে পারি এবং সমস্যার সমাধানে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে পারি।  বাংলাদেশ দারিদ্র্যবিমোচন, জীবনমান উন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রভৃতিতে বিশ্বে আদর্শ হিসেবে পরিচিত। আমরা বিশ্বাস করি যে এ দেশ আর্থিক সাক্ষরতা নিশ্চিতকরণেও একই রকম বৈপ্লবিক সাফল্য দেখাতে পারবে। এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সবাইকে হাতে হাত রেখে কাজ করে যেতে হবে।

আরিফ খান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড